রামনাথের পৃথিবী আর শিকড়হীন ডালপালায় বসত
রামনাথ যে গ্রামটিতে জন্মেছিলেন, আশৈশব শুনে এসেছি এটি এশিয়ার বৃহত্তম গ্রাম। বৃহত্তম গ্রামের এই অভিধাটি অমূলক নয়। একটি গ্রামে একটি উপজেলা। চারটি ইউনিয়নে ভাগ করা গ্রামটি। প্রচলিত সংজ্ঞায় আমরা যেমন জেনেছি কয়েকটি গ্রাম নিয়ে একটি ইউনিয়ন হয়। এখানে প্রচলিত নিয়মের কাঁটা উল্টো ঘুরেছে। গ্রাম একটা, ইউনিয়ন চারটি।
বৃহত্তমের পরিচয়ে খ্যাত গ্রামটি জন্ম দিয়েছে অগণন কৃতি সন্তানের। রামনাথ তাদের একজন, এটুকু বললে রামনাথের প্রতি ন্যায়বিচার হয় না। কারণ একজন রামনাথ এই গ্রামে জন্মেছিলেন এ যুগ যুগান্তরের শ্লাঘা। তিনি যে বিরল কৃতি রেখে গেছেন গ্রাম, দেশ কিংবা দশের জন্য তা তো শতকের পর শতকের অহংকার।
রক্ষণশীল হিন্দু পিতার ঔরসে জন্ম। বিশ্বাসে হিন্দু, একইসঙ্গে স্বদেশপ্রেমে প্রবল বিপ্লবী ছিলেন পিতা বিরজানাথ। যথেষ্ট জমির মালিকানা ছিল। ছিলেন সরকারি দক্ষ কর্মকর্তা। বিদেশি পোশাক পরে দায়িত্ব পালন করতে হবে বলে এক কথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন সরকারি দায়িত্ব। সেই পিতার পুত্র রামনাথ।
বানিয়াচং গ্রামের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারি জন্ম রামনাথের। অবোধ বয়সের কারণে মায়ের মৃত্যুর শোক স্পর্শ করেনি বটে, কিন্তু চোখের সামনে দাদা, বাবা এরকম একের পর এক মৃত্যু বোধকরি সব রক্ষণশীল, অলৈকিকতার জাল ছিঁড়েফুঁড়ে তাঁকে করে তুলেছিল যুক্তিবাদী, চরম বিপ্লবী আর আপসহীন দুরন্ত।
'ধর্ম আবার কী, ও তো গরীব মানুষকে দাবিয়ে রাখার গ্যাঁড়াকল'—ঘোষণা দিয়ে দেশমাতৃকার মুক্তিকে ধ্যানজ্ঞান করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কর্মক্ষেত্রে। প্রথমে সুশীল সেনের নেতৃত্বে বিপ্লবী 'অনুশীলন' দলে, পরে নীতিতে না মিলায় যুগান্তরে।
এই যে না মানার তীব্র স্পর্ধা, আপসহীনতা—সব মিলিয়ে জীবদ্দশায় বেশ একটা সমাজচ্যুত জীবন যাপন করেছেন। আজ গাছতলায় ঘুমিয়েছেন তো পরদিন স্কুলঘরে। গরু, ছাগল, শুকর, যা পেয়েছেন খেয়েছেন।
যোগ দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ক্ষীণকায় গড়ন আর ১০০ পাউন্ডেরও কম ওজনের জন্য বাতিল হয়েছেন। পরে আবার যুক্ত হন সৈন্য বিভাগের জন্য শিক্ষিত কেরানি ও অফিসার স্কুলের ট্রেনিংয়ে।
সাল ১৯১৭। ট্রেনিংয়ের অংশ হিসাবে বাধ্যতামূলক ঘুরতে হয় আফগানিস্তান, পারস্য, রাওয়ালপিন্ডি, বেলুচিস্তান ইত্যাদি। বলা যায়, এই তাঁর বিশ্ব পর্যটক হওয়ার বাসনার অঙ্কুরোদগম। তখনও মোটরগাড়ির রাস্তাঘাট ঠিকঠাক গড়ে ওঠেনি। উড়োজাহাজ তো স্বপ্ন।
যুক্ত হয়েছিলেন 'ফ্রি বেঙ্গল ব্রিগেডে'। নামের আড়ালে সব বাঘা বাঘা বিপ্লবীরা। তাঁদের সংস্পর্শ যেন যাযাবর মনের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি। ফ্রি বেঙ্গল ব্রিগেড চেয়েছিল রামনাথকে ভূপর্যটনের পথে পথে 'পরাধীন ভারতের মুক্তিকামী দলের সর্বাদি রাষ্ট্রদূত' হিসাবে নিয়োগ করতে। কোনো এক ষড়যন্ত্রে তা না পারলেও রামনাথের অন্তরে যে ভূপর্যটনের স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েছিল তা ডালপালায় বিস্তারিত হয়ে ততদিনে তাঁকে করে তুলেছে দৃঢ়চেতা।
তাতে স্ফুলিঙ্গ জ্বলেছিল দুই স্পেনীয় পর্যটকের বিচার। পাসপোর্ট, ভিসাহীন বিশ্ব পরিভ্রমণে বের হওয়া দুই যুবকের বিচার হচ্ছিল মেরিন কোর্টের কাঠগড়ায়। বিচারকের প্রশ্নের উত্তরে যুবকদ্বয় অকুতোভয় স্বরে বলেছিল, 'আমাদের এমন পয়সা নেই যে টিকিট কিনে পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারি। স্থলপথে নাহয় হাঁটা চলে, জলপথে আর উপায় কী? আর পাসপোর্ট আমরা পাইনে এজন্যে যে, আমরা সাধারণতন্ত্রের পক্ষপাতী। আমরা মনে করি দেশ ভ্রমণ না করলে মনুষ্যত্ব অর্জন হয় না।'
ব্যস, কী হয় রামনাথের! অবিচল হয়ে যান লক্ষ্যে। ৭ জুলাই ১৯৩১। কুইন স্ট্রিটের বাঙালি মসজিদ থেকে দুপুর দুটোয় শুরু হয় যাত্রা। কুইন স্ট্রিট সেদিন হয়ে উঠেছিল জনারণ্য। বন্দে মাতরমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে মুখরিত আকাশ-বাতাস। সঙ্গে সাইকেল সারানোর টুকিটাকি বিশ্বের বিদগ্ধজনের অটোগ্রাফ নেওয়ার খাতা, একটি খদ্দরের চাদর আর মশারি সম্বল নিয়ে শুরু হয় তাঁর যাত্রা।
'আমার ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যই ছিল, দুচোখ ভরে বিশ্বকে দেখা, নিজের দেশকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করা। এবং হাজারো মানুষকে নানা কোণ থেকে জানার প্রবল আকাঙ্ক্ষা '। মালয়েশিয়ার রাজধানী থেকে, চিয়াংলো থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, পিকিং, কোরিয়া, জাপান, জাভা, সুমাত্রা...ইউরোপ, জার্মানি, হল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, স্বপ্নের বিলাত।
বলতে গেলে বিশ্ব। একটা সাইকেল ছাড়া কিচ্ছু নেই সম্বল। এক কুটো কানাকড়ি নয়। মানুষ পথের সাথী। মানুষই দিয়েছে সাথ। অর্থ দিয়ে সঙ্গ দিয়ে।
তিরিশের দশক। রামনাথ এক সাইকেলে চষে বেড়াচ্ছেন বিশ্ব। লিখছেন ভ্রমণ কাহিনী। প্রায় চল্লিশটি। মরণ বিজয়ী চীন, আফ্রিকা ইন পিকচার, আজকের আমেরিকা, পারস্য ভ্রমণ, বিদ্রোহী বলকান ইত্যাদি। সাহিত্যমূল্যে খুব উল্লেখযোগ্য নয় হয়তো। কল্পনা করুন সেই সময়টায় এক ক্ষীণকায় বাঙালির বিশ্ব পর্যটনের স্পর্ধাটুকু! বাল্যসখা মৌলভী কাজী গোলাম রহমান জিজ্ঞেস করেছিলেন রামনাথকে, হারে রামা! এই নামেই সবাই ডাকতো তাঁকে। 'কীসের অভাব তোর? এসব ছেড়ে শরীরটাকে নিঙড়ে টঙাস টঙাস করে কি পাস বল তো?'
জবাবে রামনাথ বলেছিলেন 'আমি যাই বিশ্বপ্রকৃতির উঠানে। সেখানে প্রকৃতির রং রূপ বর্ণ গন্ধ স্বাদ গন্ধ হক্কলই মিলে মানুষের মধ্যে। অউ যে সৃষ্টি, উয়ার রহস্য শতদলের বিস্ময় হইতাছে মানুষ। আমি খুইজ্যা বেড়াই সেই মানুষ রতনকে' । মানুষ রতন খুঁজতেন তিনি। মানুষ ভজর দর্শন এভাবেও ধারণ করা যায়!
দেশে ফিরে নিজের গ্রামে ফিরে সগর্বে বলেছিলেন, 'বাইন্নাচুংই আমার দুইন্যাই'। বাইন্যাচুংই আমার পৃথিবী। অথচ নিজের শিকড় বানিয়াচং ছেড়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছেন উত্তর কলকাতায়। উত্তর কলকাতায় যে ঘরটিতে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ দিনগুলো, তারা কেউ এখন আর তার নাম জানে না।
১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর তাঁর দেহাবসান হলে কয়েকজন শুভাকাঙ্ক্ষীর আন্তরিক প্রচেষ্টায় শিয়ালদার কাছে হলওয়েল সড়কটির নাম হয় 'ভূপর্যটক রামনাথ সড়ক'।
বানিয়াচংয়ের মানুষের একটা স্বাতন্ত্র্য উচ্চারণ ভঙ্গি আছে। কী এক অস্পষ্ট ইঙ্গিতে এক বানিয়াচংবাসী পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে সহজেই চিহ্নিত করতে পারে অন্য বানিয়াচংবাসীকে। অথচ তারা কিন্তু রামনাথকে চিনতে পারেনি। বানিয়াচংবাসী কেন, দেশ কি তাঁকে চিনতে পেরেছে? যে রামনাথ আজীবন ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থিত করেছেন, বানিয়াচংকে তাঁর পৃথিবী জেনেছেন, তাঁর বসতিভিটা আজ 'শত্রু সম্পত্তি'। দখলদারদের আস্তানা। মন্দিরের ভগ্নাংশের কোন ধুলিকণায় লেগে আছে স্পর্শ তাঁর। পূর্বপুরুষের গর্বিত উত্তরাধিকারের খোঁজে সেখানে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দখলদাররা।
জাতি হিসাবে আমরা কি এতই হঠকারী? এতই অকৃতজ্ঞ? শিকড়হীন ডালপালায় বসত করি?
রামনাথের বসতিভিটা উদ্ধার হোক।
- তথ্যসূত্র: রামনাথের পৃথিবী: শ্যামসুন্দর বসু