যুক্তরাষ্ট্র কি রাশিয়াকে ক্রমাগত বুঝতে ভুল করছে?
রাশিয়া একটি বিশ্বশক্তি, যার পারমাণবিক অস্ত্র সম্ভার কেবল যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই তুলনীয়। সে দেশেরই শাসক বদলে ফেলার ইচ্ছে কোনোপ্রকার রাখঢাক ছাড়াই প্রকাশ করে চমকে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বিচারের মুখোমুখি করারও অঙ্গীকার করেন।
বাইডেনের এসব বক্তব্যে বিস্ময়ের চেয়ে একটি বিষয় সুস্পষ্ট। তা হলো- রাশিয়াকে ক্রমাগত ভুল বুঝে চলেছেন আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) নীতিনির্ধারকরা; যার হাত ধরেই ইউক্রেন যুদ্ধের সূচনা। আবার একারণেই যুদ্ধ বন্ধে যা করা দরকার – তা করার উৎসাহ নেই মার্কিন কর্মকর্তাদের।
আমি শুধু একজন মার্কিন পর্যবেক্ষক – প্রয়াত আরভিং ক্রিস্টলের কথা বলতি পারি, যিনি ১৯৯০ এর দশকের শুরুতেই সঠিক পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। আজকের সংঘাত যেসব ঘটনার হাত ধরে জন্ম নিয়েছে সেগুলো সম্পর্কে তিনি আগেই সতর্ক করেন। ক্রিস্টল বলেছিলেন, হঠকারী সামরিক সহায়তা বা হস্তক্ষেপের চেয়ে "আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে আরো ধৈর্য্যের সাথে অপেক্ষার নীতি দরকার"। ১৯৯৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে তিনি এই উপসংহারে পৌঁছানোর কারণও তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "পূর্ব ইউক্রেনের দেশগুলিকে ন্যাটোতে যুক্ত করে একটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা রাশিয়ার কোনো শাসকগোষ্ঠীই মেনে নেবে না। সৌভাগ্যক্রমে, সদ্য স্বাধীন দেশগুলোকে উদারভাবে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়া হোক তা পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও কাম্য নয়। রাশিয়ার সীমিত সাম্রাজ্যবাদী রূপ আছে। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর উদয় হওয়া ১৪টি জাতিরাষ্ট্রে প্রভাব বিস্তারের মধ্যেই সে আকাঙ্ক্ষা সীমিত।"
রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতার বিচারে পুরোপুরি এই প্রভাব বিস্তার ১৪ দেশের মধ্যে কোনোটিতেই করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন ক্রিস্টল। ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত ইউক্রেনের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাবেক সোভিয়েতভুক্ত এই দেশগুলি রাশিয়ার আধা-সুরক্ষাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে (যদি পশ্চিমা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না হয়)। তবে আগের চেয়ে তাদের স্বাধীনতা বেশি থাকবে।
এভাবেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিষয়ে গভীর অন্তর্দৃষ্টি রাখতেন তিনি।
লিখেছেন, "১৯৫৪ সালে ক্রিমিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনীয় রিপাবলিককে (তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ) দেন ক্রুশ্চভ। অথচ ক্রিমিয়া উপদ্বীপের বেশিরভাগ অধিবাসী হলো রাশিয়ান। ১৯৯৪ সালের এক গণভোটে তারা ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার রায়ও দিয়েছে।"
১৯৯৪ সালের ২৭ মার্চ ক্রিমিয়ার আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ তিন পর্যায়ে এই গণভোটের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালে ক্রিমিয়ান সুপ্রিম কাউন্সিলের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপটে এই গণভোটের মাধ্যমে জনরায় নেওয়া হয়। কিন্তু, তৎকালীন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক একে অবৈধ বলে ঘোষণা করেন।
ইউক্রেন রাষ্ট্র অস্বীকার করলেও, ৮০ শতাংশ ক্রিমিয়াবাসী স্বাধীনতার জন্য ইউক্রেনের সাথে আলোচনা শুরুর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, রাশিয়ার ক্ষমতার দিগন্তে পুতিনের উদয় হওয়ার আগেই এই ঘটনা ঘটেছে।
ক্রিস্টল বলেন, ইউক্রেনীয় সরকার বিভিন্নভাবে ভুল করছে রাজনৈতিক সমীকরণে, এতে পূর্বাঞ্চলে (এবং দক্ষিণেও) রুশ-ভাষাভাষী বৃহৎ সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী (এসব অঞ্চলে সংখ্যাগুরু) ক্ষুদ্ধ হয়। এর প্রেক্ষিতে তিনি উপসংহার টানেন যে, "রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শক্তির প্রদর্শন অনিবার্য, যেখানে রাশিয়াই জিতবে।"
এই বিজয়ের ফলে "(ইউক্রেনসহ) ১৪ রাষ্ট্রের ওপর সুরক্ষাধীন অঞ্চলের মতোন করে শর্ত আরোপ করবে রাশিয়া। কারণ, আরো কয়েক ডজন বসনিয়া (জাতিগত নিধনযজ্ঞ বোঝাতে বলা) এড়ানোর মতো অবস্থানে একমাত্র রাশিয়াই রয়েছে; যেহেতু এই ভারসাম্য ব্যাহত হলে রাশিয়ান ফেডারেশনের অধীন বহুজাতিক সহাবস্থানেরও অবনতি ঘটবে। তাই এটা তাদের করতেই হবে।"
পরবর্তীকালে আমরাও দেখেছি, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে রাশিয়া বারবার রুশ-ভাষাভাষীদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হওয়ার কথা বলেছে।
গত কয়েক দশক ধরে অনেক অর্থনীতিবিদ বলে আসছেন, রাশিয়ার মতোন ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না। এর ভিত্তিতে, দুনিয়ার সর্বত্র ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ নীতিকে ভুল বোঝা হয়েছে – আমেরিকার অভ্যন্তরীণ নীতির ক্ষেত্রে এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতির বিষয়েও।
এই প্রেক্ষাপটে সংঘাত অবসানে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়া কী করতে পারে?
ক্রিস্টল অতি-সক্রিয় 'অ্যাক্টিভিস্ট' ধাঁচের নীতি গ্রহণের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন, তার পরামর্শ ছিল যেখানে আপাতদৃষ্টিতে কোনো সমাধান নেই, সেখানে উচিত পরিস্থিতির সঠিক ব্যবস্থাপনার চেষ্টা। তার সাথে আমি এটুকুই যোগ করতে চাই যে, দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি অর্জন করতে হলে পশ্চিমা দুনিয়ার উচিত ইউক্রেনকে যথেষ্ট সমর্থন দেওয়া (যাতে আলোচনায় দর কষাকষির ক্ষমতা তার থাকে) এবং ক্রিমিয়াসহ পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা উদ্ধারের বিষয়টি থেকে সরে আসা। একইসঙ্গে, রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলে ফেরাতে আরো অগ্রণী কিছু পদক্ষেপও নেওয়া দরকার।
রাশিয়াকে আকস্মিক শিক্ষাদানের নীতিগত ভুল যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের ক্ষেত্রেই প্রথম করেছে এমন নয়। ৪০ বছরের বেশি সময় আগেও একই ভুল করেছিল। যার ফলাফল শুভ হয়নি। নীতি নির্ধারণের বিতর্কে সে সময়ে আমারও সামান্য ভূমিকা ছিল। আমাকেও মতামত দিতে বলা হয়েছিল। রাশিয়ার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ইগোর গাইডারের সাথে এনিয়ে আলোচনাও করেছি।
আমার জীবনের প্রথম ১৫ বছর কেটেছে কম্যুনিষ্ট শাসনের অধীনে। আমার বাবা-মা দুজনকেই কোনো অভিযোগ ছাড়া গ্রেপ্তারও হতে হয়েছিল, (যদিও পরে তাদের দ্রুত মুক্তি দেওয়াও হয়)। তারপরও আমার বিস্ময়ের সীমা ছিল না যখন আমি দেখি পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত জনপ্রিয় এক পাঠ্যপুস্তকের লেখক হলেন পল স্যামুয়েলসন। যিনি বইটিতে লিখেছেন, সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে "বেশিরভাগ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে এমন ধারণা পোষণ করা অশ্লীল-রকম ভুল"।
বইটির ১১তম সংস্করণে অশ্লীল শব্দটিকে বাদ দেওয়া হয়, আর ১২ তম সংস্করণে বাক্যটিই বাদ পড়ে। তার বদলে একটি প্রশ্ন যোগ করা হয়: "কম্যুনিষ্ট শাসনের অর্থনৈতিক অর্জন কী রাজনৈতিক দমনের বিনিময়ে সমর্থনযোগ্য?"
তবে সুশাসন বা মানব প্রকৃতি সম্পর্কে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এই অধ্যাপকের অন্তর্দৃষ্টিতে ঘাটতি ছিল। তারপরও ১৯৭০ সালে তিনি 'ফান্ডামেন্টালস অব ইকোনমিক অ্যানালাইসিস' নামক বইটির জন্য অর্থনীতিতে নোবেল পান। যদিও বইটিকে গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত গাণিতিক পুস্তক ছাড়া বিশেষ কিছু বলে মনে করার কোনো কারণ নেই।
১৯৯০ সালে এমআইটিকে অনেক শিক্ষাবিদ সতর্ক পরামর্শ দেন, তাদের শিক্ষাক্রমে স্যামুয়েলসনকে না রাখতে। কারণ তাদের মতে "তিনি বস্তুনিষ্ঠ ও পরিপক্ক কেউ নন"। তিনি অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের চেয়ে রাজনৈতিক মতবাদেই বেশি দুষ্ট।
বিষয়টি অকপটে স্বীকার করার জন্যও স্যামুয়েলসনকে কৃতিত্ব দিতেই হয়। ১৯৯০ সালে তিনি লেখেন, "রাষ্ট্রের আইন কারা লেখেন বা জটিল চুক্তিগুলো কারা প্রণয়ন করছেন তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই – যদি সেটা আমি অর্থনীতির পাঠ্যপুস্তকে লিখতে পারি।"
এই কাজটি তাকে বিনা বাধায় করতে দেয় এমআইটি। আর রাজনীতিবিদেরা তাকে আলোচনার কেন্দ্রে আনেন। এর মাধ্যমে সরাসরি এই ইঙ্গিতই দেন যে, অভ্যন্তরীণ হোক বা পররাষ্ট্র – সবক্ষেত্রেই সমস্যার সমাধান কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সরকার ব্যবস্থার মধ্যে নিহীত– এই দাবির 'বৈজ্ঞানিক' ভিত্তি রয়েছে।
স্যামুয়েলসনের প্রভাব রাজনীতিতে গভীরভাবে পড়েছে সন্দেহ নেই। তবে সেটা আলঙ্কারিক। কিন্তু, ইউক্রেনের ক্ষেত্রে মার্কিন নীতি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে যারা পররাষ্ট্র চুক্তি প্রণয়নের সাথে জড়িত – তারা স্যামুয়েলসনের পর্যবেক্ষণে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে গুরুতরভাবে রাশিয়ান রাজনীতির ভুল পাঠ নিয়েছেন।
রাশিয়ায় শাসনব্যবস্থা এখনও ততোটাই কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত, যতোটা ছিল সমাজতান্ত্রিক শাসনের অধীনে। যেমন গুপ্ত পুলিশকে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারাই পরিচালনা করেন। সরকার ব্যবস্থায় শুধু পদবি আর সংগঠনের নাম বদলেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আজো আমলাদের চেয়ে অভিজাত ক্ষমতাধরদের প্রতি বেশি অনুগত।
নাম বদলালেও, পুতিনের রাশিয়াকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চেয়ে জার-শাসিত রাষ্ট্রের সাথেই বেশি তুলনা করা যায়। এক কথায়, শাসকগোষ্ঠীর বদল হলেও কেন্দ্রীয়করণ ও রাশান উচ্চাকাঙ্খা একই রয়ে গেছে।
রাশিয়াকে দ্রুতই বদলে ফেলা সম্ভব – পশ্চিমাদের এমন ধারণা তাই নির্ঘাত ভুল। ভুল এটাও যে আকস্মিক আঘাতেই রাশিয়াকে পরিবর্তনে বাধ্য করা যাবে। স্যামুয়েলসনের শিক্ষারই ফলস এ চিন্তাধারা, যেহেতু তিনি মনে করতেন রাশিয়ার চিরন্তন ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ পশ্চিমাদের জন্য কোনো সমস্যা নয়।
- লেখক: রিউভেন ব্রেনার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটস অধ্যাপক। তিনি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটিরও একজন সম্মানীয় সদস্য।