তারা শিরোপা এনে দিয়েছে, এখন এই খেলোয়াড়দের যোগ্য মর্যাদা দিন
দক্ষিণ এশিয়া নারী ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বীর দর্পে দেশে ফিরেছে অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এবং তাঁর দল। এই দলে আছেন রুপনা চাকমা, আঁখি খাতুন, তহুরা খাতুন, ঋতুপর্ণা চাকমা, শামসুন্নাহার সিনিয়র, শিউলি আজিম, শামসুন্নাহার জুনিয়ার, মনিকা চাকমা, নিলুফার ইয়াসমিন, মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, কৃষ্ণা রানী সরকার, সাবিনা খাতুন, এবং সিরাত জাহানসহ ১৪ জন। তাঁদের কোচ গোলাম রাব্বানী ছোটনের পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে। তাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন জানাচ্ছি।
তারা কাঠমান্ডুর দশরথ স্টেডিয়ামে ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে এই শিরোপা অর্জন করেছেন। বলাবাহুল্য প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলের এই শিরোপা অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছে দারুণভাবে, বিশেষ করে যখন ফুটবল খেলার জগতটা যখন প্রায় ম্লান হতে বসেছিল। ক্রিকেট খেলায়ও পুরুষরা খেলতে যাচ্ছেন দাপটের সঙ্গে আর ফিরছেন মাথা নীচু করে খালি হাতে।
দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, জীবনযাত্রার কষ্ট, এতো কিছুর মধ্যেও নারী দলের এই শিরোপা অর্জন সারাদেশের মানুষের জন্য উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। এতে অবাক হবার কিছু নেই। জয়ী দল যখন ফিরে এলো এয়ারপোর্ট এবং বাফুফের কার্যালয়ে যতোই অব্যবস্থাপনা থাকুক না কেন, নারী দলের সদস্যরা ছাদ-খোলা বাসে করে এয়ারপোর্ট থেকে মতিঝিল যাওয়া পর্যন্ত দেখেছেন রাস্তার দু'ধারে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তাদের অভিবাদন জানাচ্ছেন।
এই মানুষগুলো মনে করছেন এরা তাদেরই কন্যাসন্তান। জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দের এই অপূর্ব দৃশ্যই বাংলাদেশের আসল রূপ। এটা কেউ আয়োজন করেনি, এটা ছিল মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত ভালবাসা ও আনন্দের প্রকাশ। সাবিনা খাতুন একটি পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, 'আমার বয়সে আমার মনে হয় না, এত মানুষ আমি একসঙ্গে দেখেছি।'
এবার প্রতিযোগিতা হয়েছে নেপালের সাথে। প্রায় ৬ বছর আগে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ভারতের কাছে হেরেছিল। নারীদের সাফ গেমসে ভারতের আধিপত্য ছিল বরাবরই। নেপালও অনেকটা ধরে নিয়েছিল শিরোপা তাদেরই হবে। কিন্তু বাংলাদেশের নারী দলের মধ্যে একটা কিছু অর্জনের আকুতি ছিল, তাদের অসাধারণ দক্ষতাই এই জয়ের মুকুট ছিনিয়ে এনে দিল। প্রথম গোলটি করেছিলেন শামসুন্নাহার এবং পরের দুটি গোল করেছেন কৃষ্ণা রানী সরকার।
নেপালের একটি গোল করেছেন অনিতা বাসনেত। বাংলাদেশ দলের প্রত্যেক সদস্যেরই এই ভূমিকা ছিল। গোলরক্ষক রূপনা চাকমা যেন গোলের সামনে ঢাল হয়ে বসে ছিল। বাকী সদস্যরাও নিপুণ দক্ষতায় নেপালকে একটির বেশি গোল করতে দেয়নি। অথচ নেপাল বাংলাদেশের তুলনায় ফিফা র্যাংকিংয়ে এগিয়ে ছিল, বাংলাদেশের র্যাংকিং ছিল ১৪৭; নেপালের ১০২।
অর্থাৎ ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের চেয়ে ৪৫ ধাপ এগিয়ে ছিল নেপাল। এসব কিছু বিচার করলে বাংলাদেশের এই জয় অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন মনে করেছিলেন, ২০২৪-২৫ সালের দিকে শিরোপা অর্জন করতে পারবেন, কিন্তু তার আগেই এই শিরোপা ২০২২ সালে পেয়ে গেছেন।
চৌদ্দজনের এই খেলোয়াড় টিমের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। এই টিমের সদস্যরা বাংলাদেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পাহাড় থেকে সমতল সব দিক থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে আছেন মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান সব ধর্মের মানুষ। তারাই বাংলাদেশ। এমন সুন্দর প্রতিনিধিত্বমূলক টিম আর হয় না। তাদের মধ্যে একতা এবং সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক তাদের ভালো খেলতে সাহায্য করেছে।
এখন তাদের অনেকেই বাহবা দেবেন এবং যিনি বাহবা দিয়ে সংবর্ধনা দেবেন তিনি নিজেই ছবি ছাপিয়ে বিখ্যাত হয়ে যাবেন। বিভিন্ন পুরস্কার ঘোষণার কথা প্রতিদিনই পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে। তবে এসব সাময়িক সুবিধা না দিয়ে বরং এই মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। তাদের পিঠ চাপড়ানি দিয়ে প্রশংসার বানে ভাসিয়ে দিলে কোনো উপকার হবে না।
তাদের আরও ভালো খেলতে হবে, সাফ থেকে এশিয়া এমনকি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আমরা জানি তারা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। তারা গ্রামে বড় হয়েছেন, কষ্ট করে ফুটবল খেলার মত একটি খেলা যেটা মেয়েদের খেলা নয় বলেই প্রতিষ্ঠিত, এমন খেলাই তারা গ্রামে খেলেছেন, চর্চা করেছেন। গ্রামের মাঠে তারা প্রাক্টিস করেছেন। কেউ কেউ তাদের বাধা দিলেও সামাজিকভাবে তারা মোকাবেলা করতে পেরেছেন। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে মেয়েরা গ্রামের মানুষের সহযোগিতাও পেয়েছেন।
যেসব বাধার কথা বলা হচ্ছে সেই ধরনের বাধা গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে গ্রাম থেকে আসা মেয়েদেরও সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তারাও পুরুষদের কর্মক্ষেত্র ফ্যাক্টরিতে এসেছিলেন বলে তাদেরও অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু তাতে তারা দমে যায়নি। আমি লক্ষ্য করছি এই মেয়েদের অর্জনের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের গুষ্টি উদ্ধার করা হচ্ছে। মোল্লাদের বাধার কথা বলে অহেতুক উস্কানি দেয়া হচ্ছে। ছোটখাটো দু-একটি ঘটনাকে বাংলাদেশের সবখানের বলে যে অপচেষ্টা হচ্ছে তার নিন্দা জানাই।
অথচ এই মেয়েদের গ্রামই তাদের সহায়তা করেছে, রাষ্ট্র নয়। গ্রামের সাধারণ শিক্ষক, মা-বাবা এবং আত্মীয়রা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। যেমন ময়মনসিংহের কলসিন্দুর গ্রাম থেকে এসেছেন ৮ জন খেলোয়াড়। এখানে তাদের দরিদ্র অবস্থা দেখে খেলায় সহায়তা করেছেন তাদের স্কুলের শিক্ষক। রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়নের ভুয়ো আদম গ্রামে ২ জন খেলোয়াড় রূপনা চাকমা ও ঋতুপর্ণা চাকমা প্রচণ্ড দারিদ্রের মধ্যে থেকে মায়ের সহযোগিতায় এতদূর আসতে পেরেছে। তাদের দু'জনেরই বাবা নেই।
চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বলেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা আপনাআপনি ভাল হয়ে যাবে না। নারী ফুটবল দলের এই মেয়েরা তাদের ঘরে খেয়ে না খেয়ে নিজ নিজ প্রতিভাগুণে বাফুফেতে যোগদান করে নিয়মিত প্র্যাক্টিস করে আজ একেকজন দক্ষ খেলোয়াড় হয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রতি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই বদলায় নি। তাদের বেতন দেওয়া হচ্ছে তবে খুব সামান্য।
বাফুফের বেতন কাঠামোর আওতায় বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে ২০১৯ সাল থেকে ৩৬ জন নারী ফুটবলারকে আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ক্যাটাগরিতে বেতন ১২ হাজার, বি তে ১০ আর সি ক্যাটাগরিতে ৮ হাজার টাকা মাত্র। বলা হচ্ছে পুরুষ খেলোয়াড়রা বেতনের আওতাভুক্ত নয়। তবে বছরে তারা লীগ ক্লাবগুলোর কাছে ৫০-৬০ লাখ টাকা পান, তাহলে মাসে কম পক্ষে ৪ লাখের বেশি টাকা পান। অন্যদিকে নারী খেলোয়াড়রা লীগ ক্লাবে খেললে পান মাত্র ৩-৪ লাখ টাকা, তাহলে মাসে ২৫ হাজারের বেশি হবে না। এর সাথে মাসিক বেতন যোগ করলে টাকার অংক দাঁড়াচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৭ হাজার টাকা এবং সর্বনিম্ন ৩৩ হাজার টাকা। কাজেই পুরুষরা অবৈতনিক খেলছে এমন কথা বলা হলেও পুরুষদের আয় নারীদের তুলনায় বেশিই থাকছে।
এখানে নারী খেলোয়াড়দের কি সস্তা শ্রমিকের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে না কি? এবং নারী বলেই তাদের প্রতি ভিন্ন আচরণ হচ্ছে না কি? একই কাজে একই বেতন না পাওয়া নারীর জন্যে নতুন কিছু নয়। সেটা কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে অফিস আদালতের কাজ পর্যন্ত এই বৈষম্য হয়ে আসছে। এখন বিষয়গুলো সামনে উঠে আসছে বলে সমমজুরির দাবি উঠছে।
এই পুরুষতান্ত্রিকতা খেলার জগতেও থাকবে এমনটা কাম্য নয়। কারণ খেলাটাই এখানে পুরুষতান্ত্রিক শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে স্বাধীন মানুষ হিসেবে করতে হয়। শুধু বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়ই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের নারী খেলোয়াড়রাও বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। নেপালের নারী ফুটবলাররা মাসে ৭,০০০ রুপি আর পুরুষ খেলোয়াড় পেতো ১৫,০০০ রুপি। কিন্তু অল নেপাল ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন জানুয়ারি, ২০২১ থেকে নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের বেতন সমান করে দিয়েছে ১৮,০০০ রুপি।
যুক্তরাষ্ট্রের মত দেশের নারী খেলোয়াড়রাও বৈষম্যের শিকার ছিলেন। সেখানে সুখবর হচ্ছে ২০২২ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র সকার ফেডারেশন (ইউএসএসএফ), যুক্তরাষ্ট্র উইমেন্স ন্যাশনাল টিম প্লেয়ার্স এসোসিয়েশন (ইউএসডব্লিউটিপিএ) ও যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল সকার টিম প্লেয়ার্স এসোসিয়েশন (ইউএসএনএসটিপিএ) এক ঐতিহাসিক সমঝোতায় পৌঁছেছে। এখন থেকে পুরুষদের পাশাপাশি সবক্ষেত্রে সমান অধিকার পাবে যুক্তরাষ্ট্রের নারী ফুটবল দল।
তাদের বেতন কাঠামো থেকে শুরু করে বিশ্বকাপসহ সব ধরনের প্রতিযোগিতায় ম্যাচ ফি, বোনাসসহ আনুষঙ্গিক অর্জিত অর্থের পরিমাণ সমান হবে। এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফুটবল বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র নজির স্থাপন করেছে। তবে এর জন্যে নারী দলের সদস্যদের অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। সংগ্রাম করতে হচ্ছে ভারত ও অন্যান্য দেশের নারী ফুটবলারদের।
বাফুফেতে নারী দলের বেতন বাড়ানোর প্রশ্ন উঠলে তহবিলের সমস্যার কথা বলা হয়। এ কারণেই নাকি নারী ফুটবলারদের বেতন বাড়ানো যাচ্ছে না বলে দাবি করেছেন বাফুফে কর্মকর্তারা। এটা যদি সত্যিও হয় তাহলেও উদ্যোগ নিলে নিশ্চয়ই সমাধান আসবে। সাফ চ্যাম্পিয়ন হবার পর পুরস্কারের এতো ঘোষণা আসছে সেগুলো মেয়েরা ঠিকমতো পাবে তো? নাকি শুধু ঘোষণাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
আশা করি নারী ফুটবলারদের শুধু নারী হিসেবে নয়, তাদের খেলোয়াড় হিসেবে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে এবং ভবিষ্যতে তারা যেন আরও ভালো খেলতে পারে তার জন্যে সকল প্রকার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।