বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিপর্যয় তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষেরই পুনরাবৃত্তি
বাংলাদেশে গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের পর দেশের বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে ব্ল্যাকআউটের ঘটনা ইঙ্গিত দেয় কীভাবে এত বছর পরেও ইউরোপের মতো উন্নত বিশ্বের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণে উন্নয়নশীল দেশগুলো বলিদান দিচ্ছে।
রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুসারে গত ৫ অক্টোবর বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ অঞ্চলজুড়ে গ্রিড বিপর্যয় দেখা দেয়। সরকারি নথি অনুযায়ী দেশের গ্যাসচালিত ৭৭টি ইউনিটের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি ইউনিটে জ্বালানি ঘাটতি ছিল।
পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে স্কুলগুলোও বন্ধ ঘোষণা করতে হয়েছে। কিন্তু এর দায় কার? স্পষ্টভাবেই এই পুরো বিপর্যয়ের জন্য দায়ী ইউরোপ।
বাংলাদেশের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১০ কোটির বেশি মানুষের ওপর ইউরোপে বাড়তি জ্বালানি চাহিদার প্রভাব পড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানির আকাশচুম্বী দাম এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পূর্বে এশিয়ার জন্য বরাদ্দকৃত গ্যাস এখন আগ্রাসীভাবে ইউরোপে সরবরাহ করা হচ্ছে।
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির মোহাম্মদ তামিম ডিডব্লিউকে বলেন, 'ইউরোপ যেখান থেকে পারছে সেখান থেকেই গ্যাসের প্রতিটি কণা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে'।
ইউরোপীয় ডিলাররাও ভবিষ্যতের জন্য মজুদ খুঁজছেন বলে জানা গেছে।
'তারা শুধু এখনকার জন্যই নয়, ভবিষ্যতের জন্যও কিনে রাখছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের ক্রয়ক্ষমতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলোর ওপর স্পষ্ট কড়াঘাত নেমে আসছে'।
তবে বর্তমানের এই বিপর্যয় স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতকেও। প্রায় ৮০ বছর আগে এভাবেই উন্নত বিশ্বের চাহিদার কাছে বলি দিতে হয়েছিল বাংলার সাধারণ মানুষকে। ভয়ঙ্কর সেই দুর্ভিক্ষে প্রাণ দিয়েছিল বাংলার ৩০ লাখ মানুষ।
বাংলায় কী ঘটেছিল?
১৯৪৩ সালে অখণ্ড বাংলার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা তেতাল্লিশের মন্বন্তর নামে পরিচিত।
শৈশবে সেই দুর্ভিক্ষের সাক্ষী হয়েছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। সেই স্মৃতি থেকে তিনি লিখেছেন, 'রাস্তার ধারেই অনেকে মারা যেত। দুর্ভিক্ষের পরের মাসগুলোতেও রাস্তায় মানুষের মাথার খুলি আর হাড়গোড় পড়ে থাকত'।
অনুসন্ধানী প্রমাণ থেকে জানা যায় কোনো খরা বা প্রতিকূল জলবায়ুর কারণে বাংলার সেই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়নি, বরং দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ছিল ব্রিটিশ শাসন নীতি।
ভারতের খাদ্যশস্যের চালান দেশের বাইরে পাঠানোর ক্ষেত্রে বারবার সতর্ক করার পরেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের মন্ত্রিসভা ১৯৪৩ সালে ভারত থেকে ৭০ হাজার টন চালের চালান পাঠায়।
'১৯৪২-৪৩ সালে ভারতের ভাইসরয় এক মিলিয়ন টনের কিছু বেশি জরুরি গম সরবরাহের অনুরোধ করলেও লন্ডন তা প্রত্যাখ্যান করে। এরপরেও চালের মজুদ ভারত ছেড়ে চলে যেতে থাকে,' দ্য গার্ডিয়ানকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করা সাংবাদিক মধুশ্রী মুখার্জি।
'শোনা যায় চার্চিল এই দুর্ভিক্ষের জন্য ভারতীয়দের খরগোশের মতো সন্তান জন্মদানকে দায়ী করেছিলেন। এমনকি এমন প্রশ্নও নাকি করেছিলেন যে দুর্ভিক্ষ এতই খারাপ হলে মহাত্মা গান্ধী কীভাবে এখনও বেঁচে আছে', বলেন তিনি।
ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত বাংলাকে সেবার একটা বড় মূল্য চুকাতে হয়েছে। প্রায় আট দশক পর এবার বাংলাদেশের পালা।
অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা