পুতিনের মিত্র এরদোয়ান কেন পশ্চিমের দিকে ঘেঁষছেন?
কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে সম্প্রতি ঘটে গেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বদলে গেছে বেশ কিছু পুরনো হিসেব নিকেশ। সৃষ্টি হয়েছে নতুন সংকট। জুলাইয়ের শুরু থেকেই একের পর এক ঘটনায় বদলে গেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের অবস্থা।
ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনস্কি ইস্তাম্বুলে গত ৭ জুলাই তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে 'ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ' নামক শস্য চুক্তির সম্প্রসারণ এবং পারস্পরিক স্বার্থের অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দেখা করেন। ২০১৬ সালে শস্য চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ১৮ জুলাই তার মেয়াদ শেষ হত।
এই চুক্তির মাধ্যমে ইউক্রেন ৫৫ লাখ টন গম, ভুট্টা ও বার্লি তুরস্কে রপ্তানি করার অনুমোদন পায়। একই সাক্ষাতে এরদোয়ান ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাবকে সমর্থন করার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, "নিঃসন্দেহে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার যোগ্য।" জেলেনস্কি এরদোয়ানকে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার্থে সুস্পষ্ট অবস্থান নেওয়ায় ধন্যবাদ জানান।
ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান নিয়েই ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু হয়েছিল। তুরস্ক ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানকে সমর্থন করার মাধ্যমে স্পষ্টত পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ নিয়েছে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে তুরস্ক তার অবস্থান আরো এক দফা বাড়িয়ে দেয় এরপরে। জেলেনস্কির সাথে সাক্ষাতের পরদিন তুরস্ক ২০২২ সালের মে মাসে গ্রেফতার হওয়া আজোভস্টাল স্টিল প্ল্যান্টের পাঁচজন কমান্ডারকে ফিরিয়ে দেয়, যারা রুশ বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হবার পর তুরস্কের জিম্মায় ছিলেন।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন যাবত সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান আটকে ছিল তুরস্কের ভেটোর কারণে। কিন্তু সম্প্রতি এরদোয়ান সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান সমর্থন করেছেন। গত ১১ জুলাই তুরস্ক সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদের জন্য আবেদনের প্রতি সমর্থন জানায়। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসন শুরু হবার পর থেকেই সুইডেন ও ফিনল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হওয়ার আবেদন করছিল। তুরস্ক ফিনল্যান্ডের সদস্যপদ গ্রহণে সমর্থন জানানোর ফলে ফিনল্যান্ড ২০২৩ সালের এপ্রিলে ন্যাটোর সদস্য হয়। কিন্তু সুইডেনের সদস্যপদ ঝুলে ছিল তুরস্কের বাধায়। তুরস্ক সুইডেনের প্রতি সবসময়ই পিকেকের সদস্যদের আশ্রয় ও রাজনৈতিক সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ করে চলেছে।
এরদোয়ান ও সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উল্ফ ক্রিস্টারসনের মধ্যে সমঝোতা করেছিলেন ন্যাটোর সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টোল্টেনবার্গ। তিনি বলেন, "তুরস্ক ও সুইডেন তুরস্কের যৌক্তিক নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা করেছে। এর ফলে সুইডেন সংবিধান সংশোধন করেছে, আইন পরিবর্তন করেছে, পিকেকে (কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি) এর বিরুদ্ধে কাউন্টার-টেরোরিজম অপারেশন বৃদ্ধি করেছে, এবং তুরস্কে অস্ত্র রপ্তানি বাড়িয়েছে।"
বলে রাখা ভালো, ১৯৮৪ সাল থেকে স্বায়ত্বশাসনের জন্য তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি।
রাশিয়া এর প্রতিবাদে বলেছে, ইউক্রেনে তুরস্কের হস্তক্ষেপ কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলবে। পুতিনের সামনের মাসে আঙ্কারা সফরে যাবার কথা রয়েছে।
এদিকে, ২০১৬ সালের ব্যর্থ ক্যু এর পর থেকেই পশ্চিমের সাথে সম্পর্ক ভালো নয় এরদোয়ানের। তাহলে এরদোয়ানের পুনঃনির্বাচনের পর এই পরিবর্তন কেন?
এর সম্ভাব্য একটি কারণ হতে পারে, সুইডেন ও ইউক্রেনে পশ্চিমাপন্থী অবস্থান নেওয়ার মাধ্যমে তুরস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক ঠিক করতে চাইছে। রাশিয়ান এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার পর থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক শীতল। এমনকি, এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রোগ্রাম থেকেও তুরস্ককে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রির ওপর স্যাংশনও দেওয়া হয়েছিল। তুরস্কের পদক্ষেপ কাজে লেগেছে বলা যায়। তুরস্কের ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টা পরেই ওয়াশিংটন তুরস্ককে আরো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেওয়ার ঘোষণা দেয়। আরো ঘোষণা দেয়, তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিকে উন্নত করায় যুক্তরাষ্ট্র সহায়তা করবে।
আরেকটা কারণ হলো, তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগদান নিশ্চিত করা। ১৯৯৯ সাল থেকে তুরস্কের ইইউ যোগদান ঝুলে আছে। সুইডেনকে সহায়তা করার বিপরীতে স্টকহোমের কাছ থেকে আঙ্কারা ইইউতে যোগদানের পক্ষে সুইডিশ সহায়তা নিশ্চিত করতে চায়।
এই সকল ঘটনার বিপরীতে রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল বেশ স্পষ্ট। গত ১৭ জুলাই রাশিয়া ২০২২ সালের জুলাইতে স্বাক্ষরিত শস্যচুক্তি বাতিল করে দেয়। এই চুক্তির আওতায় ইউক্রেন রাশিয়ান ব্লকেড পার হয়ে শস্য রপ্তানি করার সুযোগ পেত। ১৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করে বলেন, "প্রাথমিক পর্যায়ে, শস্য চুক্তির একটি বিশাল মানবিক তাৎপর্য ছিল। কিন্তু পশ্চিমাবিশ্ব এই তাৎপর্যকে সম্পূর্ণভাবে নষ্ট করেছে। যেসব দেশের শস্য প্রয়োজন, তাদের না দিয়ে শস্যকে 'পলিটিক্যাল ব্ল্যাকমেইলের' অস্ত্র বানিয়েছে।
তিনি বলেন, ৫টি দাবি পূরণ করা হলে রাশিয়া শস্য চুক্তিতে ফিরে আসবে-
১। রাশিয়ান কৃষি ব্যাংককে সুইফট সিস্টেমে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করা;
২। রাশিয়ার কাছে কৃষি প্রযুক্তি ও মেশিনের খুচরা যন্ত্রাংশ রপ্তানি পুনরায় আরম্ভ করা;
৩। রাশিয়ান জাহাজ ও কার্গোর জন্য ইন্সুরেন্স এবং বন্দরে প্রবেশাধিকার পুনরায় চালু করা;
৪। রাশিয়ার তোগালিয়াত্তি থেকে ইউক্রেনের ওডেসা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত অ্যামোনিয়া পাইপলাইন সংস্কার করা;
৫। রাশিয়ার সার কোম্পানিগুলোর অ্যাকাউন্ট ও ফাইন্যান্সিয়াল কার্যক্রম পুনরায় চালু করা।
এই চুক্তি বাতিল হওয়ার ফলে বিশ্বের অনেক দেশ খাদ্য ঝুঁকিতে পড়েছে। মিশর, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার মত জনবহুল দেশগুলো ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল। এমনকি চীনও গত এক বছরে ৮০ লাখ টন শস্য আমদানি করেছে ইউক্রেন থেকে।
এদিকে, বিশ্বের ক্ষুধার্তদের মধ্যে খাদ্য বিতরণকারী ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম তাদের অর্ধেক শস্য ইউক্রেন থেকে আমদানি করে থাকে। অর্থাৎ, তুলনামূলক দরিদ্র দেশের মানুষেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে চলেছে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে। রাশিয়ার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বের অনেক দেশের খাদ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার আকস্মিক সিদ্ধান্ত আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। রাশিয়া চায়, তেল-গ্যাসের মত শস্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে তারা ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বজায়ে রাখবে। এটা রাশিয়াকে তার সম্ভাব্য মিত্রদের কাছে কতটা জনপ্রিয় করবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
এখন তুরস্ক নতুন শস্য চুক্তি করার মধ্যস্থতায় বসেছে। তুরস্কের নিজেরও ইউক্রেনের গম প্রয়োজন। ইউক্রেনের ৫৭% শস্য যায় উন্নয়নশীল দেশে, ৪৩% যায় উন্নত দেশে। সবারই মাথায় হাত, বিশেষ করে দারিদ্র্যপীড়িত আফ্রিকান দেশগুলোতে। এমনকি এর ফলে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বাংলাদেশ ২০২২ অর্থছরে ৮.৭% গম আমদানি করেছে ইউক্রেন থেকে।
এদিকে, শস্যচুক্তি স্থগিতের পরে বিশ্ববাজারে একদিনে শস্যের দাম বেড়েছে ৮%, ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটিই সর্বোচ্চ বৃদ্ধি।
ওদিকে, ২৫ জুলাই জাতিসংঘের শস্য চুক্তি নবায়নের আহ্বানকেও ক্রেমলিন প্রত্যাখান করেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলো স্থলপথে শস্য রপ্তানি করার প্রস্তাব দিয়েছে; তবে এই প্রস্তাব কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, এটি এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছেনা।
সব মিলিয়ে, সামনের দিনগুলোতে কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলের সংকট আরো ঘনীভূত হতে যাচ্ছে বলে অনুমান করা যায়, যার আঁচ পড়তে পারে বাংলাদেশেও।