ইমরান খানের গ্রেপ্তারের ঘটনা বুঝিয়ে দিল পাকিস্তানের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর হাতেই
জার্মান রাষ্ট্র গঠনে মূল ভূমিকা ছিল প্রুশিয়ার – বর্তমান পাকিস্তান রাষ্ট্রের সাথে ১৮ শতকের প্রুশিয়ার-ই অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নাগরিক জীবনে গভীর প্রভাব, রাষ্ট্র পরিচালনা ও সামরিক ব্যয়ের এত বিপুলতা ছিল প্রুশিয়ায়- যে তা নিয়ে ফরাসী এক রাজনীতিবিদের উক্তি বিখ্যাত হয়েছে ইতিহাসে। তিনি বলেছিলেন, একটি দেশের সেনাবাহিনী থাকে, কিন্তু প্রুশিয়ান সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে। একুশ শতকে দাঁড়িয়ে একইকথা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
উপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভের দশকের পর দশক কেটে গেলেও- এই বাস্তবতা ক্ষতবিক্ষত করেছে পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে; বার বার জেনারেলরা অভ্যুত্থানের কলকাঠি নেড়েছেন।
পাকিস্তানের অর্থনীতিতেও ব্যাপকভাবে জড়িত সেনাবাহিনী। ফলে তাদের পক্ষে সরকারের ওপর নানামুখী চাপ সৃষ্টি করাও সহজ। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের দাম্ভিক প্রভাব– প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে বেসামরিক নেতৃত্বের গণতন্ত্রকে কোণঠাসা করে রেখেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখাই তাদের জন্য প্রাণান্তকর সংগ্রামে রূপ নিয়েছে যুগে যুগে।
মাত্র এক দশক আগে পাকিস্তানে প্রথমবারের মতো শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়। তখন অনেক বিশ্লেষক আশা করেছিলেন, দেশটির রাজনৈতিক পরিমণ্ডল থেকে সরে গিয়ে হয়তো এখন থেকে নেপথ্যেই থাকবে সামরিক বাহিনী। কিছুকাল তেমনটা দেখাও গেছে, অন্তত বাহ্যিকভাবে – কিন্তু, তা ছিল স্বল্পস্থায়ী।
গত কয়েক সপ্তাহে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যেসব নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে – তাতে সন্দেহাতীতভাবে বোঝা গেছে, চিত্রনাট্যের রচয়িতা ও পরিচালনায় রয়েছে সামরিক বাহিনী – তারাই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সামরিক-বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কলকাঠি তাদেরই হাতে, আর সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে তাদের বিরাগভাজন হওয়া যেকোনো রাজনীতিবিদকে সাজাও দিতে পারে।
ইমরান খানের বেলায় হয়েছে ঠিক তাই। বেআইনিভাবে রাষ্ট্রীয় উপহার বিক্রির দায়ে পাকিস্তানের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেন দেশটির একটি আদালত। রায় ঘোষণার পর শনিবার (৫ আগস্ট) লাহোরে নিজ বাসভবন থেকে ইমরানকে গ্রেপ্তার করে পকিস্তানের পুলিশ।
ইমরানের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন, তাকে এমন দুর্গম, গোপন স্থানে গ্রেপ্তারের পর রাখা হচ্ছে – যা তার মতো জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের জন্য কোনোমোতেই উপযুক্ত নয়। জনাব খান ও তার সমর্থকরা এই গ্রেপ্তারকে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপ উল্লেখ করে বলেছেন, এর উদ্দেশ্য, আগামী বছর অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে তার প্রার্থীতার সুযোগ বন্ধ করা।
নির্বাচনকে সামনে রেখে, এই সপ্তাহেই পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হবে।
বলাইবাহুল্য, এসব ঘটনার নাটের গুরু সামরিক বাহিনী।
ইমরান খান ছিলেন জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা, সেখান থেকে সমাজসেবা ও তারপর রাজনীতিতে তার আগমন। তেহরিক- ই- পাকিস্তান (পিটিআই) দল গঠনের পর প্রথম এক দশক মূলধারার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় হালে পানি পাননি। তবে ধীরে ধীরে তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে, এক পর্যায়ে ইমরান আসেন পাকিস্তানের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সেনাবাহিনীর নজরে। অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের মতে, এসময় ইমরান সেনাবাহিনীর গুণগ্রাহী ছিলেন, আর কট্টর সমালোচক হয়ে ওঠেন প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক রাজনৈতিক দলগুলোর।
সব সমীকরণ পাল্টে যায় যখন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন ইমরান। তিনি একটি কল্যাণমূলক ইসলামী রাষ্ট্রগঠনের চেষ্টা শুরু করেন– কিন্তু তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রাষ্ট্রের প্রকৃত বাস্তবতা (অর্থনৈতিক সংকট) ও রাজনৈতিক বিভাজন। সরকারের ঋণ পরিশোধের সংকট তখন জোরালো রূপ নেয়। ইমরান অবশ্য দায়িত্বে নেওয়ার দিন থেকেই বলে এসেছেন, আগের সরকারগুলো অপরিমিত ব্যয় ও দুর্নীতির মাধ্যমে এই সংকটে ফেলেছে পাকিস্তানকে।
এই অবস্থায়, সমর্থকদের কাছে দেবতুল্য এক নেতা হলেও – সমালোচকদের চোখে তিনি হয়ে ওঠেন এমন রাজনীতিক, ভবিষ্যতে যিনি স্বৈরশাসকে পরিণত হবেন। এর কারণ হিসেবে তারা সেসময় বলেছেন, ইমরান রাজনৈতিক বিরোধীদের জনশত্রু হিসেবে উপস্থাপন করছেন, একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।
২০২২ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনীর সমর্থন পেয়েই তৎকালীন বিরোধী দলগুলো পার্লামেন্টে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে। এতে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান। পাকিস্তানের বিচার বিভাগও অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে রায় দেয়।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ পদে পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে তৎকালীন সেনাপ্রধানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান তিনি। একই সময়, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও সরকারি দেনা নিয়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল বিরোধীরা। ইমরানকে হঠাতে এ দুই পক্ষ অভিন্ন স্বার্থ খুঁজে পায়।
ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট নিক রোয়ানের মতে, 'পররাষ্ট্রনীতি নিয়েও ইমরানের সাথে সেনাবাহিনীর দূরত্ব বাড়ছিল। ঐ বছরের মার্চে ইমরান অভিযোগ করেন, বিরোধীরা (সেনাবাহিনীও অবশ্যই) যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছে। এই অভিযোগ, সরাসরি অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, চরম ক্ষুদ্ধ হয় সেনাবাহিনী, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কার্যকর সম্পর্ক ধরে রাখতেই আগ্রহী।'
ফলে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের বিরুদ্ধে মামলার জোয়ার বয়ে যায়। এরপর চলতি বছরের মে' মাসে ইমরান খানকে একবার গ্রেপ্তার করা হয়। এর প্রতিবাদে সারাদেশের সামরিক স্থাপনাগুলোয় হামলা চালায় পিটিআই সমর্থকরা। তাদের মহানায়কের দুর্গতির জন্য ক্ষুদ্ধ জনতা সেনাবাহিনীকেই দায়ী করে।
এরপর আদালতের নির্দেশে ইমরান মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু, এসব হামলার নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয় সেনাবাহিনী। হাজার হাজার পিটিআই সমর্থকদের গ্রেপ্তারের পর সামরিক আদালতে তাদের নামকাওয়াস্তে বিচার করা হয়। মামলা, হামলা ও নির্যাতনের ভয়ে ডজন ডজন রাজনীতিবিদ পিটিআই ত্যাগ করেন। শীর্ষ কিছু নেতা আবার বিরোধী শিবিরে যোগ দিয়েছেন এবং ইমরান খানের আচরণের নিন্দা জানিয়েছেন। এরমধ্যে গণমাধ্যমে ইমরান খানের প্রতি সমব্যাথী মতামত প্রকাশ বন্ধ হয়েছে, নাহয় তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে।
গত জুনে পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আরিফ রফিক দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, 'খানের দলের নেতাদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করে, সেনাবাহিনী আরেকটি রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে – রাজনীতিতে নতুন শক্তি দাঁড় করাতে চাইছে। এখানে তাদের মূল উদ্দেশ্য, রাজনীতির সমীকরণ থেকে মাইনাস ইমরান। কারণ, তিনি এখন তাদের অবাধ্য ও অনাস্থাভাজন হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া, সেনাসমর্থনের ওপর পুরোপুরি নির্ভর না করার মতো বিপুল জনসমর্থনের পুঁজি তার আছে।'
জনাব খানের রাজনীতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য– এবং তার বিপুল জনপ্রিয়তা – সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে তাকে চক্ষুশূলে পরিণত করেছে।
ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড এরিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আকিল শাহ ফরেন অ্যাফেয়ার্সে লিখেছেন, 'রাজনীতিতে একসময় তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, ক্ষমতা হারিয়ে এখন প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়েছেন। আর তাই সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মধ্যে অসন্তোষের বীজ বুনে এর প্রাতিষ্ঠানিক ঐক্যকে ভাঙ্গতে চান। সেনাবাহিনীতে পাঞ্জাবি মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য বেশি; আর এ প্রদেশ ইমরানের শক্ত ঘাঁটি। তাদের ওপর ইমরানের প্রভাব নিয়ে সেনাসদরও চিন্তিত।'