তামাকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও ই-সিগারেট
তামাকজাত দ্রব্য সেবন স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর- এই কঠিন সত্য কথাটি সকলেই বোঝেন। এর জন্যে নতুন তথ্য উপাত্ত্ব হাজির করে প্রমাণ করতে হবে না। বছরে ১,২৬,০০০ মানুষ তামাকজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় মৃত্যুবরণ করে; দেড় লক্ষের অধিক মানুষ নানা রোগে ভুগছে। খোদ তামাক কোম্পনি নিজেরাও বিভিন্নভাবে তা স্বীকার করে; কিন্তু এর মাধ্যমে যে মুনাফা আসে সেটার লোভ তারা সামলাতে পারে না। তাই তামাক সেবনে মানুষের মৃত্যু হয় জেনেও এই ব্যবসা কোন কোম্পানি বন্ধ করছে না।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশে আইন করে তামাক সেবন নিয়ন্ত্রণ করছে। তামাক শুধু মৃত্যুর কারণ নয়, তামাক সেবনে অ-সংক্রামক রোগ, বিশেষ করে স্ট্রোক হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি রোগ ইত্যাদী ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে এবং অল্প বয়সেই রোগাক্রান্ত হয়ে দুঃসহ জীবন যাপন করছে সেবনকারীরা। পরিবারের ওপর বিশাল এক অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করছে।
এসবই জানা কথা। করোনা মহামারি আকারে হাজির হলেও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ২৯,৪৩৯। অথচ এর পেছনে সারা বিশ্বে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে, দেশের স্বাস্থ্য সেবা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। তামাক নিয়ন্ত্রণের কাজও হচ্ছে এবং এই কারণে ধুমপায়িদের সংখ্যা কিছুটা কমেছে; কিন্তু এখনো দেশের তিন ভাগের এক ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক জনগণ (৩৫.৩%) ধুমপানসহ নানা ধরনের ধোয়াবিহীন তামাক (জর্দা, গুল, সাদাপাতা) সেবন করছে এবং ক্রমাগতভাবে অসুস্থ হচ্ছে।
আমাদের দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণীত হয়েছে ২০০৫ সালে। এই আইন প্রণয়নের সময় দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্য সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা তেমন ছিল না, এবং কোন নির্দিষ্ট ও সংগঠিত আন্দোলনও ছিল না। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। সেটা করতে যেয়ে আইনের দুর্বলতাগুলো দৃশ্যমান হয়। ফলে দাবি ওঠে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের।
বিশেষ করে নারী সংগঠনগুলো প্রশ্ন তুলে যে, ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবনকারীর সংখ্যা ধুমপায়ীদের তুলনা বেশি হলেও এই তামাকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্যে আইনে তেমন সুযোগ নেই। এই প্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের আইন সংশোধনের সময় তামাক দ্রব্যের সংজ্ঞায় জর্দা, গুল ও সাদাপাতা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এটা ছিল ২০১৩ সালের আইন সংশোধনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
কিন্তু আরো অনেক বিষয় এখন দেখা যাচ্ছে যা বিদ্যমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন দ্বারা সমাধান করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে তামাক কোম্পানি যেভাবে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর হস্তক্ষেপ করছে তা আন্তর্জাতিক কনভেনশান এফসিটিসি'র লংঘন হলেও জাতীয় আইনে না থাকায় সে সুবিধা কোম্পানি নিচ্ছে। শুধু তাই নয়, সিগারেট জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বলে নিত্য নতুন নিকোটিনযুক্ত তামাক দ্রব্য বাজারে ছাড়ছে এবং এর পক্ষে প্রচার করছে। এই নতুন তামাকদ্রব্যের কথা বিদ্যমান আইনের সংজ্ঞায় না থাকায় এই দ্রব্য অবাধে বিক্রয় হতে পারছে।
এরমধ্যে বাংলাদেশে এখন যে নতুন তামাকদ্রব্য আসছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ই-সিগারেট বা ইলেক্ট্রনিক সিগারেট। এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। অর্থাৎ ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (২০১৩ সনে সংশোধিত) এর অধিকতর সংশোধনী হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। এর জন্যে তামাক নিয়ণত্রণে নিয়োজিত সংগঠনগুলো সরকারের সাথে মিলে খসড়া চূড়ান্ত করেছে এবং আশা করা যায় কেবিনেটের অনুমোদন দ্রুত পেয়ে যাবে।
এর মধ্যে ই-সিগারেটের বিষয়ে সু-নির্দিষ্টভাবে যে প্রস্তাব আছে তা হচ্ছে ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিষ্টেম, ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা। "কোনো ব্যক্তি ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিষ্টেম, সেটির যন্ত্রাংশ বা অংশবিশেষ (ই-সিগারেট, ভেপ, ভেপিং, ভেপার ইত্যাদি) হিটেড টোব্যাকো প্রডাক্টস, হিট নট বার্ণ এবং ওরাল পাউচ যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, সংরক্ষণ, বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা, প্রণোদনা, পৃষ্ঠপোষকতা, বিপণন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয়, ও পরিবহন করবেন না বা করাবেন না"। এই প্রস্তাবের মধ্যে সকল ধরনের ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিষ্টেমকে আইনের আওতায় আনতে পারবে। কিন্তু কোম্পানিগুলো এই সংশোধনীতে বাধা দিচ্ছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে সিগারেটের বিকল্প হিসেবেও এই তামাকদ্রব্য প্রয়োজন বলে প্রচার করছে। অর্থাৎ সিগারেট ছাড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে এমন ধারণা দিচ্ছে। কিন্তু সিগারেট ছাড়লেও নিকোটিন বা তামাক কোনটাই ছাড়া হবে না ই-সিগারেটের মাধ্যমে।
সহজ কথায় ই-সিগারেট এমন একটি ডিভাইস যেখানে নিকোটিন যুক্ত তরল দ্রব্য হিট, যা গরম করা হয়। এর থেকে নির্গত এরোসল বা তরলের শক্ত কণা ফুসফুসের ভেতর প্রবেশ করে। এই এরোসলের মধ্যে ক্ষতিকর ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান রয়েছে যেমন ফরমাল্ডিহাইড, এসিটেল্ডিহাইড, লেড এবং নিকেল। ফলে ই-সিগারেট সেবনে শ্বাসযন্ত্র এবং কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া সিগারেটের মতোই ই-সিগারেটেও নিকোটিন আছে কাজেই নেশা তৈরি করতে পারে। ই-সিগারেটের নিকোটিন তামাক পাতা থেকে নিষ্কাশন করে নেয়া হয়। এবং এই তামাক পাতা উৎপাদনে পরিবেশ দুষণ ও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি রয়েছে। ই-সিগারেটের ডিভাইসে একটা লিথিয়াম ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়। এই ব্যাটারিতে লিথিয়াম, তামা এবং এল্যুমিনিয়ামের মতো খনিজ পদার্থ ব্যবহার করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত জার্মানির আনফেয়ারটোবাকো ডটকম এর 'ই-সিগারেট সাপ্লাই চেইন: এনভায়রনমেন্ট, হিউম্যান রাইটস' শীর্ষক তথ্যচিত্রে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে।
ই-সিগারেটের বিষয়টি অনেকের কাছে নতুন মনে হলেও কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে এবং শহরের তরুণদের মধ্যে 'জনপ্রিয়' হয়ে উঠেছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই ই-সিগারেটের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত না হয়েই এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। ফলে এ বিষয়ে শুরুতেই উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করতে হবে।
তাই তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের প্রস্তাবে ই-সিগারেট যুক্তিসংগত কারণেই নিষিদ্ধ বা ব্যান করার প্রস্তাব এসেছে। আইন সংশোধনের খসড়ায় ই-সিগারেট ব্যবহারের জন্য ৫০০০ টাকা জরিমানা করা প্রস্তাব করা হয়েছে। ই-সিগারেট উৎপাদন, আমদানি, রপ্তানি, গুদামজাত করা, বিক্রি এবং স্থানান্তর করা নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। অমান্য করলে ৬ মাসের জেল অথবা ২ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। একাধিক বার আইন অমান্য করলে শাস্তি দ্বিগুণ হবে [সূত্র: দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ২৭ জুন ২০২২]।
এদিকে আইন সংশোধনী খসড়া ২০২২ সালের জুন মাসে সংবাদ মাধ্যমে প্রচার হবার পর থেকে ই-সিগারেট এবং ভেপিং এর পক্ষে জোর তদবীর শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশ-বেসড ভয়সেস অব ভেপার্স নামক একটি সংগঠন 'সেভ ভেপিং, সেভ বাংলাদেশ' শীর্ষক একটি ওয়েবিনারে ই-সিগারেট, ভ্যাপিংসহ হিটেড টোবাকো নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা তামাক নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত সংগঠন সমুহের ভাষার সাথে মিল রেখে হাস্যকরভাবে দাবি করছে, এগুলো নিষিদ্ধ হলে ২০৪০ সালে প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত তামাক-মুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করা সম্ভব হবে না। ওয়েবিনারের রিপোর্ট করেছে ডেইলি স্টার পত্রিকা [৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২]।
তামাক কোম্পানির এই কৌশলে মানুষ সহজে বিভ্রান্ত হবে না হয়তো, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল (এনটিসিসি] কে প্রভাবিত করতে পারে বা পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে পারে যা আইন সংশোধনীতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তাদের একটি খোঁড়া যুক্তি হচ্ছে ই-সিগারেট এবং ভেপ ধুমপান ছেড়ে দেওয়ার জন্যে বিকল্প হিশেবে ব্যবহার করা হয়। কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ধুমপান ছাড়ার কর্মসুচিতে এক তামাক ছাড়ায়ে অন্য তামাকে আকৃষ্ট করবে, যেন তাদের ব্যবসা ও মুনাফার ক্ষতি না হয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য মানুষের জীবন রক্ষা নয়, মুনাফা রক্ষা করা। এই ওয়েবিনারে যারা যোগ দিয়েছিলেন তারা তামাক নিয়ন্ত্রণের কেউ নন, এমনকি স্বাস্থ্য সংগঠনের ও প্রতিনিধি নন। তারা ছিলেন বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ইউকে ভেপিং ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি। তাদের দেওয়া তথ্য পক্ষপাতদুষ্ট হতে বাধ্য। সরকার যেন এই ফাঁদে পা না দেন সেই আশা করছি।
তবে এই বিষয় নিয়ে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, ইউকেসহ বিভিন্ন দেশে গবেষণা হয়েছে সেগুলো নিয়ে বাংলাদেশেও আলোচনা হওয়া উচিত। ধুমপান ছাড়ার চেষ্টা করা শুধুমাত্র নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নির্ভর হওয়া খুব যুক্তিসংগত কাজ নয়, তাতে অন্য আরেকটি পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। বরং আসক্ত ধুমপায়িদের পরামর্শ দান করা, তাদের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন করা বেশি কার্যকর এবং দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
আমরা এখন দেখি দীর্ঘদিন (২০-৩০ বছরের বেশি সময়) ধরে যারা ধুমপান করছেন তারা অসুস্থ হবার পর চিকিৎসকের কাছে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শে ছেড়ে দিয়েছেন। কোন ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের চাপে ছেড়েছেন, কোন নিকোটিন থেরাপির প্রয়োজন হয় নি। যারা পানের সাথে জর্দা বা সাদাপাতা খান তাদেরকে অন্য ধরনের পানের মসলা দিলেও ধীরে ধীরে ছেড়ে দেন। মোট কথা তামাক দ্রব্য সেবনের স্বাস্থ্য ক্ষতি সম্পর্কে জানলে বেশি কাজে লাগে।
তাছাড়া তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাক সেবন, বিক্রি, উৎপাদন এর ওপর যে সব বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে তাও কার্যকর হচ্ছে এবং হবে। দাম বাড়লে ব্যবহার কমবে, উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ আনলেও সরবরাহ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবহার কমানোতে প্রভাব পড়বে। তামাক দ্রব্যের ওপর করারোপ একটি কার্যকর পদ্ধতি। কিন্তু এসব ছেড়ে নিকোটিন কেন্দ্রিক থেরাপির দিকে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে কোম্পানির নিয়ন্ত্রণেই সমাধানের বিষয়টি তুলে দেয়া, সেটা একেবারেই সঠিক নীতি নয়। আইন সংশোধনের কাজ অনেকখানি এগিয়ে গেছে। আশা করছি ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ একটি উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
- লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী