আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে, আপনার খরচও যাবে কমে
আবেগের সাথে খরচের একটা ইতিবাচক কো-রিলেশন আছে। আপনি যখন আবেগে উদ্বেলিত, প্রচণ্ড আনন্দে যখন উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল, তখনও সেটা আপনার খরচকে প্রমোট করে। আবার যখন আপনি আবেগিকভাবে সাংঘাতিক 'ডাউন' থাকেন, যখন খুব স্ট্রেসড আউট থাকেন, মন ভীষণ খারাপ থাকে, তখনও সেটা আপনার খরচকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
আমরা জানি, দুই ধরনের ইমোশন (আবেগ) আছে। একটা হচ্ছে পজিটিভ ইমোশন, বা ধনাত্মক আবেগ, আর একটা হচ্ছে নেগেটিভ ইমোশন বা ঋণাত্মক আবেগ। আপনি যখন আবেগ আক্রান্ত হন তখন আপনার যুক্তিবাদী মন অতটা কাজ করে না। কিন্তু খরচের সাথে আপনার লজিক্যাল মাইন্ড এর সম্পর্কটা খুব দরকার। কারণ আপনি যদি বেহিসাবিভাবে খরচ করেন, তাহলে আপনার যে পরিকল্পনা, আপনার যে বাজেটিং এগুলো সব ছাড়িয়ে যাবে। বাজেটের চাইতে আপনি বেশি খরচ করে ফেলবেন। সেই জন্য বলা হচ্ছে যে, যখন আপনি খরচ করবেন তখন আপনার মনটা যেন নিরপেক্ষ থাকে। তাহলে আপনার খরচ নিয়ন্ত্রিত হবে।
আর তা যদি না হয় তাহলে আপনার খরচ আপনার ইমোশন দ্বারা তাড়িত হবে। দি জার্নাল অব ইকোনমিক সাইকোলজি একটা গবেষণা করেছে। সেখানে তারা দেখেছে যে, যখন আপনি খুব ইমোশনালি ডাউন থাকেন, তখন আপনার নিজের ওপর থেকে আস্থা (সেলফ স্টিম) কমে যায়। তখন আপনার মুড ভীষণ খারাপ হয়, তখন ঐ মুডকে ভাল করার জন্য আপনার জিনিসপত্র কিনতে ইচ্ছে করে। ফলে তখন প্রয়োজন না হলেও শুধু মুড ভালো করার জন্য আপনি জিনিসপত্র কিনতে থাকেন। মজার ব্যাপার হল মুড ভাল করার জন্য যা যা কিনলেন, সেই জিনিসপত্রগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার আপনার চাহিদা বা নিডস নয়, ওগুলো আপনার ইচ্ছা বা ওয়ান্টস। আপনি নিজের উপর পরীক্ষা করে দেখুন, খেয়াল করবেন যে এটা আসলেই ঘটে।
আবার যখন আপনি প্রচন্ড স্ট্রেসড আউট থাকেন, তখন আপনার মন চাইবে এই চাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে। এই স্ট্রেস বা চাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনেকে অনেক রকম কাজ করেন। কেউ দৌড়ান, কেউ হয়তো ঝিম মেরে বসে থাকেন, কেউ হয়তো গিটার বাজান, কেউ হয়তো গান করেন, কেউ লিখেন, কেউ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেন, কেউ অনেক দূরে গাড়ি চালিয়ে চলে যান। এক একজনের আচরণ কিন্তু এক এক রকম। অনেকে আছেন যখন তারা খুব স্ট্রেসড আউট থাকেন, হতাশার মধ্যে থাকেন, তখন তারা শপিংয়ে বের হন। যেহেতু মনটা তখন লজিক্যাল থাকে না, যেটা ইচ্ছা সেটা কিনতে থাকেন এই ভেবে যে মনটা ভাল হবে, স্ট্রেস কেটে যাবে। কিন্তু পরে মন শান্ত হলে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে সে অনেক জিনিস কিনেছে যা তার আদৌ লাগবে না।
যখন আপনি খুব ডাউন ফিল করছেন, তখন আপনার সেলফ স্টিম নিচে নেমে যাচ্ছে। তখন আপনার মুড ভালো করার জন্যে আপনি নিজেকে পুরস্কৃত করতে চাইবেন। এখন পুরস্কৃত করা কী? তখন মনে হবে এত কষ্ট করে আমি আয় করি, আমি কিছু দামি জিনিস খাই, কিছু ভাল জিনিস কিনি, একটা দামি রেস্টুরেন্টে খাই অথবা খুব দামি শপিং সেন্টারে যাই, একটা ব্র্যান্ডেড কিছু কিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখবেন যেটা আপনি কিনছেন এটা হয়তো আপনার আগেও আছে, বা এটার বিকল্প অনেক কিছু আপনার আছে, যা দিয়ে আপনি চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু আপনি বেশি টাকা দিয়ে এগুলো কিনলেন।
যেহেতু আমরা বাজেট করতে বলছি। এই বাজেট যদি আপনি দেখেন, তখন দেখবেন যে বাজেটের বাইরে আপনি জিনিস কিনে ফেলেছেন। আপনার যেহেতু আয় সীমিত তাহলে এগুলো আপনার বাজেটকে ঝামেলায় ফেলবে। তখন আপনার সঞ্চয় ভাঙতে হবে, অথবা আপনার ঋণ করে এই বাজেটের অন্যান্য খরচগুলো চালাতে হবে।
আবার জীবনের অনেক ক্ষেত্রে দেখবেন আপনার খুবই একা লাগছে। মনে হচ্ছে আশেপাশে কেউ নাই, বন্ধুবান্ধব নেই, পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা করছে না, আপনার যার সাথে প্রেম ছিল, সে প্রেমটা হয়তো ব্রেকআপের পর্যায়ে চলে গেছে ইত্যাদি। এই যে মাঝে মাঝে প্রচন্ড একা লাগে তখন কিন্তু একা লাগা থেকে মানুষ বের হয়ে আসতে চায়। মেয়েরা এই সময় বিশেষত মেকওভারের জিনিসপত্র কিনতে প্রলুব্ধ হয়। ছেলেরা বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডা দেয় বা অনেক দূরে কোথাও চলে যায়, যেখানে গেলে তার ভাল লাগবে। একাকীত্ব লাগবে না এরকম একটা জায়গা খুঁজে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার জন্য দেখেন পরিবহন ব্যয়, যা যা কিনবেন সেগুলার ব্যয়। আবার যদি শপিং সেন্টার এ ঢুকেন তাহলে সেখানে কিছু কেনাকাটা হয়ে গেল। এগুলো আপনার বাজেটের পুরা বাইরে। ফলে আপনি অতিরিক্ত খরচ করে ফেলছেন।
খেয়াল করে দেখেন আপনি কিন্তু নিডসের দিকে খেয়াল করছেন না। আপনি ওয়ান্টসের দিকে খেয়াল করছেন, ভালো লাগার জন্য কিনছেন। এটা আপনার জীবনে হয়তো খানিকটা ভ্যালু অ্যাড করছে, আপনার ক্ষণিক আনন্দ দিচ্ছে কিন্তু আপনার তেমন কোন কাজ হচ্ছে না, পকেট থেকে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।
আরেকটা পয়েন্ট বলি, যখন আপনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। এরকম সময় দেখবেন, আপনার মনে হবে যে, আমি সিনেমা হলে যাই। মানে কোথায় গেলে ভালো লাগবে, এগুলো খুঁজতে থাকেন। তখন সিনেমা হলে আপনি গেলেন। একা যেতে আপনার ভাল লাগবে না। সাথে আরেকজন বন্ধুকে নিবেন। তাহলে দুইজন মিলে সিনেমা হলে গেলেন। যাওয়ার জন্যে যাতায়াত ভাড়া হচ্ছে। টিকিটের জন্য দু'জনের খরচ আছে। তারপরে ওখানে দেখবেন যে, সিনেমা হলে বাইরের খাবার দাবার নেওয়া যায় না। ভেতর থেকে খাবার দাবার কিনতে হয়। সেই খাবার দাবার কেনার একটা খরচ আছে। আবার ফিরে আসা সবকিছু মিলিয়ে দেখবেন যে, দুই-তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এই দুই-তিন হাজার টাকা কিন্তু আপনার বাজেটের মধ্যে ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে আপনার মেজাজ খারাপ হওয়ার কারণে এটা হয়েছে। তাহলে এক্ষেত্রেও কথা হচ্ছে যে, আপনার যদি মেজাজ খারাপ না হতো, আপনি যদি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, আবেগকে যদি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারতেন, তাহলে কিন্তু আপনার এই বাইরেও যাওয়া লাগতো না, অতিরিক্ত খরচও আপনার হতো না।
আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু কখনো বলছি না সিনেমা দেখা যাবে না, খরচ করা যাবে না। কিন্তু এটা আপনার পরিকল্পনার মধ্যে হতে হবে। কারণ আমরা নেমেছি, আর্থিকভাবে স্বাধীন হওয়ার উদ্দেশ্যে। তাই যদি হয় আমাদের লক্ষ্য, তাহলে অনেক দিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের অনেক আত্মত্যাগ করতে হবে, অনেক খরচকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এবং আয় বাড়তে হবে, সঞ্চয় বাড়তে হবে, বিনিয়োগ বাড়তে হবে।
তারপরের পয়েন্ট হচ্ছে যে, আপনি ভীষণ আনন্দিত। ধরুন আপনি প্রমোশন পেয়েছেন, নতুন প্রেমে পড়েছেন, আপনার বেতন বেড়েছে, ইনক্রিমেন্ট হয়েছে, আপনি নতুন চাকরি পেয়েছেন; এরকম বিভিন্ন কারণে, দেখবেন যে আপনার মন উড়ছে, আপনি প্রচন্ডভাবে খুশি। তাই খুশিকে সেলিব্রেট করতে হবে। যেকোনো উদযাপন তো আপনি একা একা করতে পারবেন না। কিছু লোকজন লাগবে। তো তাদের নিয়ে যখন এই খুশি আপনি সেলিব্রেট করছেন, তখন দেখবেন যে পকেট থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। আমরা যেটা ভুল করি, সেটা হচ্ছে আমাদের যখন আয় বাড়ে তখন আমরা খরচও বাড়িয়ে দেই। এইটা কিন্তু ঠিক নয়। আপনার আয় বাড়লে বর্ধিত যে আয়, সেটাকে আপনি সঞ্চয় করবেন অথবা বিনিয়োগ করবেন।
সামনের মাসে বেতন বাড়বে বলে আমরা এ মাস থেকে খরচ শুরু করি। এই দিকে আপনাকে নজর দিতে হবে। প্রথমে একটা বাজেট করে সেই বাজেটকে অনুসরণ করতে হবে। সেই বাজেটে যদি আপনার মাসে ৩০ হাজার টাকা খরচ করতে হয় তাহলে তাই করতে হবে, ৩১ হাজার নয়। ইনকাম যদি হঠাৎ করে ৫০ হাজার টাকা বেশি হয়ে যায় বা কারো কাছে টাকা পেতেন সেই টাকাটা যদি হঠাৎ করে আপনার পকেটে চলে আসে, তবে সেই টাকাটা খরচ করা যাবে না। সেই টাকাটা কোন নিরাপদ জায়গায় রাখুন। তাই বলা হচ্ছে যে, যখনই আপনি অতি আবেগীয় অবস্থার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন তখন আপনার খরচের মাত্রাটা বেড়ে যাচ্ছে, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যতগুলো ইস্যুর কথা আমি বললাম, সবগুলোর সাথে খরচ জড়িত। আমাকে একটা মাত্র পথ দেখান, যেটার সাথে আপনার খরচ জড়িত নয়।
আপনি কি একবারও ভেবেছিলেন, আপনার মন খুব খারাপ, আপনার আয় করা দরকার, বা আপনি খুব একাকী বোধ করছেন, আপনার আয় করা দরকার, কিংবা আপনি হতাশার মধ্যে আছেন, আপনার আয় করা দরকার- আপনি কিন্তু একবারও ভাবেন নি! আপনি ভেবেছেন আপনার খরচ করা দরকার। আরে বাবা আপনি যদি এত খরচ করবেন তাহলে সেই টাকাটা আসবে কোত্থেকে!! এই খরুচে মানসিকতা আপনার পকেট থেকে টাকা বের করার জন্য সবসময় ব্যস্ত থাকছে, আপনার কিন্তু সবসময় টাকার আউট ফ্লো হচ্ছে, ইন ফ্লো হচ্ছে না। আমাকে অনেকেই বলেন, আরে ভাই জীবনে কি কোন আনন্দ করবোনা, আপনি সবসময় টাকা সঞ্চয় করতে বলেন। আমার বক্তব্য হচ্ছে অবশ্যই করবেন, আপনার টাকা আপনিই খরচ করবেন কিন্তু পরিকল্পনার মধ্যে করবেন, পরিকল্পনার ঊর্ধ্বে গিয়ে নয়।
প্রকৃতপক্ষে যখন আপনার আর্থিক জ্ঞান থাকছে, টাকার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান আপনার থাকছে তখন আপনি সব ঠিকভাবে করতে পারছেন। আর যখন তা থাকছে না তখনই সব গণ্ডগোল। তাই আপনার প্রয়োজন আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত জ্ঞান অর্জন।
এই লেখার মাধ্যমে আমার অনুরোধ, যখন আপনি মানসিকভাবে আক্রান্ত, আবেগীয় অবস্থার মধ্যে আছেন তখন কোন খরচের মধ্যে যাবেন না। মন শান্ত হোক, তারপর আবার খরচ করা যাবে। সবাই ভাল থাকুন, সাথে থাকুন।
(লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশীপ ইন্টারন্যাশনাল
ইমেইল: [email protected])
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।