চীনের সামরিক সহায়তা চায় রাশিয়া, এই চুক্তিতে চীনও যেভাবে লাভবান হবে
আগামী সপ্তাহেই রাশিয়া যেতে পারেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সফরের পরিকল্পনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বরাতে সোমবার (১৩ মার্চ) একথা জানায় বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
ইউক্রেন যুদ্ধের অবসানের লক্ষ্যে চীনের ঘোষিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে আলোচনা করতেই এ সফর বলে জানানো হয়েছে। ফলে আগে যেমনটা ধারণা করা হয়েছিল, তার আগেই হতে চলেছে এ সফর।
এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি রুশ বার্তাসংস্থা তাস এজেন্সি জানায়, পুতিন বসন্তকালে শি জিনপিংকে তার দেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এরপর মার্কিন দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এপ্রিল বা মে মাসের শুরুতে এই সফর হতে পারে।
সফরের নতুন সময়সূচি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ক্রেমলিনও একই প্রতিক্রিয়া দেয় রয়টার্সকে।
এদিকে ফেব্রুয়ারির শেষদিকে গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে বাইডেন প্রশাসন অভিযোগ আনে যে, চীন অস্ত্র, গোলাবারুদ ও ড্রোন দিয়ে রাশিয়াকে সাহায্য করার কথা ভাবছে। এসময় আরো বলা হয়, চীনের সামরিক ত্রাণ ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সরাসরি সহায়তা দেবে।
ঘটনাপ্রবাহ বেশ উত্তেজক সন্দেহ নেই তাতে, মার্কিন সরকার এ তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশের এক মাসেরও কম সময় আগে – গুপ্তচরবৃত্তিতে ব্যবহার করা হয়েছে এমন সন্দেহে চীনা বেলুনকে গুলি করে নামায় মার্কিন যুদ্ধবিমান। এতেই দুই দেশের মধ্যে বাগযুদ্ধ তুঙ্গে উঠেছিল, তারপরই আসে সমর সহায়তার অভিযোগ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের মাটিতে সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা চলছে ইউক্রেনের মাটিতে। কিন্তু, প্রথম মহাযুদ্ধের মতোই এই সংঘাতে যেন জড়িয়ে পড়েছে আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিগুলো। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইউক্রেনকে সামরিক, আর্থিক, গোয়েন্দা তথ্য, প্রশিক্ষণ, কূটনৈতিকসহ সব ধরনের সমর্থন দিচ্ছে। অন্যদিকে, এই যুদ্ধে রাশিয়াকে সীমিতভাবে সহায়তা দিয়েছে ইরান। চীন ও ভারত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও জ্বালানি বাণিজ্য অব্যাহত রেখে মস্কোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করছে এটা ঠিক– কিন্তু তারা এই সংঘাতে সরাসরি রাশিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি।
ফলে রাশিয়া একাই লড়ছে ইউক্রেনের হত্যাক্ষেত্রে, বহু রুশ সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম এরমধ্যেই হারিয়েছে মস্কো। এসব ক্ষতি পোষাতেই বিদেশি মিত্রদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে ক্রেমলিন।
এর আগে রাশিয়া ঐতিহ্যগত মিত্র উত্তর কোরিয়া ও বেলারুশের কাছ থেকে সামরিক সহায়তা নিয়েছে। আবার এই যুদ্ধে নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়া চীন ও রাশিয়ার কাছেও সাহায্য চেয়েছিল। শেষোক্ত এই দুটি দেশের কাছেই বিপুল তেল ও গ্যাস বিক্রি করছে মস্কো।
এই বাস্তবতায়, রাশিয়াকে সামরিক ত্রাণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত কখনোই প্রকাশ্যে জানায়নি বেইজিং।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু- চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা। গবেষণার সূত্রেই ধারণা করছি, চীনের যেকোনো প্রকার সহায়তাকে রাশিয়া অভিনন্দন জানাবে। তাই বলে অসতর্ক নয় চীন, ইউক্রেন যুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে– বেইজিং খুবই সতর্কভাবে বিভিন্ন হিসাবনিকাশ করবে। সংঘাতে জড়ানোর দীর্ঘমেয়াদি সুফল, ঝুঁকি ও পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাব– এসব বিষয়ে গভীরভাবে আগে বিশ্লেষণ করবে।
তবে আমার মতে, দুটি বিষয় বিবেচনায় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করা হবে কিনা– সে সিদ্ধান্ত নেবে বেইজিং। প্রথমত, এই যুদ্ধের ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীনের উত্থানে কী প্রভাব পড়বে; আর দ্বিতীয়ত, তাইওয়ানে আগ্রাসন চালাতে বেইজিংয়ের আগ্রহ।
চীনের আনুষ্ঠানিক অবস্থান কী?
যুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টা করছে এমন সেনাবাহিনীকে বিপুল সামরিক সহায়তা দেওয়া বেশ ব্যয়বহুল। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সালে ইউক্রেনকে ৭৫ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। এই বিপুল ব্যয় জড়িত থাকার পরও কিছু কারণে রাশিয়াকে সমরাস্ত্র দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে চীন।
অর্থনৈতিকভাবে রাশিয়ার থেকে যেসব সুবিধা নিতে চায় বেইজিং, তারমধ্যে আছে জ্বালানি ও অন্যান্য বাণিজ্যের সম্ভাবনা। সামরিক সহায়তা নেওয়ার বিনিময়ে– মস্কো চীনের ইউয়ানকে রাশিয়ার প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা করবে এমন সুপ্ত বাসনা তো রয়েছেই।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে মস্কো ও বেইজিংয়ের মধ্যে বিভেদের দেওয়াল তুলতে সক্ষম হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, তারপর থেকেই অর্থনৈতিকভাবে আরো সম্পৃক্ত হতে থাকে চীন-রাশিয়া। সম্পর্কেও আসে উষ্ণতা।
এরপর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া আগ্রাসন চালায় ইউক্রেনে। এই সংঘাত নিয়ে চীন রাশিয়ার পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করলেও কিছুটা নিরপেক্ষ অবস্থানেই রয়েছে। এর অর্থ, চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে এই সংঘাতে সরাসরি অংশ নিচ্ছে না। যদিও বেইজিংয়ের কর্মকর্তারা যুদ্ধ নিয়ে রুশ সরকারের যে ভাষ্য, তারই প্রতিধ্বনি করছেন। একইসঙ্গে, অস্বীকার করছেন ইউক্রেন সরকারের বক্তব্য।
রুশো-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমা হস্তক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে চীন। সংঘাত নিরসনে একটি শান্তি প্রস্তাবও দিয়েছে। তবে এই প্রস্তাবে ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের বিষয়ে কোনো আহ্বান নেই।
এক কথায়, কূটনৈতিকভাবে মস্কোকে সমর্থন দিলেও, কেবল অস্ত্র সাহায্যই এখনও দেয়নি বেইজিং। এখন তা করার সিদ্ধান্ত নিলে যা হবে দেশটির আগের নিরপেক্ষতার নীতি থেকে সরে আসার ঘটনা।
একই শত্রু
ইউক্রেনে রাশিয়ার সাফল্য হবে চীনের বিশ্ব রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্যকে নতুন রূপ দেওয়ার লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে অর্থনীতি ও সামরিক খাতে নেতৃত্ব দানকারী পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের পথও সুগম হবে।
যুদ্ধ শুরুর আগেই ফেব্রুয়ারিতে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকে শি জিনপিংয়ের সাথে দেখা করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিশ্ব রাজনীতিকে নতুন রূপদানের এক যৌথ বিবৃতিও জারি করেন তারা। দীর্ঘ ওই বিবৃতিতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বহীন বিশ্বই চীন ও রাশিয়ার লক্ষ্য, যে বিশ্ব ব্যবস্থায় মস্কো ও বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিপত্তি আরো শক্তিশালী হবে।
চলতি মার্চের ২ তারিখেও বৈঠক করেছেন উভয় দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। এরপর চীন সরকারের দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, 'উভয় দেশের সম্পর্কে নিশ্চিত ও ক্রমাগত অগ্রগতি হয়েছে। এতে প্রধান দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের নতুন উদাহরণ তৈরি হয়েছে'।
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা চীন ও রাশিয়া কাউকেই গণতান্ত্রিক বা রাজনৈতিক বিধিনিষেধমুক্ত রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে গণ্য করেন না। তবে উভয় দেশই দাবি করে, নিজস্ব ব্যবস্থার গণতন্ত্রের চর্চা তাদের রয়েছে। একইসঙ্গে, যে বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সংজ্ঞা নির্ধারণ করছে তারই বিরোধিতা করছে দুই দেশ।
()
তাইওয়ান ইস্যু
ইউক্রেনে রাশিয়ার সফলতা কামনার পেছনে চীনের আরেকটি কারণ হলো– এতে তাইওয়ানসহ অন্যান্য ভূখণ্ডকে অধিকারে বাহ্যিক সমর্থন লাভ করবে বেইজিং। চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে অদূরে অবস্থিত তাইওয়ান দ্বীপ নিজেকে স্বার্বভৌম দেশ হিসেবে দাবি করে। কিন্তু, গণচীনের মতে, তাইওয়ান একটি বিদ্রোহী ভূখণ্ড মাত্র, যার ওপর সে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
রাশিয়া যদি তার প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুসারে ইউক্রেনে দ্রুত জয় অর্জন করতে পারতো, তাহলে চীনও হয়তো একইভাবে তাইওয়ানে আগ্রাসনের উদ্যোগ নিত। কিন্তু, পশ্চিমা হস্তক্ষেপের কারণে রাশিয়ার বিজয় বিলম্বিত হচ্ছে।
রুশো-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে তাদের অর্থ, সামরিক সম্পদ বিপুলভাবে ইউরোপে নিয়োজিত করতে হচ্ছে। এটা চীনের জন্যও নতুন সুযোগও তৈরি করেছে, কারণ ওয়াশিংটন এখন তাইওয়ানের নিরাপত্তায় অখণ্ড মনোযোগ দিতেও পারছে না।
গত ৭ মার্চ চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাং মতপ্রকাশ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু তাইওয়ানের কাছে অস্ত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে, তাই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনও রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির অনেক সমালোচক মনে করেন, ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর মাধ্যমে তাইওয়ানের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। চীন যদি দ্বীপটিকে দখলে নেওয়ার উদ্যোগ নেয়- তাহলে এই সমস্যা আরো জটিল হবে।
আপাতত নিকট ভবিষ্যতে চীন তাইওয়ান দখল করবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, এই পদক্ষেপ চীনের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়েরই তাইওয়ান এবং আশেপাশের অঞ্চলে ব্যাপক স্বার্থ রয়েছে।
তারপরও দক্ষিণ চীন সাগরে আরো সামরিক উপস্থিতি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। চীন তাইওয়ানের আশেপাশের এলাকায় তার সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। অন্যদিকে, সম্প্রতি তাইওয়ানের কাছে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ফিলিপাইনে সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এক কথায়, যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা করা বা বিশ্বের অন্যপ্রান্তে ব্যতিব্যস্ত রাখার সুযোগ চীন ছাড়বে না। অন্তত নিজে কোণঠাসা বোধ করলে তেমন রাস্তাতেই চলতে পারে বেইজিং। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে চীনের বিপুল অর্থনৈতিক সম্পর্ক এতে মুখ থুবড়ে পড়বে, হয়তো সেকারণেই এপর্যন্ত সংযত রয়েছে দেশটি। কিন্তু, অতীতে বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ প্রায়শই স্বল্পমেয়াদি বিবেচনার চেয়ে অগ্রাধিকার পায়। রাশিয়ার যুদ্ধে চীনের যোগদানের ক্ষেত্রেও একই সমীকরণ কষবে বেইজিং।