দুই দেশের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ সম্পর্কে পাটপণ্য রপ্তানিতে ভারতের অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক বহাল রাখা কি কাঙ্ক্ষিত?
বছরের শুরুতেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় এক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করার পদক্ষেপ বলেই ধারণা করা যেতে পারে। ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যের উপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আগামী পাঁচ বছরের জন্য বহাল রাখল। বাংলাদেশের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর ভারত জানিয়ে দিল, পাটপণ্যের উপর চলমান অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহার তো হলোই না, বরং নতুন করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য বলবৎ করা হলো।
ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের পারস্পারিক সম্পর্ক নিয়ে নানা অতিকথন চালু থাকলেও আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার সম্পর্ক বলেই জানি। বছরের শুরুতে ভারতের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে হতাশ করবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের পাট শিল্প থেকে আহরিত বৈদেশিক মুদ্রা একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করত। পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এই ছিল আমাদের অভিযোগ। সেই পাট শিল্প নিয়ে এখনো আমরা ধুঁকছি। বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আদমজী জুট মিল বন্ধ করা হয়েছিল। যে আদমজী জুট মিল ছিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির গর্বের বিষয়।
২০১৫ সালের দিকে ভারতীয় পাটকলমালিকদের সংগঠন আইজেএমএ সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানায় বাংলাদেশ ও নেপাল থেকে কম দামে পাটপণ্য আমদানি করা হচ্ছে, যার ফলে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। ২০১৫ সালে আমাদের পাটকলমালিকরা পাটের ব্যাগ ও হেসিয়ান কাপড়ে ১০ শতাংশ ও পাটের সুতায় ৭.৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা পেয়ে থাকে। এই নগদ সহায়তা প্রদানকেই ভারতীয় পক্ষ ডাম্পিং হিসেবে চিহ্নিত করল এবং শুল্ক আরোপের মাধ্যমে অ্যান্টি-ডাম্পিং কার্যকর করার সুপারিশ করে।
২০১৭ সাল থেকে কার্যকর হওয়া অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে আরও পাঁচ বছরের আওতার মধ্যে পড়ল। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারের। যদিও ২০১৫ সালে ভারতে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৫ বিলিয়ন ডলার, যা এই সাত বছরে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে এই বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য।
বাংলাদেশের বস্ত্র খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে কর্মরত ভারতীয়দের রেমিট্যান্স যুক্ত করলে দুই দেশের বাণিজ্যিক তথা অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা আরও ব্যাপক। ভারত আমাদের কিছু পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে রেখেছে। তারপরও ভারতের ৭০০ কোটি ডলারের বিপরীতে আমরা ২০০ কোটি ডলারেও পৌঁছুতে পারিনি। শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার কথা বলা হলেও অনেক পণ্যে কাউন্টারভেইলিং সাড়ে ১২ শতাংশ শুল্ক প্রদান করতে হয়। ফলে তা আর 'শুল্কমুক্ত সুবিধা' থাকল না। সে কারণে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।
ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক বহুমাত্রিক সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এই সম্পর্কের ধরন নিয়ে ধন্ধে পড়ে যেতে হয়। আমাদের কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের সংকট দেখা দিলে ভারত ওই পণ্যে কোনো না কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী আদানি গ্রুপ থেকে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। বহুজাতিক এই শিল্পগোষ্ঠীর সদর দপ্তর ভারতের গুজরাটে। আদানি ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম আর্থিক চালিকাশক্তিও। বছর গড়ালেই আমাদের নতুন নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে নানামুখী রাজনৈতিক তৎপরতা ও মেরুকরণ চলছে। এ সময়ে আদানি গ্রুপের সাথে বাণিজ্যিক চুক্তি রাজনৈতিক অভিজ্ঞমহল একটু ভিন্নভাবেই দেখছেন।
বছরের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়ে এর প্রতিফলন নেই। সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি। বরং এমন মনে হতে পারে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে—এই ধরনের ঘোষণার আড়ালে ভারত নিরঙ্কুশ সুবিধাটুকুই ভোগ করছে।
ভারতের পর্যটন, শিক্ষা ও চিকিৎসার একচেটিয়া বাজার বাংলাদেশ। কিন্তু ভারত তার স্বার্থের প্রশ্নে সামান্য ছাড়ও দেয় না।
সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশ ছিল বাংলাদেশের সঙ্গে তারা নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করবে। যদিও বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিষয়টিতে অনীহা প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্ত দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় লেনদেন কীভাবে সম্পন্ন হবে, তা এখনও সুস্পষ্ট নয়। দ্বিপাক্ষিক মুদ্রাব্যবস্থার বাণিজ্য বাংলাদেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে নাকি লাভবান করবে। তা পদ্ধতির উপর নির্ভর করবে। তবে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে নিজস্ব মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি বিশ্ব আঙ্গিকে।
২০২১ সনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিজের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি যখন বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল তখনও আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের মূল্য ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এ এক অদ্ভুত মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে পৃথিবীতে। এই বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ রেখেই বর্তমানে চীন দ্বিপাক্ষিক মুদ্রায় বাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে। আগামী পৃথিবীতেও ডলারের কর্তৃত্ববাদিতা পরিসমাপ্তির জন্যই পারস্পরিক মুদ্রায় বাণিজ্য গড়ে তোলাটাই যুক্তিযুক্ত। ভারতীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবকে গভীর মনোযোগের সঙ্গে খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
২০২৪ সালে ভারতের নির্বাচন। বিজেপি নির্বাচনকে মাথায় রেখেই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত নতুন প্রস্তাব প্রদান করেছেন বাংলাদেশের বিমানবন্দরের উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। সম্ভবত আদানি গ্রুপের পক্ষেই তার ইচ্ছা প্রকাশিত হয়েছে। যে আদানি গ্রুপের সাথে বিদ্যুৎ চুক্তি হয়েছে, তা ইতিমধ্যে সমালোচনার মুখে পড়েছে উচ্চমূল্যের কারণে।
সব মিলিয়ে এহেন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পাটপণ্য রপ্তানি অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরও পাঁচ বছর অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়ে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন করে বোধহয় প্রশ্নের মুখেই ফেলে দিল ভারত।