চমস্কি: যতই তথ্য দিক, কখনো মানুষের মতো গভীর আর যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করতে পারবে না চ্যাটজিপিটি
যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি, অধ্যাপক ইয়ান রবার্ট ও দার্শনিক জেফরি ওয়াটুমল চ্যাটজিপিটির সম্ভাবনা নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর পাঠকদের জন্য এটির সংক্ষিপ্ত ও পরিমার্জিত অনুবাদ প্রকাশ করা হলো।
হোর্হে লুইস বোর্হেস লিখেছিলেন, দুর্দশা ও আশার সময়ে বাস করা মানে ট্র্যাজেডি ও কমেডি দুটোর অভিজ্ঞতাই লাভ করা। আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় (এআই) আমাদের অনুমিত এ বৈপ্লবিক অগ্রগতি একই সঙ্গে উদ্বেগ আর প্রত্যাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের প্রত্যাশার কারণ, বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করেই আমরা যাবতীয় সমস্যার সমাধান করি। আর চিন্তার কারণটি হলো, আমরা ইতোমধ্যে আশঙ্কা করতে শুরু করেছি, মেশিন লার্নিং আমাদের বিজ্ঞানকে অধপাতের দিকে নিয়ে যাবে এবং আর আমাদের নৈতিকতাকে দুর্বল করে দেবে।
ওপেনএআই'র চ্যাটজিপিটি, গুগল'র বার্ড, মাইক্রোসফট'র সিডনি মেশিন লার্নিংয়ের বিস্ময়কর রূপ। এসব এআই টুল প্রচুর পরিমাণ ডেটা থেকে নির্দিষ্ট ছন্দ তথা প্যাটার্ন খুঁজে বের করে। এভাবে পরিসংখ্যানগতভাবে সম্ভাব্য আউটপুট তৈরি করতে শেখে এগুলো।
মানুষের মননের গুণগত ও পরিমাণগত উভয় দিক থেকে যান্ত্রিক মনের এগিয়ে যাওয়ার যে ভবিষ্যৎবাণী মানুষ অনেক আগে থেকে করে এসেছে, তার প্রাথমিক আভাস হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রোগ্রামগুলো।
হয়তো সেই দিনটা ভবিষ্যতে কখনো দেখতে পাবে মানুষ। বাড়িয়ে বলা খবর আর অপরিমাণদর্শী বিনিয়োগ যতই সাধারণ মানুষের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শ্রেষ্ঠত্বের সম্ভাবনা জাহির করুক না, তার সূচনা এখনো হয়নি। বোর্হেস আমাদের নিজেদের ও বিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে একটি আসন্ন প্রতিভাসের কথা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু এ অনুধাবনের উন্মোচন কখনোই ঘটবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি, যতদিন না কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে চ্যাটজিপিটির মতো মেশিন লার্নিং পদ্ধতিগুলো আসন গেড়ে বসে থাকে।
কিছু সংকীর্ণ ক্ষেত্রে (যেমন কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বা ছোটখাটো ছড়ার লাইনের জন্য) এ প্রোগ্রামগুলো যতই কাজের হোক না কেন, ভাষাতত্ত্বের বিজ্ঞান ও জ্ঞানের দর্শন থেকে আমরা এটা জানি যে, মানুষ যেভাবে বিচারশক্তিকে কাজে লাগায় ও ভাষাকে ব্যবহার করে তার সঙ্গে এ প্রোগ্রামগুলোর নিগূঢ় পার্থক্য রয়েছে। আর এ পার্থক্যগুলোর কারণেই এসব প্রোগ্রামের সক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে।
এই যে ছোট্ট একটা বস্তুর ওপর এত সময় আর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে, এটি যুগপৎ হাস্যকর ও কষ্টের। ভিল্হেল্ম ফন হুম্বোল্টের ভাষ্যে, মানুষের মন ভাষার শক্তিতে 'সীমিত উপায়ের অসীম ব্যবহার' করতে পারে। চ্যাটজিপিটির মতো এআই টুলগুলোকে মাঝেমধ্যে মানবমনের সঙ্গে তুলনা করলে কি তুচ্ছই না লাগে!
মানুষের মনন চ্যাটজিপিটি ও এর সমতুল্য প্রযুক্তিগুলোর মতো কোনো জগদ্দল পরিসংখ্যানিক যন্ত্র নয়। বরং মানবমন একটি বিস্ময়কর কার্যকরী ও চোস্ত একটি ব্যবস্থা যেটি কি-না ছোট পরিমাণ তথ্য নিয়ে কাজ করে। এটি তথ্য-উপাত্তের মধ্যে স্থূল সহ-সম্পর্ক খোঁজে না, বরং ব্যাখাসৃষ্টিতেই এর সার্থকতা।
যেমন, ছোট বাচ্চা যখন ভাষা শেখে, তখন এটি যৌক্তিক নীতিমালা ও মাপকাঠিসমৃদ্ধ ব্যাকরণের ভিত গড়তে শুরু করে। এ ব্যাকরণকে জন্মগত অভিব্যক্তি, জিনগতভাবে ইনস্টল করা 'অপারেটিং ব্যবস্থা' হিসেবে দেখা যেতে পারে। ভাষাবিজ্ঞানীরা যখন কোনো একটি ভাষা কেন কাজ করে এ বিষয়ে তত্ত্ব তৈরি করতে চান, তখন তারা সচেতনভাবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এ ব্যাকরণেরই একটি বিশদ সংস্করণ তৈরি করেন। একটি শিশু এ ব্যাকরণ সহজাতভাবেই বুঝতে পারে, সেজন্য তার খুব বেশি তথ্য জানারও প্রয়োজন হয় না। এ শিশুটির অপারেটিং ব্যবস্থা একটি মেশিন লার্নিং প্রোগ্রামের ব্যবস্থার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন।
আদতেই এ ধরনের প্রোগ্রামগুলো অবধারণগত বিবর্তনের একটি প্রাকমানব বা মানববিশ্লিষ্ট দশায় আটকে আছে। এগুলোর গভীরতম ত্রুটিতি হচ্ছে, যেকোনো বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে ক্রিটিক্যাল সক্ষমতাটি না থাকা। আর এ সক্ষমতাটি হলো কোনো কিছু কি ছিল, কি আছে, বা কি থাকবে জানানোর পাশাপাশি কি নেই এবং কি থাকতে পারত বা পারত না ইত্যাদি সম্পর্কেও বলতে পারা। এগুলোই হলো কোনো কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার উপকরণ, খাঁটি বুদ্ধিমত্তার নিদর্শন।
একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরুন আপনি হাতে একটা আপেল ধরে আছেন। ছেড়ে দিলেন, কী ঘটল দেখলেন, এবং বললেন, 'আপেলটা পড়ে গেল।' এটা হচ্ছে বর্ণনা। আর পূর্বাভাস হতে পারে 'আমি হাত খুলে ফেললে আপেলটা পড়ে যাবে।' দুটো বিষয়ই গুরুত্বপূর্ণ, আর দুটোই সঠিক। কিন্তু যখন এর সঙ্গে ব্যাখ্যা যুক্ত হবে, তখন ব্যাপারটা আরও শক্তিশালী হবে।
ওই ব্যাখ্যার মধ্যে বর্ণনা ও পূর্বাভাসের পাশাপাশি আমরা আরও পাব কাউন্টারফ্যাকচুয়াল অনুমান। এ অনুমান হতে পারে 'আপেলের মতো অন্য যেকোনো বস্তুও পড়ে যাবে' — এর সঙ্গে আরও বাড়তি তথ্য হিসেবে অভিকর্ষের কথাও আনা যেতে পারে। এটি একটি কার্যকারণসম্বন্ধ তৈরি করবে। আর এ বিষয়টিকেই আমরা বলি চিন্তন।
এ কথা অনস্বীকার্য যে মানবীয়-শৈলীতে দেওয়া কোনো ব্যাখ্যা সবসময়ই নির্ভুল হবে না। মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু এ জায়গায় এসে মানবীয় ব্যাখ্যা চিন্তার খোরাক জোগায়: কোনো কিছু সঠিক হতে হলে এর ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বুদ্ধিমত্তা কেবল সৃষ্টিশীল অনুমান থেকে তৈরি হয় না, এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে সৃষ্টিশীল সামলোচনাও। তবে চ্যাটজিপিটি ও এর মতো প্রোগ্রামগুলো সীমাহীনভাবে 'শেখা' তথা মুখস্ত করার কাজটা করতে পারে। কিন্তু সম্ভবকে অসম্ভব থেকে আলাদা করার সক্ষমতা এগুলোর নেই।
মেশিন লার্নিং সিস্টেমগুলো সবসময় অগভীর ও দ্বিধাগ্রস্ত হবে। একটি বাক্যকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এটি একই ধরনের অন্য বাক্যের অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করবে, কিন্তু বাস্তবে ওই বাক্য সম্পূর্ণ ভিন্ন কোনো অর্থও প্রকাশ করতে পারে। ভাষার সঠিক ব্যাখ্যা একটি জটিল বিষয় এবং স্রেফ বিপুল পরিমাণ ডেটা ব্যবহার করে কোনো এআই টুলকে ভাষার মর্মার্থ বোঝানো সম্ভব হবে না।
মেশিন লার্নিংয়ের স্রষ্টারা এই ভেবে গর্ব করতে পারেন যে, তাদের তৈরি যন্ত্রের সঠিক 'বৈজ্ঞানিক' সম্ভাবনা তৈরির জন্য কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এ ধরনের পূর্বাভাস সফল হলেও এগুলো সিউডোসায়েন্স বই আর কিছু নয়। প্রকৃত বুদ্ধিমত্তা নৈতিকভাবেও চিন্তা করতে পারে। আমরা নৈতিকতার বিচারে অনেক কিছুই করা থেকে বিরত থেকে আমাদের মননের নেতিবাচক সৃজনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করি। সকলের জন্য ব্যবহারোপযোগী করতে চ্যাটজিপিটিকে নৈতিকতার দ্বন্দ্ব থেকে দূরে থাকতে হয়। কিন্তু এ ধরনের সমন্বয় অর্জন করতে চ্যাটজিপিটি ও এর মতো প্রোগ্রামগুলোর নির্মাতা সবসময়ই সংগ্রাম করে এসেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন।
২০১৬ সালে অনলাইনে ব্যবহারকারীদের সরবরাহ করা খারাপ প্রশিক্ষণ ডেটার দরুন মাইক্রোসফটের টেয় চ্যাটবট নারীবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী আধেয় দিয়ে ইন্টারনেট ভরিয়ে তুলেছিল। এ সমস্যা ভবিষ্যতে কীভাবে সমাধান করা হবে? নৈতিক ভিত্তি থেকে চিন্তা করার সক্ষমতা না থাকায় চ্যাটজিপিটির প্রোগ্রামারেরা এটিকে বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে নতুন কিছু সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখছেন। এ বিতর্কিত বিষয়গুলোরও কিন্তু গুরুত্ব আছে। নৈতিক চেতনা থেকে দূরে থাকতে চ্যাটজিপিটির মতো প্রোগ্রাম সৃজনশীলতাকে বিসর্জন দিয়েছে।
নোম চমস্কি: অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ভাষাতত্ত্বের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ইয়ান রবার্ট: কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক। জেফির ওয়াটুমল: দার্শনিক এবং ওশেনিট নামক একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক কোম্পানির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচালক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।