শূন্য নয় শুধু ‘শূন্য’! সুমেরীয় থেকে বাইনারি কোড: যেভাবে পাল্টেছে শূন্যের ধারণা
১৯৭৯ সালে মুক্তধারা থেকে স্বপন কুমার গায়েনের লেখা 'স্বাতীর কীর্তি' নামক একটি সায়েন্স ফিকশন গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। তা-তে একটি গল্পের নাম ছিল 'সাইবারনেটিকস'। বাংলা ভাষায় লেখা কোনো গল্প বা উপন্যাসে 'সাইবারনেটিকস' শব্দটি এর আগে ব্যবহৃত হয়েছে বলে জানা নেই। ১৯৪৮ সালে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহারকারী নরবার্ট ওয়েইনারের নাম তখনো বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের জানা হয়নি বলেই প্রতীতি হয়। স্বপন কুমার গায়েনের 'সাইবারনেটিকস' গল্পটি থেকে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পারা যায় — সেটি হচ্ছে শূন্যের আবিষ্কারক আর্যভট্টের নাম।
'শূন্য'কে মানহীন, মূল্যহীন কিছু ভাবার উপায় নেই — এটি একটি বিশাল ব্যাপার। শূন্যের ধারণা উদ্ভব হয়েছে কয়েক হাজার বছর আগে, এবং এই ধারণা প্রথম কাদের আবিষ্কার সেটি নিয়ে অনিঃশেষ বিতর্ক আছে। শূন্যতা বিষয়ক দর্শনের চর্চা ও গবেষণা ব্যাপক ও বহু সহস্রাব্দব্যাপী; এ লেখা সেটি নিয়ে নয়। গণিতের শূন্য আবিষ্কার নিয়ে কিছু খোঁজখবর করা সম্ভব, বর্তমান আলোচনায় ঐটুকুই চেষ্টা করা হবে।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে গণিতের শূন্যের আবিষ্কার একটা বিশাল ঘটনা। শূন্য নিজে একটা স্বাধীন সংখ্যা হিসেবে মর্যাদা লাভ করায় এবং এর স্থানাঙ্ক মান তৈরি হওয়ায় আমরা ১০-ভিত্তিক যেকোনো বড় সংখ্যা লিখতে পারি, ঋণাত্মক সংখ্যা হিসেব করতে পারি, দশমিক দিয়ে ভগ্নাংশ প্রকাশ করতে পারি। ডিজিটাল দুনিয়ার ভিত্তি যে দ্বিচলক সংখ্যা পদ্ধতি, শূন্য না থাকলে সেটি সম্ভব হতো না।
গণিত উচ্চতর বিজ্ঞানের ভাষা। শূন্য না থাকলে আধুনিক গণিতের যে বিস্তার ও প্রসার, এর যে হাজারোটি বিভাগ তার কিছুই এভাবে সম্ভব হতো না। গণিতের যথাযথ বিকাশ না হলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলের অন্যান্য শাখাসমূহের বিকাশ, আর যা-ই হোক, বর্তমান পর্যায়ে পৌঁছাতে পারত না। এ কারণে শূন্যের গুরুত্ব ও ব্যবহার মানব সভ্যতার ইতিহাসে অপরিসীম।
শূন্য বলতে আমরা এখন এমন একটি স্বাধীন সংখ্যা বুঝি যার নিজস্ব মান ও স্থানিক মান আছে। কোনো সংখ্যার সাথে শূন্য যোগ করলে বা বিয়োগ করলে ঐ সংখ্যার মান অপরিবর্তিত থাকে। একটি সংখ্যা হতে ঐ সংখ্যা বিয়োগ করলে বিয়োগফল শূন্য হয়। শূন্য দিয়ে কোন সংখ্যাকে গুণ করলে গুণফল শূন্য হয়। শূন্য দিয়ে কোন সংখ্যাকে ভাগ করলে অসংজ্ঞায়িত সংখ্যা হয়, কিন্তু চলকের সীমায়িত মান প্রকাশের ক্ষেত্রে তা অসীম হয়। শূন্যকে শূন্য দিয়ে ভাগ করলে অনির্ণেয় সংখ্যা হয়। কোন সংখ্যার ডানে শূন্য বসলে তার মান দশগুণ প্রাপ্ত হয়। দশমিকের আগে বা পরে প্রতিটি স্থানাঙ্কে যখনই শূন্য বসে, তা ঐ স্থানটির মান শূন্য গুণক বোঝায়। খুব মোটা দাগে এটি হচ্ছে আধুনিক গণিতের শূন্য।
মেসোপটেমিয়ার আদি ব্যাবিলনীয়রা (১৮০০ – ১৭০০ খ্রিস্টপূর্ব) ও প্রাচীন অ্যাসিরীয়রা (১৬০০ – ১১০০ খ্রিস্টপূর্ব) যে ৬০-ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবহার করত যেখানে ১ এবং ১০-এর দুটো স্বতন্ত্র চিহ্ন ছিল। বাকি সংখ্যাগুলো এই দুটোর সমন্বয়ে গঠিত হতো। আধুনিক গণিতের শূন্য বলতে যা বোঝায় তা তাদের ব্যবস্থায় ছিল না। এদের আগের আক্কাদীয় সভ্যতার (২৩৫০ – ২১০০ খ্রিস্টপূর্ব) ও সুমেরীয় সভ্যতার (৪৫০০ – ১৯০০ খ্রিস্টপূর্ব) গণিতে শূন্য নেই — অন্তত শূন্য বলতে আমরা যা এখন বুঝি তা নেই। এই সভ্যতাগুলোর কেউ কেউ বড় সংখ্যার মাঝে শূন্যস্থান দিয়ে দশগুণ বোঝাত বটে তবে সংখ্যার শেষে শূন্য ব্যবহার করত না। ফলে এই শূন্যস্থানকে ঠিকঠাক শূন্য বলার উপায় নেই।
মধ্য আমেরিকাতে চার দফায় মায়াদের রাজত্ব চলেছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে খ্রিস্টাব্দ ১৬৯৭ পর্যন্ত। মোটামুটি ১০০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে তারা ফোঁটা দিয়ে ১ ও দাগ দিয়ে ৫ বুঝিয়ে ২০-ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবহার করতো। তারা কচ্ছপের পিঠের মতো একটা চিহ্ন দিয়ে শূন্য বোঝাতো বটে তবে সেটি আমাদের বর্তমান শূন্যের মতো কোনো অংশে ছিল না। তাছাড়া মায়াদের শূন্য পুরোনো দুনিয়াতে, মানে ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকাতে, আসতে আসতে তাদের আবিষ্কারের পরে প্রায় ২,৫০০ বছর পার হয়ে গেছে। পুরোনো দুনিয়ার লোকজন ততদিনে গণিতের শূন্যকে বিজ্ঞানের চর্চায় বহু দূরে নিয়ে গেছে।
প্রাচীন মিশরীয়দের গণিতে হায়ারোগ্লিফিক দিয়ে প্রকাশিত বড় বড় সংখ্যা ছিল বটে কিন্তু স্বাধীন শূন্য ছিল না। বর্ণ দিয়ে প্রকাশিত গ্রীকদের সংখ্যায় যে শূন্য ছিল না সেটা সবার জানা। ১৫০ খ্রিস্টাব্দে টলেমির লেখা 'আলমাজেস্ট'-এ ব্যবহৃত ডিগ্রি চিহ্নের মতো যে শূন্য ব্যবহার করা হয়েছে তা স্বাধীন সংখ্যা শূন্য নয়। উল্লম্ব আর অনুভূমিক রেখা দিয়ে প্রকাশিত প্রাচীন চীনা সংখ্যাব্যবস্থায় শূন্যের জন্য আলাদা কোনো চিহ্ন ছিল না। চীনারা ১০০ খ্রিস্টপূর্ব থেকে ঋণাত্মক সংখ্যা ব্যবহার করলেও তাদের গণিতে স্বাধীন শূন্যের ব্যবহার ছিল না।
খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ – ২০০ সময়কালে সংস্কৃত পণ্ডিত ছান্দোগ পিঙ্গল ফোঁটা ও দাগ ভিত্তিক দ্বিচলক সংখ্যা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি 'শূন্য' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন শূন্য অর্থেই। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে গণিতের ওপর লেখা 'বাখশালী' পাণ্ডুলিপিতে শূন্যের ব্যবহার লক্ষণীয়। ৪৫৮ খ্রিস্টাব্দে লিখিত জৈন সৃষ্টিতত্ত্ব 'লোকবিভাগ'-এ ১০-ভিত্তিক সংখ্যা ব্যবহার করা হয়েছে যেখানে শূন্যের ব্যবহার আছে। কিন্তু এই শূন্যগুলোর কোনোটাই স্বাধীন শূন্য নয়।
৫১০ খ্রিস্টাব্দে আর্যভট্ট লিখলেন 'স্থানাত স্থানাম দশগুণম স্যত' — স্থান থেকে স্থান প্রতিটি পূর্ববর্তীর দশ গুণ হবে। এভাবে ১০-ভিত্তিক সংখ্যাব্যবস্থা কেবল সংহতই হলো না সেই সঙ্গে শ্যূন্যের মানও তৈরি হয়ে গেল। তবে তিনি সংখ্যাগুলোকে বর্ণ দিয়ে প্রকাশ করেছিলেন। সপ্তম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত শূন্যকে আরও বিস্তারিতভঅবে ব্যাখ্যা করলেন। শূন্যের জন্য ভিন্ন প্রকাশচিহ্নও নির্ধারণ করলেন।
ব্রহ্মগুপ্ত কোনো সংখ্যাকে শূন্য দিয়ে ভাগ করার ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত না দিলেও, আধুনিক গাণিতিক শূন্যের মূল চরিত্রটি তিনি সঠিকভাবে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হন। শূন্যের আধ্যাত্মিক বা দার্শনিক ব্যবহার থেকে একে দৈনন্দিন ব্যবহারযোগ্য সংখ্যায় নিয়ে আসার কৃতিত্ব আর্যভট্ট ও ব্রহ্মগুপ্তের। পরনির্ভর শূন্যকে স্বাধীন করার কৃতিত্বও এ দুই গণিতবিদের। ভারতের মধ্য প্রদেশের গোয়ালিয়র দুর্গের চতুর্ভুজ মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে সর্বপ্রথম দশমিক চিহ্ন ও তার সাথে শূন্যের ব্যবহার দেখা যায়।
আলজেরিয়ায় বেড়ে ওঠা ইতালীয় গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি (১১৭০ – ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক রচিত 'লিবের আবাচি'তে 'ভারতীয়-আরবী সংখ্যাপদ্ধতি' বর্ণনা করা হয়েছে। এভাবে তিনি ইউরোপে দশমিক পদ্ধতি তথা শূন্য নিয়ে এসেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। আরবি শব্দ 'সিফর' ইতালীয় শব্দ Zefiro (মৃদু বায়ুপ্রবাহ)-এর কাছাকাছি শুনতে বলে সেটি ভেনেসিয় উচ্চারণে Zevero হয়ে যায়, যা পরবর্তীকালে ইতালীয় ভাষায় আরেকটু সঙ্কুচিত হয়ে Zero-তে পরিণত হয়।
এ শব্দ ফরাসীদের হাত ঘুরে (Zéro) ইংরেজদের মাধ্যমে আবার Zero হয়ে যায়। ১৫৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি ভাষায় প্রথম Zero শব্দটি ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ ইংরেজি শব্দ Zero'র উৎপত্তি এ রকম: সংস্কৃত শূন্য (शून्य) > আরবী Ṣifr (صفر) > ভেনেসিয় Zevero > ইতালীয় Zero > ফরাসী Zéro > ইংরেজি Zero (0)। উৎপত্তির এই রেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, গাণিতিক শূন্যের ব্যবহার ভারতীয়দের কাছ থেকে আরবরা, এবং তাদের কাছ থেকে ইতালীয়দের মাধ্যমে ইউরোপীয়রা শিখেছে।
গাণিতিক শূন্যের প্রাথমিক ধারণার উদ্ভব দার্শনিক শূন্যতা থেকে। এভাবে মেসোপটেমীয়, ভারতীয়, মিশরীয়, বা মায়া সভ্যতায় বিভিন্ন সময়ে আলাদা আলাদাভাবে গাণিতিক শূন্যের প্রাথমিক ধারণা গড়ে ওঠে। আড়াই হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে উদ্ভূত ও চর্চ্চিত বৌদ্ধ, জৈন, বা আজীবক দর্শনের শূন্যতার ধারণা ব্যবহারিক জীবনে প্রযুক্ত হতে গেলে গাণিতিক শূন্যের প্রয়োজনীয়তার শুরু হয়। পরবর্তী হাজারখানেক বছরে একটু একটু করে গাণিতিক শূন্যের ধারণা ব্যবহারিক আকার পেতে থাকে।
এখান থেকে একটা উত্তর পাওয়া গেল যে, আধুনিক গাণিতিক শূন্যের আবিষ্কারক আর্যভট্ট। তবে আদি শূন্য বা শূন্যের ধারণার আবিষ্কারক কে বা কারা সেটা বোধহয় আর কখনোই জানা যাবে না।