ফিনল্যান্ড, সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়ার জন্য পরাজয়ের শামিল?
'এত রাশিয়ান! এদেরকে আমরা কোথায় গোর দেব?' উইন্টার ওয়ারে ফিনিশ সেনাবাহিনীর খুব সাধারণ একটি কৌতুক ছিল এটি। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হওয়া উইন্টার ওয়ার রাশিয়া ও ফিনল্যান্ড দুটো দেশের জন্যই একটি স্থায়ী স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রায় সাড়ে সাত লাখ সৈন্য নিয়ে ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে, যেখানে ফিনল্যান্ডের জনসংখ্যাই ছিল ৩৭ লাখ। এরপরেও ফিনল্যান্ডের ভয়াবহ প্রতিরোধের মুখে পড়ে প্রায় দেড় লাখ সৈন্য নিহত আর অর্ধেক সেনাবাহিনী খুইয়ে ফিনল্যান্ডকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয় সোভিয়েত রেড আর্মি। ফিনল্যান্ডের আয়তনের প্রায় নয় শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়ন দখল করে নেয়। সাথে নিয়ে যায় ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে শিল্পসমৃদ্ধ শহর ভাইবর্গ।
ফিনল্যান্ড সেই হারানো ভূমি ফেরত পাবার চেষ্টা করেনি সেভাবে। কিন্তু তাদের জাতীয় মানসে রয়ে গেছে সে আগ্রাসনের স্মৃতি। এ কারণেই ফিনল্যান্ডের ৭৪ শতাংশ নাগরিক দেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত — ইউরোপে যা সর্বোচ্চ। আর রাশিয়ার কারেলিয়াতে আছে বিষাদের ক্রুশ — যা উইন্টার ওয়ারে প্রাণ দেওয়া সোভিয়েত সৈন্যদের স্মরণে নির্মাণ করা হয়েছে।
ইউরোপের আরেক দেশ সুইডেন পুরো সপ্তদশ শতক জুড়েই ছিল উত্তর ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য। তাদের সাম্রাজ্যের সূর্য ডুবে যায় সম্রাট দ্বাদশ চার্লসের আমলে রাশিয়া আক্রমণের মাধ্যমে। রাশিয়ান ভূমি যেকোনো আগ্রাসী শক্তির জন্য গোরস্থান — এটা নেপোলিয়ন বা হিটলারের আগে টের পেয়েছিলেন দ্বাদশ চার্লস। এখনো স্টকহোমে তার ভাস্কর্য বাম হাত তুলে রাশিয়ার দিকে নির্দেশ করে; সুইডিশদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে রাশিয়া তাদের রাষ্ট্রের জন্য হুমকি।
ঐতিহাসিকভাবে রাশিয়ার কাছে পরাজয়ের পর ফিনল্যান্ড আর সুইডেন দুই দেশই সরকারিভাবে নিরপেক্ষ নীতি বজায় রেখে চলেছে। ঘরের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সুপারপাওয়ারকে ঘাঁটাতে চায়নি কেউই। ইউরোজোনে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পরেও সামরিক ক্ষেত্রে কোনো সহযোগিতায় তারা যায়নি। দেশদুটি নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে কেবল। তবে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন সব হিসেবনিকেশ পালটে দিয়েছে। এখন ফিনল্যান্ড ও সুইডেন ন্যাটোতে যোগদান করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে, এবং তাতে পালটে যাচ্ছে রাশিয়ার সকল সমীকরণ।
গত বছরের ১৮ মে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড একত্রে ন্যাটোতে যোগদানের আবেদন জানায়। গত ১ মার্চ ফিনল্যান্ডের সংসদে ১৮৪-৭ ভোট ব্যবধানে দেশটির ন্যাটোতে যোগদান করার আইন পাস হয়। সামনের মাসে ফিনল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তার আগেই এ আইন পাস সম্পন্ন হলো। আর গত ২২ মার্চ সুইডেনের পার্লামেন্টে ২৬৯-৩৭ ভোটে ন্যাটোতে যোগদানের আইন পাস হয়। এর ফলে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাকি থাকছে মাত্র একটি বাধা — ন্যাটোর প্রতিটি সদস্যের অনুমতি। ন্যাটো গঠনতন্ত্রের ১০ নম্বর ধারা অনুযায়ী সদস্যপদ প্রত্যাশী প্রতিটি দেশকে ন্যাটোর প্রতিটি সদস্যরাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হবে। সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ গ্রহণে প্রথমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তুরস্ক ও হাঙ্গেরি। ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে দুটো দেশই তাদের অনাপত্তি জানিয়েছে, কেবল সুইডেনকে অনাপত্তি জানায়নি তুরস্ক। এখন সুইডেনকে ছাড়াই ন্যাটোতে যোগ দিতে যাচ্ছে ফিনল্যান্ড। আশা করা যাচ্ছে, মে মাসের মধ্যে সুইডেনও যোগ দেবে।
নিরপেক্ষতার ইতিহাস
১৯৪৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্বাক্ষরিত 'ট্রিটি অভ ফ্রেন্ডশিপ, কো-অপারেশন, অ্যান্ড মিউচুয়াল অ্যাসিসট্যান্স' (এফসিএমএ) অনুযায়ী ফিনল্যান্ডকে পরাশক্তিদের মাঝে বিবাদ থেকে দূরে থাকতে হতো। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ঘাঁটিগুলো তাদের বাধ্য করেছিল এ চুক্তি মেনে চলতে। এ কারণে ফিনল্যান্ড মার্শাল প্ল্যানেও অংশ নিতে পারেনি। ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত সামরিক ঘাঁটিগুলো সরিয়ে নেওয়া হয় এবং ফিনল্যান্ড জাতিসংঘে যোগ দিতে সক্ষম হয়। এরপর থেকে ফিনল্যান্ড যথেষ্ট নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছে।
ওদিকে সুইডেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলেও সরাসরি কোনো জোটে প্রবেশ করেনি। তাদের ভয় ছিল, ন্যাটোতে যোগদান করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশি ফিনল্যান্ডে আগ্রাসন চালাবে। পঞ্চাশের দশকে সুইডেন বেশ উদ্যমের সাথে নিজস্ব নিউক্লিয়ার প্রোগ্রাম চালিয়ে গেছিল; কিন্তু আমেরিকার বাধা ও উচ্চব্যয়ের জন্য ষাটের দশকে তা পরিত্যাগ করা হয়। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকার সাথে ভালো খাতিরও বজায় রেখেছিল দেশটি। তবে সরকারিভাবে নিরপেক্ষ হওয়ায় আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেশটি বেশকিছু ভূমিকা পালন করে।
২০০৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে মিউচুয়াল সেলফ ডিফেন্স চুক্তিতে প্রবেশ করে সুইডেন, যার মাধ্যমে প্রায় দুইশ বছরের সামরিক নিরপেক্ষতা ত্যাগ করে দেশটি।
ন্যাটোতে যোগদানের প্রভাব
সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের ফলাফল রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত খারাপ সংবাদ। এটা তাদের ইউরোপের সকল রণাঙ্গন থেকে সরে যেতে বাধ্য করবে। এবং ভবিষ্যতে ন্যাটোর সাথে কোনো সংঘাতের খায়েশ পুতিনের থাকলে, সেটাও শেষ হয়ে যাবে। এর কারণ হলো সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের ভৌগোলিক অবস্থান ও সামরিক বাহিনী রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
ফিনল্যান্ডের রাশিয়ার সাথে ১৩৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে, যার বেশিরভাগই অনেক হৃদ ও জঙ্গল দিয়ে ভর্তি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর কোনো দেশের রাশিয়ার সঙ্গে এত দীর্ঘ সীমান্ত নেই। ফিনল্যান্ডের সেনাবাহিনী অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতো আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল না। তাদের শক্তিশালী সামরিক শিল্প ও রিজার্ভ ফোর্স আছে। ফিনল্যান্ড অত্যন্ত দ্রুত সেনাবাহিনী ও রিজার্ভ মোতায়েন করতে পারে।
ফিনল্যান্ডের সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত সৈন্য আছে দুই লাখ ৮০ হাজার। আর রিজার্ভে আছে নয় লাখ। ফিনল্যান্ডের বিমানবাহিনীতে ৬৪টি মার্কিন এফ/এ-১৮ বিমান আছে, একইসাথে তারা লকহিড মার্টিনের কাছ থেকে ৬৪টি এফ-৩৫ বিমান কিনছে। তাদের আছে প্রায় পনেরশ কামান আর একশ রকেট লঞ্চিং প্ল্যাটফর্ম।
একইসাথে দেশটির ছয়মাসের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও খাদ্যশস্য রিজার্ভে রাখা আছে, ওষুধ কোম্পানিগুলো তিন থেকে দশ মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সকল বিদেশি ওষুধ মজুত করে রেখেছে। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি শহর শত শত টানেল আর বাংকার দ্বারা পূর্ণ। ফিনল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থাও অত্যন্ত কার্যকর।
ফিনল্যান্ডের ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক মন্ত্রী টিট্টি টুপ্পুরানিয়েন মন্তব্য করেছিলেন, 'আমরা এরকম পরিস্থিতির (রাশিয়ার আগ্রাসন) জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে প্রস্তুতি নিয়েছি, আমাদের সমাজকে প্রস্তুত করেছি। আমাদের এটা বিস্মিত করেনি।'
সুইডেনের নিরপেক্ষতা যদি রাজনীতির অংশ হয়, ফিনল্যান্ডের জন্য তা অস্তিত্বের প্রশ্ন — এমনটা মন্তব্য করেছিলেন ফিনিশ ঐতিহাসিক হেনরিক মেইনান্ডার। তিনি বলেছিলেন, সুইডেন ন্যাটোতে অংশ নেওয়া নিয়ে তর্ক করতে পারে, কারণ তারা ফিনল্যান্ড ও বাল্টিককে রাশিয়ার মাঝে বাফার জোনে রেখেছে।
এ প্রসঙ্গ উঠেছে, কারণ সুইডেনের ন্যাটো জোটবিরোধী অংশের মত হলো, এত দিন ধরে নিরপেক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে সুইডেন যেভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মধ্যস্থতা করেছে, এখন থেকে আর তা এটি পারবেনা।
তবে সুইডেনের নিজস্ব সামরিক শক্তি কোনো অংশে কম নয়। ১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে সামরিক বাহিনীকে ছোট করে আনে দেশটি, তবে এখন ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি সামরিক বাহিনীর বাজেট ৪০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সুইডেনের মূল শক্তি তার বিমানবাহিনী। সুইডিশ সাব গ্রিপেন যুদ্ধবিমান অত্যন্ত কার্যকর, এবং এগুলো হাইওয়েতে অবতরণ ও টেক-অফ করতে পারে। কাজেই বিমানঘাঁটির দরকার হয় না। আর সম্প্রতি সুইডিশ বিমানবাহিনীর প্রধান ম্যাটস হেলগেসন দাবি করেন, রাশিয়ান সুখোই যুদ্ধবিমান ধ্বংস করার ক্ষেত্রে আমেরিকান বিমানের দামি স্টেলথ প্রযুক্তি ছাড়াই গ্রিপেন বিমানের 'ব্ল্যাকবেল্ট' আছে। আর সুইডেনের নৌবাহিনী বাল্টিক সাগরের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী। তাদের গটল্যান্ড-ক্লাস ডিজেল সাবমেরিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নন-নিউক্লিয়ার সামেরিন। এছাড়া তাদের সাইবার ওয়ারফেয়ার ইউনিটও অত্যন্ত দক্ষ।
তবে এসবের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ দেশ দুটির ভৌগোলিক অবস্থান।
সুইডেনের দ্বীপ গটল্যান্ড রাশিয়ার জন্য মাথাব্যথার কারণ। গটল্যান্ড ১০০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপ, যা রাশিয়ান বাহিনী তাদের ছিটমহল কালিনিনগ্রাদ থেকে দখলে নিতে পারে।
একারণে সম্প্রতি গটল্যান্ডে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে সুইডেন। বাল্টিক সাগরের এ গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ ন্যাটোর বিমান ও জাহাজের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ফরোয়ার্ড বেইজ হতে পারে। কাজেই গটল্যান্ড থেকে সহজেই ন্যাটো কালিনিনগ্রাদকে আক্রমণ করতে পারবে, এবং বাল্টিক সাগরের তীরের ন্যাটো দেশগুলোকে সহায়তা করতে পারবে।
ন্যাটোর জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল তাদের বাল্টিক সদস্য দেশগুলোকে রাশিয়ান আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। রাশিয়ান আগ্রাসনের মুখে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া। ন্যাটোর সাথে তাদের একমাত্র সংযোগ কালিনিনগ্রাদ ও বেলারুশের মাঝখানে মাত্র সত্তর কিলোমিটার চওড়া সুভালকি করিডোর। দুইপাশ থেকে রাশিয়ান সেনাবাহিনী সহজেই বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারত বাল্টিক দেশগুলোকে। কিন্তু এখন সুইডেন ও ফিনল্যান্ডের মাধ্যমে সহজেই বাল্টিক দেশগুলোকে সাহায্য করতে পারবে ন্যাটো।
রাশিয়ার জন্য বিরাট মাথাব্যথার কারণ হবে তার বাল্টিক ফ্লিট। রাশিয়ার বাল্টিক ফ্লিট কালিনিনগ্রাদের বাল্টিইস্ক বন্দরে স্টেশন করা। এ ফ্লিট দিয়েই রাশিয়া বাল্টিক সাগরে তার নৌবাহিনীকে সচল রাখে। এখানে আছে ৪৩টি জাহাজ আর একটি কিলো-ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন।
এখন গালফ অব ফিনল্যান্ড ও ডেনিশ প্রণালী দুটোই ন্যাটোর দখলে চলে গেলে তাদের বাল্টিক ফ্লিটের যাবার জায়গা আর থাকবে না। পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে সেটা। আর বাল্টিক সাগরের দখল রাখতে না পারলে রাশিয়ার জন্য এ অঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে যাবে। তখন বাল্টিক সাগর দিয়ে রাশিয়া বাণিজ্যিক বা সামরিক; কোনো অপারেশনই চালাতে পারবে না। পাশাপাশি রাশিয়ার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর সেন্ট পিটার্সবার্গের প্রতিরক্ষাও দুর্বল হয়ে যাবে।
রাশিয়ার জন্য আরেকটি বিশাল মাথাব্যথার কারণ হবে কোলা উপদ্বীপ। কোলা উপদ্বীপ রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তার পারমাণবিক শক্তির জন্য। কোলা উপদ্বীপে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্র। এখানে রয়েছে মারমানস্ক — রাশিয়ার আর্কটিক সার্কেলের একমাত্র বন্দর যা শীতে জমে যায় না। এ উপদ্বীপের সেভেরোমর্স্ক বন্দরে রাশিয়ান নর্দার্ন ফ্লিট স্টেশন করা। এ ফ্লিট রাশিয়ার নৌবাহিনীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একইসাথে এটা তাদের নিউক্লিয়ার ডিটারেন্সের সেন্টার। এখানে রয়েছে ২০টি সাবমেরিন, যার বেশিরভাগই পারমাণবিক, এবং রাশিয়ান নৌবাহিনীর চতুর্থ প্রজন্মের বোরেই এবং ইয়াসেন ক্লাস সাবমেরিনের প্রায় সবগুলোই এ ফ্লিটে। সামনের দিনগুলোতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আর্কটিক সার্কেলে আরও নতুন নতুন রুট তৈরি হবে, তখন সেভেরোমর্স্ক বন্দরের গুরুত্ব আরও বাড়বে।
এর পাশেই আছে পেসেৎস্ক কসমোড্রোম, যেখান থেকে রাশিয়া তার ইন্টার-কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল (আইসিবিএম) উৎক্ষেপণ করে। কোলা উপদ্বীপে আরও রয়েছে ৫০টি নিউক্লিয়ার ও কনভেনশনাল আইসিবিএম ধারণ করার বাংকার। এখানের ওকোলনায়া উপসাগরে রয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ডিপো। এ অঞ্চলে রয়েছে রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি বিমানঘাঁটি, যেখানে রাখা আছে রাশিয়ার স্ট্র্যাটেজিক বোমারু বিমান।
অর্থাৎ রাশিয়ার ঘরের কাছে ন্যাটো নিশ্বাস ফেলছে এখন। আরও খারাপ খবর হলো, কোলা উপদ্বীপের সাথে রাশিয়া মেইনল্যান্ডের সংযোগ একটি মাত্র রোড অ্যান্ড রেল হাইওয়ে দিয়ে — ৭০০ কিলোমিটার দীর্ঘ আর-২১ টুইন হাইওয়ে। ফিনল্যান্ডের সীমান্তের একদম কাছে এই হাইওয়ে, অর্থাৎ ফিনল্যান্ড চাইলেই এখানে স্যাবোটাজ চালিয়ে কোলা উপদ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারে। একইসাথে কোলা উপদ্বীপের নৌঘাঁটি থেকে রাশিয়ান নিউক্লিয়ার সাবমেরিন আর অবাধে উত্তর সাগর, আর্কটিক মহাসাগর হয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে বের হতে পারবে না। তাকে ফিনল্যান্ড ও নরওয়ের নৌঘাঁটি পার হয়ে আসতে হবে, যেখানে থাকবে ন্যাটোর প্রতিরক্ষা।
তবে রাশিয়ার শক্তি সম্পর্কে ভালোমতই অবগত আছে ফিনল্যান্ড। কাজেই ফিনল্যান্ড সম্ভবত ন্যাটোতে যোগ দিয়ে নরওয়ে মডেল অনুসরণ করবে, যেখানে তাদের দেশে ন্যাটোর মিলিটারি বেইজ বা পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করতে দেবে না তারা। কারণ ফিনল্যান্ড বা সুইডেন অযাচিতভাবে রাশিয়াকে চটাতে চায় না।
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া
রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক নয়। ২০২২ সালের মে মাসে দেশদুটি সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সতর্কবার্তা প্রেরণ করেন: ফিনল্যান্ড বা সুইডেনে ন্যাটো সামরিক স্থাপনা তৈরি করলে রাশিয়াও উপযুক্ত জবাব দেবে। রাশিয়ান সংবাদমাধ্যমের বরাতে জানা যায়, মস্কোর সাথে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে হেলসিংকি ও স্টকহোমের।
তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশখাবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেন, 'ফিনল্যান্ড বা সুইডেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়া নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই, যেমনটা আছে ইউক্রেনকে নিয়ে। কারণ আমাদের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ নেই। তারা ন্যাটোতে যুক্ত হতে চাইলে হতে পারে। এটা তাদের বিষয়। তারা যা খুশি করতে পারে। কিন্তু সামরিক ঘাঁটি বা সেনা মোতায়েন করা হলে, আমরাও একইভাবে জবাব দেব এবং যারা আমাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরাও তাদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াব।
গত ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই শোইগু বলেন, 'রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি এবং ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে জোটকে সম্প্রাসারিত করায় আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে সেনা সমাবেশ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।'
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের শত বছরের নিরপেক্ষতা ভেঙে ন্যাটোতে যোগদান করা রাশিয়ার জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল। রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল ন্যাটোর সম্প্রসারণ থামানো, নিজের সীমান্তকে সুরক্ষিত করা। উলটো এখন তাদের পড়শি দেশগুলো ন্যাটোতে যোগদান করছে। এর ফলে রাশিয়া যদি ইউক্রেনকে পরাস্ত করতেও পারে, সার্বিক দৃষ্টিতে তাদের পরাজয়ই হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।