নারী কেন ভূমির মালিক নন, কৃষিকাজ করেও কেন কৃষক নন?
কাগজি খাতুনের বাড়ি পঞ্চগড়ের একটি গ্রামে। স্বামী একজন কৃষক, যার সামান্য কিছু জমি আছে। কৃষিকাজে তাকে সহায়তা করার জন্য ২/৩ জন সহকারি থাকলেও কাগজিকে তাদের সাথে অষ্টপ্রহর থাকতে হয়, কাজও করতে হয়। কাগজির ২০/২৫টা হাঁস আছে, আছে কিছু মুরগি, ৪টি ছাগল ও ২টি গাভী। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম, কাগজি আপনি কৃষিকাজে কিভাবে সহায়তা করেন? মানে কী কী কাজ করেন?
কাগজি বললেন, সংসারের কাজ করার পাশাপাশি তিনি আবাদ পরবর্তী সব কাজ করেন। যেমন, গবাদিপশুর দেখাশোনা, দুধ আহরণ, ছাগলের চাষ, বাড়ির ভেতরের সবজি বাগান এবং বীজ সংরক্ষণের মতো জরুরি কাজগুলো তিনিই করেন। এছাড়া জমি তৈরি, চারা রোপণ, সার দেওয়া, কীটনাশকের ব্যবহার, বীজ তৈরি, শস্য জমি থেকে বাড়িতে নেওয়া, ফসল ভাঙানো, বাছাই ও প্যাকেটজাত করার প্রক্রিয়ার সাথেও তিনি জড়িত।
এতসব কাজ করার জন্য কাগজি কি কোন টাকা পান? অর্থাৎ কাগজির কি কোন আয় হয় এই কাজ থেকে? নাকি জমিতে তার কিছু মালিকানা আছে? কাগজি বললেন, না কোন মালিকানা নেই এবং তিনি কোন পারিশ্রমিকও পান না। তিনি মনে করেন এগুলো সব সংসারের কাজ। এইসব কাজের জন্য লোক রাখলে আরো অনেক টাকা খরচ হবে। তাই উনিই কাজগুলো করেন।
ডিমের জন্য নারী হাঁস মুরগি পালন করেন। কিন্তু এই ডিম বাজারে বিক্রি করেন পরিবারের পুরুষ সদস্য। আয়টাও চলে যায় তার হাতেই। নারীর শ্রমটা অমূল্যায়িতই থেকে যায়। ডিম উৎপাদন করা পর্যন্ত জটিল কাজটা নারী করলেও, সেটা অনুৎপাদনশীল কাজ। বাজারে যখন এটা বিক্রি করছেন পরিবারের পুরুষটি, তখন সেটা হয়ে যাচ্ছে উৎপাদনশীল কাজ।
গ্রামীণ নারীকে কাজ করতে হয় মূলত 'পারিবারিক শ্রমিক' হিসেবে। কাজেই তাদের আয়ের পরিমাণ খুব সামান্যই রয়ে গেছে। কৃষিতে মজুরিযুক্ত কাজে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৫ শতাংশের কাছাকাছি। গ্রামীণ নারীর সম্পদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ তাদের স্বামী গ্রহণ করেন এবং এই টাকা ব্যয় করার অধিকারও তাদের নেই। ফলে এই কাজে নারীর যে শ্রম ও সময় ব্যয় হলো, তা অবমূল্যায়িতই থেকে গেল (তথ্যসূত্র: কৃষিতে নারীর কাজের মূল্যায়ন)।
কৃষি বিশেষজ্ঞ ও সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বলেছেন, চাল উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়াটি অর্থাৎ বীজ বপণ থেকে ঘরে ধান আনা পর্যন্ত ২৩টি ধাপের। এই ২৩টি ধাপের মধ্যে ১৭টি ধাপের কাজ করেন নারী। অন্যভাবে বলা যায় দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির প্রয়োজন মেটান মূলত নারী। অথচ এই কাজগুলোকে 'সংসারের কাজ' মনে করেন পরিবারের ও সমাজের সবাই এমনকি নারী নিজেও।
গ্রামীণ নারীর কাজের পরিধি বিচার করে কীভাবে আমরা তাদের অবদানকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারি, সে বিষয়ে চিন্তার সময় এসেছে। নারীর অমূল্যায়িত ও অস্বীকৃত কাজের মূল্যায়ন করতে গেলে কৃষিতে নারীর কাজের এই হিসাবটাকেও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ঢাকার বাইরে, বিশেষ করে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পূর্ব দিকে গেলে দেখা যায় দুইপাশের জমিতে অসংখ্য নারী কাজ করছেন। এরা কিন্তু জমির মালিক নন, যথেষ্ট মজুরিপ্রাপ্ত শ্রমিকও নন, এদের অনেকেই নিজের জমিতেই কাজ করছেন। দেশে মোট ৫ কোটি ৬৭ লাখ কর্মজীবি মানুষের মধ্যে শতকরা ৪৭.৬ জন কৃষিকাজের সাথে জড়িত। আবার এদের মধ্যে শতকরা ৬৪.৮ জন নারী। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা জমির মালিক নন।
কৃষিকাজের বড় অংশে নারী কাজ করলেও কৃষাণী হিসেবে কোন স্বীকৃতি নেই, তেমনি নেই জমির মালিকানা। বাংলাদেশে ৯৬ শতাংশ জমির মালিক পুরুষ, কেবল চার শতাংশ জমির মালিকানা নারীর। কিন্তু এই চার শতাংশই সমাজের ধনী শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত নারীদের। দরিদ্র ও প্রান্তিক নারীদের জমির ওপর কোনো অধিকার নেই। যদিও বিপুল সংখ্যক নারী কৃষি শ্রমের সঙ্গে জড়িত, কিন্তু জমির মালিক না হওয়ায় কৃষক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি নেই।
প্রান্তিক পর্যায়ের নারীরা তাদের স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে রাষ্ট্রীয় অনুদানে জমির মালিকানা পেতে পারেন। তবে একজন নারী বা বিধবা নারীদের জমির মালিকানা পেতে পুত্র সন্তান থাকার শর্ত আছে, যা নারীর প্রতি সুস্পষ্ট বৈষম্য (তথ্যসূত্র: অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট)।
২০২২ সালে পাঁচটি বেসরকারি সংস্থার ফোরাম 'ফরমাল রিকগনিশন অফ দ্যা ওম্যান'স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক' এর উদ্যোগে একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে শতকরা ৯১.৩ জন অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন এবং এদের শতকরা ৯৬.৭ জন নারী।
নারীর অস্বীকৃত কাজের হিসাব করতে গিয়ে সরকারকে প্রত্যক্ষভাবে জানতে হবে যে ধান উৎপাদন, গবাদিপশু পালন, হাস-মুরগি পালন এবং মাছ চাষে নারীর কাজ কতটা? গ্রামীণ নারী তাদের কাজের কতটা উৎপাদনশীল কাজে এবং কতটা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করেন? টেকসই উন্নয়নে ভূমি ও কৃষিতে নারীর সমান অধিকার হওয়া উচিৎ।
কৃষিতে নারী যে শ্রম দেন, সেই তুলনায় বেশিরভাগই পুরুষের তুলনায় অনেক কম বা খুব নামমাত্র মজুরি পান। তাই আমরা চাই নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে যাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মস্থলে পুরুষ ও নারীর সমান মজুরি নিশ্চিত করা হয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কৃষি কাজ করলেও তাদের কঠোর পরিশ্রম স্বীকৃত নয়।
ভূমির অধিকার ও নিঃশর্তভাবে ভূমির ওপর নারীর প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নারী শ্রমিকদের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। নারীর উৎপাদিত পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত, বাজার পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত এবং নারীদের জন্য প্রযুক্তিগত ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদ প্রাপ্তির অধিকার শুধু পরিবারে না, সমাজেও নারীর অবস্থান নির্দেশ করে। নারী সম্পদের প্রকৃত মালিকানা পান খুবই কম। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীরা সাধারণত পরিবারের অন্য সদস্যদের অনুগ্রহে বেঁচে থাকেন। তাই নারীদের ভূমি অধিকার নিশ্চিত করা জন্য সম্পদের মালিকানায় লিঙ্গ সমতা আনতে হবে।
ভূমিতে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশে বৈশ্বিক ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে খুব সম্প্রতি শুরু হয়েছে 'নারীর ভূমি অধিকার নিশ্চিতে দাঁড়াই একসঙ্গে'। উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সম-অধিকার, সরকারি খাসজমি বিতরণ, ভ'মি অধিকার, বাজার অর্থনীতি বা জমি কেনা ও লিজ গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের যতটুকু অধিকার পাওয়ার কথা, তা তারা পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীর অধিকারহীনতা চরম আকার ধারণ করেছে বলেই বেসরকারি সংস্থা এএলআরডি এই প্রচারাভিযান শুরু করেছেন।
২০১৪ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ৭০ ভাগ নারীর সম্পদের ওপর মালিকানা নেই। ফলে তারা পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ওপর যেমন নির্ভরশীল থাকেন, তেমনি নিজেরা কিছু করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এক শতাংশের সম্পদ থাকলেও পরবর্তীতে তারা তা হারিয়েছেন। ২৯ ভাগ নারী সম্পদের মালিক হয়েছেন উত্তরাধিকার সূত্রে।
নারী উদ্যোক্তা ও শ্রমিকদের ৮২ শতাংশ জানান, তাদের সম্পদে নিজের অধিকার বা মালিকানা নেই। অধিকাংশ নারীই নিজের সম্পদ ব্যবহারে কোনো মতামতও দিতে পারেন না। মাত্র ২৬ শতাংশ নারী মতামত দেওয়ার সুযোগ পান।
সম্পত্তিতে নারীদের সমানাধিকার নিয়ে নানা সময় বিভিন্ন সংগঠন দাবি তুললেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। দেশে সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রশ্নে সার্বজনীন বা সিভিল আইন নেই। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন আইন আছে, প্রথাগত আইনসহ সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীর জন্য সমানাধিকারের ব্যবস্থা নেই।
সরকার নারীর অস্বীকৃত কাজকে তুলে ধরে ত জিডিপিতে যোগ করার কথা বলেছে। আমরা প্রত্যাশা করি কৃষিতে গ্রামীণ নারীর অস্বীকৃত কাজকেও তাদের কাজের 'শ্রম ঘণ্টা বা টাইম ইউজ সার্ভে'র মাধ্যমে নিয়মিতভাবে তথ্য উপস্থাপনের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। তাদের এই কাজগুলো উৎপাদনের জাতীয় হিসাবের বাইরে থাকে।
উৎপাদনের জাতীয় হিসাবের ভেতরে ঢুকানোর জন্য বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে বাংলাদেশে কৃষি কাজের কতটা নারীর দ্বারা সম্পাদিত হয়? পরিবারের কতটা খাবারের যোগান দেন নারী? গ্রামীণ শ্রম বাজারে নারী কতটা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন? বিবিএস পরিসংখ্যানে গ্রামীণ নারীর কাজকে কি ঠিকমতো তুলে ধরা হয়েছে? একথা কি বলা যায় গ্রামীণ পুরুষরা লাভের আশায় কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন এবং নারীরা অর্থমূল্য ছাড়া কৃষি-ব্যবস্থাপনায় মূল চালিকাশক্তি হতে চলেছেন? মোদ্দা কথা গ্রামীণ নারী কাজের কতটা সময় উৎপাদনশীল কাজে এবং কতটা অনুৎপাদনশীল কাজে ব্যয় করেন?
তাই আমরা আশা করবো খুব তাড়াহুড়ো না করে নারীর অমূল্যায়িত কাজের হিসাব এমনভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিৎ, যাতে শহর ও গ্রামের কোন নারীর কাজই হিসাব থেকে বাদ না পড়ে।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী