খান অ্যাকাডেমি ও সাড়ে তেরো কোটি শিক্ষার্থীর একজন গণিত-গুরুর গল্প
সালমান আমিন খানের বয়স তখন বিশের ঘরে। বোস্টনের একটি হেজফান্ডে অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করতেন তিনি। নিউ অরলিন্সে বাস করা তার তুতো বোন নাদিয়া তার কাছে গণিত বোঝার আবদার করলো।
বোনের অঙ্কে একটু দুর্বলতা ছিল, তাই সালমান খান ওরফ স্যাল খান তখন টেলিফোনে নাদিয়াকে অঙ্ক শেখাতে শুরু করলেন। স্যালের কাছে পড়ে নাদিয়া গড়পড়তা স্টুডেন্ট থেকে ক্লাস টপার বনে গেল।
লুইজিয়ানার ১৫ জন তুতো ভাইবোনকে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে বীজগণিত আর ক্যালকুলাস পড়াতে শুরু করলেন স্যাল খান। পড়ানোর সুবিধার্থে নিজে একটা ওয়েবসাইট ও কিছু সফটওয়্যার তৈরি করে ফেললেন। ওই সফটওয়্যারগুলোর কাজ ছিল অনুশীলনী তৈরি করা।
এক বন্ধু পরামর্শ দিলেন তিনি ভিডিও করে ইউটিউবে আপলোড করতে পারবেন। 'আমার মনে হলো এর চেয়ে খারাপ আইডিয়া আর কিছু হতে পারে না। ইউটিউব কেবল কুকুর-বিড়ালের ভিডিও দেখার জন্য ছিল,' স্বীকার করেন স্যাল।
'তারপরও আমি তার কথায় রাজি হলাম। আমার ভাই-বোনের বললো তারা আমাকে সরাসরি দেখার চেয়ে ইউটিউবে দেখতে বেশি পছন্দ করতো, কারণ তারা চাইলেই ভিডিওগুলো বারবার দেখতে পারত আর সেখানে তাদের শেখার ওপর কোনো মূল্যায়নের ব্যবস্থা ছিল না,' বলেন স্যাল খান।
এরপর ধীরে ধীরে কঠিন সব অঙ্কের স্যালের সহজ ব্যাখ্যাগুলো পরিবারের বাইরের মানুষের কাছেও পৌঁছাতে লাগল। নাদিয়াকে শেখানো শুরু করার চার বছর পরে, ২০০৮ সালে প্রতিমাসে তার ভিডিও হাজারো মানুষ অনলাইনে দেখতে শুরু করলেন।
খান অ্যাকাডেমি
কিছুদিন পর একদিন এক কনফারেন্সে বিল গেটস জানালেন, তিনি তার সন্তানদের অঙ্ক শেখানোর জন্য খানের ভিডিও ব্যবহার করেন। তারপরই খানের পাঠগুলো ভাইরাল হয় ইন্টারনেটে। আরও কিছুদিন পরেই গুগল স্যাল খানকে তার পাঠদানের এই স্বপ্নকে বিস্তৃত করার জন্য দুই মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করে।
খান অ্যাকাডেমির হেডকোয়ার্টার্স ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত। এই অ্যাকাডেমির বর্তমানে পৃথিবীর ১৯০টি দেশ থেকে প্রায় সাড়ে তের কোটি (১৩৫ মিলিয়ন) নিবন্ধিত ব্যবহারকারী রয়েছেন। খান অ্যাকাডেমি বর্তমানে ৫১টি ভাষায় এর কার্যক্রম পরিচালনা করে।
করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর সারাবিশ্বে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এসময় খান অ্যাকাডেমির ওয়েবসাইটে মানুষ আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় কাটাতে শুরু করে। যেখানে আগে মানুষ প্রতিদিন খান অ্যাকাডেমি থেকে গড়ে ৩০ মিলিয়ন মিনিট শিখতো, কোভিডের সময় তা ৮৫ মিলিয়ন মিনিটে পৌঁছায়।
সিলিকন ভ্যালিতে খান ক্রমে একজন সুপারস্টারে পরিণত হন। সস্তা একটা ল্যাপটপ ও মাইক্রোফোন দিয়ে নিজের ঘর থেকে তার এ অলাভজনক যাত্রা শুরু করেছিলেন সালমান খান। তারপর তাকে আর কখনো পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশ্বের অনেক ধনী লোকই তার অ্যাকাডেমিকে আর্থিকভাবে সহায়তা করেছেন। এ তালিকায় আছেন এরিক স্মিদ, ইলন মাস্ক, কার্লোস স্লিম থেকে শুরু করে বিল গেটস পর্যন্ত।
স্যাল খানের ছোটবেলা ও ব্যক্তিজীবন
তবে ৪৫ বছর বয়সী সালমান খান ও তার চিকিৎসক স্ত্রী উমাইমা মার্ভি মোটামুটি সাদামাটা জীবনযাপনই করেন। এ দম্পতির রয়েছে তিন সন্তান। স্যালের গ্যারেজে কোনো ফেরারি বা টেসলা নেই, কেবল দুইটি হোন্ডা ব্র্যান্ডের গাড়ি রয়েছে। তার নেট সম্পদের পরিমাণ বিলিয়ন তো দূরের কথা কোটির ঘরেও নেই বলে জানান স্যাল।
সালমান খানের মা মাসুদা খান ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত। বাবা বাংলাদেশি চিকিৎসক ফখরুল আমিন খান। কম বয়সেই বাবাকে হারান তিনি। তার মা-ই তাকে মানুষ করে তোলেন। বেশ দারিদ্র্যপীড়িত ছোটবেলা ছিল তার।
'আমরা দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করতাম বেশিরভাগ সময়। কোনো স্বাস্থ্যবিমা ছিল না আমাদের, বেশিরভাগ সময় ডিসকাউন্টের দোকান থেকে খরচ করতে হতো আমাদেরকে,' জানান সালমান আমিন খান।
ছোটবেলা থেকেই গণিতকে ভালোবাসতেন স্যাল। নিজের স্কুলের প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-তে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন তিনি। সেখানে পড়ালেখা শেষ করে হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।
খান ল্যাব স্কুল
২০১৪ সালে খান ল্যাব স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে শিক্ষার্থীদের সশরীরে পাঠ দেওয়া হয়। এই স্কুল একটু ভিন্নধাঁচের। এখানে টিচিং-অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে শিক্ষার্থীরাই কাজ করেন। এ স্কুলে ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়সের শিক্ষার্থীরা একই ক্লাসরুমেই পড়াশোনা করে।
প্রাইভেট এ স্কুলটি নিরীক্ষামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। এ স্কুলে পড়ার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর ৩০ হাজার মার্কিন ডলার ফি দিতে হয়। গুগলসহ সিলিকন ভ্যালির অন্যান্য সফল প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের সন্তানেরা খান ল্যাব স্কুলে পড়ালেখা করে।
এ স্কুলে কোনো গ্রেডিং ব্যবস্থা বা হোমওয়ার্ক নেই। শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের গতিতে পড়ালেখা করে। অনলাইনে খান অ্যাকাডেমির বিভিন্ন পাঠ ও অফলাইনে বিভিন্ন টিচারের সহায়তা নিয়েই তারা পড়লেখা করে এখানে। এক টপিক ছেড়ে অন্য টপিকে যাওয়ার আগে অবশ্যই তাদের পূর্ববর্তী পাঠের শিখনফল প্রমাণ করতে হয়। ভিন্নধর্মী এ স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাদের সামর্থ্য প্রমাণ করে ছেড়েছে। গতবছর এ স্কুলের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা স্কুলটির পাঠ চুকিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে।
সালমান খানের লক্ষ্য হলো শিক্ষাক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন একটি মডেল তৈরি করা যেটি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে শিক্ষাকে ব্যক্তিগত করে তুলবে। ঠিক যেভাবে নেটফ্লিক্স মানুষের টেলিভিশন দেখা ও অ্যামাজন বাজার করাকে বদলে দিয়েছে, খানও চান প্রযুক্তির উৎকর্ষের ছোঁয়ায় শিক্ষাব্যবস্থাও সেভাবে বদলে যাক। খান বিশ্বাস করেন চিরায়ত ক্লাসরুম পদ্ধতি এখন আর মানুষের পরিবর্তিত মননের সাথে খাপ খায় না।
কিছুটা অসম্ভব শোনালেও স্যাল খান তার লক্ষ্যকে বাস্তবায়ন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি স্কুলহাউজ ডট ওয়ার্ল্ড নামে একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছেন যেখানে শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকের ভূমিকা পালন করে। তারা অন্য শিক্ষার্থীদের পাঠ বুঝতে সাহায্য করে। এখন পর্যন্ত এ প্লাটফর্মটিতে ১০০০ শিক্ষক ও ১০ হাজার শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছে।
খান ওয়ার্ল্ড স্কুল
বর্তমানে খান তার ভিশনকে আরও শক্তিশালী করতে নতুন আরেকটি উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি খান ওয়ার্ল্ড স্কুল নামের একটি পুরোদস্তুর ভার্চুয়াল হাই স্কুল তৈরি করছেন। বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে যে কেউ এ স্কুলে পড়ালেখা করতে সক্ষম হবে।
আগামী শরতে স্কুলটি চালু হবে। এটিতে দৈনিক সেমিনার, অক্সফোর্ডের মতো টিউটোরিয়াল ও খান অ্যাকাডেমির প্রোগ্রামের ওপর ভিত্তি করে বিশেষ ব্যক্তিগত অনলাইন শিখনের ব্যবস্থা থাকবে। এ স্কুলের খরচ চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা বাদে অন্য রাজ্যের শিক্ষার্থীদের এখানে পড়তে বছরে ১০ হাজার ও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ১২ হাজার ডলার ফি দিতে হবে।
'আমরা ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করছি। তবে এটি একসময় দুই লাখও হতে পারে। এ স্কুলের পাঠদান ব্যবস্থা দামি প্রাইভেট স্কুলের পাঠ্যক্রমের মতোই হবে,' বলেন স্যাল।
স্যাল খানের নিজের সন্তানেরাও খান ল্যাব স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের বয়স ১৩, ১০, ও সাত। তার মধ্যে বড় সন্তানটি ইতোমধ্যে ক্যালকুলাস কোর্সে শেষ করে এখন ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের সাথে পড়ছে। স্যাল বলেন, 'আমি তাকে কখনো বলিনি এত বেশি চাপ নিতে, বরং বলেছি ধীরেসুস্থে করতে। কিন্তু সে এসব নিয়ে থাকতেই পছন্দ করে। তার কাছে সময় ভালো করে কাটানোর মানে হচ্ছে অঙ্ক নিয়ে আলোচনা করা, বন্ধুদের সাথে কোডিং করা, দাবা খেলা ইত্যাদি। ও আমাকে দাবায় হারাতে পারে। বাস্কেটবলেও আমরা প্রায় একই লেভেলে আছি যদিও আমি তার চেয়ে প্রায় এক ফুট বেশি লম্বা।'
স্যাল খানের কাছে শিক্ষা সবসময় প্যাশনের মতো ছিল। হেজফান্ডে কাজ করার সময় তিনি নিজের বন্ধুদের বলতেন, 'অনেক টাকা বানানোর আগ পর্যন্ত এখানে কাজ করব, তারপর আমি নিজের স্কুল খুলে ডাম্বেলডোর বনে যাব।' অবশ্য এখন স্যাল খান নিজেকে হ্যারি পটারের ডাম্বেলডোরের চেয়ে বরং এক্স-মেন সিনেমার প্রফেসর জাভিয়ের-এর মতো বেশি মনে করেন।
সালমান খানের এখনো বিশ্বাস হতে কষ্ট হয়, কুড়ি বছর আগে কিছুটা শখের বশে নিজের তুতো ভাইবোনদের যে শেখানোর কাজটা তিনি শুরু করেছিলেন, সেটা আজ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত একটি বিষয় হয়ে গিয়েছে। সিলিকন ভ্যালির অনেক অনেক উদ্যোক্তার মতো খানের স্বপ্নগুলোও বেশ বড়। সালমান খান মনে করেন, খান অ্যাকাডেমি ও খান ওয়ার্ল্ড স্কুল দিয়ে তিনি যেসব কাজ করতে চান, যেসব স্বপ্ন পূরণ করতে চান সেগুলো মঙ্গল অভিযানের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
যুক্তরাজ্যের দ্য টাইমস থেকে সংক্ষেপে অনূদিত। মূল লেখা: র্যাচেল সিলভেস্টার