অতুলপ্রসাদ সেনের স্মৃতিবিজড়িত কাওরাইদ, কবির বাল্যস্মৃতি আর সমাধি যেখানে
গিয়েছিলাম জামালপুর জেলা সদর থেকে ১৬–১৭ কিলোমিটার দূরে মেলান্দহ উপজেলার কাপাসহাটিয়া। উদ্দেশ্য ছিল সেখানকার গান্ধী আশ্রম ও মুক্তি সংগ্রাম জাদুঘর প্রাঙ্গণে আয়োজিত তিনদিনব্যাপী লোক সংস্কৃতি উৎসব ও লোকজ মেলায় অংশ নেওয়া।
তবে আজ অন্য প্রসঙ্গ।
রথ দেখার সঙ্গে দু-একটা কলা বেচার বদঅভ্যেস আমার অনেকদিনের। এ নিয়ে আমার সফরসঙ্গীদের অভিযোগের অন্ত থাকে না। তবে কয়লা ধুলেও ময়লা যাবে কোথায়? তাই মোগলের সাথে পড়ে তাদের খানা খেতেই হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল একটু কাওরাইদে ঢু মারার। কারণ দুটো। প্রথমটি একটি পবিত্র দায়িত্ব। মহান মুক্তিযুদ্ধে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্বাধীনতাপূর্ব দেশের অন্যতম প্রধান দাবাড়ু মুফতি কাসেদ কাওরাইদের কোন স্থানে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে শহীদ হন সে জায়গাটি খুঁজে বের করে সেখানে একবার শ্রদ্ধা নিবেদন করা। সঠিক জায়গাটি সম্পর্কে এখনও নিশ্চিতভাবে জানতে পারিনি। কাসেদ ভাইকে নিয়ে আমি এবং অঞ্জনা পত্রিকায় ও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছি। তার অন্য শুভানুধ্যায়ীরাও লিখেছেন। তবে আমার অনুসন্ধান জারি থাকবে। পাঠকেরা কেউ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারলে কৃতজ্ঞ থাকব।
এবার আসি দ্বিতীয় কারণে। অনেক আগে কোথাও পড়েছিলাম বাংলা পঞ্চকবির অন্যতম শ্রী অতুলপ্রসাদ সেনের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা কাওরাইদ। এখানে তার সমাধি রয়েছে। অতিসম্প্রতি আমার বন্ধু সমাজকর্মী তাপস হোড় এবং অনুজপ্রতিম গবেষক ও সংগঠক জনাব আশরাফুল ইসলামের সহযোগিতার কারণে সে স্থানে যাওয়া ও দেখা জলবৎ তরলং হয়ে যায়। তারা দুজন বাংলাদেশ–ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। কয়েকদিন আগে তারা ঐতিহাসিক সে জায়গা ঘুরে এসেছেন ও শিগগিরই সেখানে একটি অতুল মেলা আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
আশরাফ ভাইয়ের বাড়িও ঐ এলাকায়। জামালপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে ময়মনসিংহ–ঢাকা মহাসড়ক থেকে ১৬ কি ১৭ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকেই অভীষ্ঠ গন্তব্যে পৌঁছানো গেল। এ এলাকাটি অতুলপ্রসাদ সেনের মাতুল বংশের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত ছিল। তখন চলছিল বাংলা রেনেসাঁর যুগ। সে সময়ের শিক্ষিত প্রাগ্রসর শ্রেণির অনেকেই ব্রাহ্ম মতাবলম্বী ছিলেন। অতুলপ্রসাদের পরিবার এবং মাতুলালয়ও তাই। কাওরাইদ গাজীপুর জেলার শেষপ্রান্ত। একটি ছোটনদীর (সুতী) ওপারেই ময়মনসিংহ জেলা। এ নদী তীরবর্তী এলাকায় মনোরম পরিবেশে ছিল জমিদারদের কাচারি। এখানে শৈশবে অতুলপ্রসাদ তার মাতামহের সঙ্গে বহু সময় শিক্ষা ও সংগীতসাধনায় কাটিয়েছেন।
এটি এখন সরকারি ভূমি অফিস। তার লাগোয়া চমৎকার একটি ব্রাহ্ম মন্দির। শতবছর পেরিয়ে গেলেও এখনও মোটামুটি ভালো অবস্থায় আছে। প্রাঙ্গণে সারি সারি সমাধি। সেগুলোও চলনসই অবস্থার। প্রতিটিতে সমাধিফলক লাগানো। সেখানে আরও রয়েছে স্যার কে জি গুপ্তের (অতুলপ্রসাদের মামা, যিনি আবার তার শ্বশুর) সমাধি। তিনি সপ্তম ভারতীয় আইসিএস অফিসার এবং প্রথম কেসিএসআই (নাইট কমান্ডার অভ দ্য স্টার অভ ইন্ডিয়া) ছিলেন। অন্য সমাধিগুলোর মধ্যে আছে অতুলপ্রসাদের মাতামহ জমিদার, সুগায়ক, ভাবসংগীত রচয়িতা ও লেখক শ্রী কালী নারায়ণ গুপ্তের সমাধি। এ এলাকায় তিনি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই আমলে। সেটি এখনও শিক্ষার আলো বিতরণ করে চলেছে।
তবে সেই কালী নারায়ণ স্কুলটি একসময় তার নামটি হারিয়ে ফেলেছিল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখতে পাই একশ্রেণির লোকের পুরোনো এ নামগুলোতে গাত্রদাহ। তাই ব্রজমোহন কলেজ হয়ে যায় বিএম কলেজ, মুরারিচাঁদ কলেজ হয় এমসি কলেজ। তেমনি এ স্কুলও হয়েছিল কেএন স্কুল। তবে সৌভাগ্যক্রমে ও কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের প্রচেষ্টায় স্কুলটি পুরোনো নাম ফেরত পেয়েছে।
অতুলপ্রসাদ সেন তার কর্মস্থল লক্ষ্ণৌতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। সেখানেই তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। চিতাভস্মের কিয়দংশ এখানে এনে সমাহিত করা হয়েছে। অন্য সমাধিগুলোর মধ্যে অনেকগুলো একই পদ্ধতির। কয়েকটি শেষকৃত্য এখানেও হয়েছে।
অতুলপ্রসাদের সমাধিফলকে আগে উৎকীর্ণ ছিল তার সেই বিখ্যাত গান: মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা! ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাভাষা আন্দোলনে পরাজিত পাকিস্তানিরা তাদের ১৯৫২'র পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে সেই সমাধিফলকটি গুঁড়িয়ে দেয়। পরে সেটি পুনর্নির্মাণ করার সময় কেন জানি না সে মহান গানের চরণদুটি বাদ পড়ে যায়। সে গানটি প্রতিস্থাপিত হয়েছে কবির অন্য একটি ভাববাদী গানের চরণ দিয়ে: শেষে ফিরব যখন সন্ধ্যাবেলা, সাঙ্গ করে ভবের খেলা…। অবশ্য এ গানটিও সমাধিফলকের উপযুক্ত বটে।
যদিও অনেকেই কবির জীবন সম্পর্কে বহুলভাবে অবগত তবুও এ সুযোগে যারা জানার অবকাশ করে উঠতে পারেননি তাদের জন্য একটু তথ্য বিতরণ করার সুযোগ 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' হিসেবে নিয়ে নিই।
অতুলপ্রসাদের পৈতৃক বাড়ি তৎকালীন বিক্রমপুর পরগণার পদ্মার দক্ষিণাংশে। বর্তমানে সে এলাকা শরিয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার মগরা। তিনি অতি অল্পবয়সে পিতৃহীন হন। তার জন্ম তৎকালীন সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী মাতুলালয়ে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে। শৈশবে পিতৃহীন হওয়ায় এবং মাতা পুনরায় দারপরিগ্রহ করায় তার শৈশব ও কৈশোর কাটে মাতুলালয়ে। মাতুল পরিবার অতি প্রভাবশালী, উচ্চশিক্ষিত, ধনবান, রুচিশীল ও সংস্কৃতিমনা ছিল। তারা ঢাকা জেলার (বর্তমান নরসিংদী) পাঁচদোনার ভাটপাড়ায় শানশওকতে থাকতেন। তাদের জমিদারি ছিল কাওরাইদ অঞ্চলে।
অতুলপ্রসাদ তার মাতামহ ও জমিদার কালী নারায়ণ গুপ্তর তত্ত্বাবধানে শিক্ষালাভ করতে থাকেন। কালী নারায়ণ অত্যাচারী জমিদার চরিত্রের ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি ছিলেন লেখক এবং ভাবকথা ও ভাবসংগীত রচয়িতা কবি। ছিলেন সুগায়কও। তার কাছেই অতুল গানের ভুবনে প্রবেশের চাবিকাঠি পান। কালী নারায়ণ ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং ব্রাহ্মমত প্রচারেও ভূমিকা পালন করেন। তিনিই নিজের কাচারি এলাকায় কাওরাইদ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করে উপাসনার জন্য মন্দির তৈরি করে দেন।
কালী নারায়ণের সুযোগ্যপুত্র স্যার কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্তের (কে জি গুপ্ত) কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়াও এ পরিবার তৎকালীন বহু উল্লেখযোগ্য পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন, সত্যজিৎ রায়ের মাতা ও স্ত্রী উভয়েই এবং অতিপরিচিত অনেকেই এ গুপ্ত পরিবারের নিকট বা দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন।
কবি তার স্কুলের পড়াশোনা মামাবাড়ি থেকে শেষ করে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে যান। তারপর তাকে আইন শিক্ষার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মিডল টেম্পল থেকে তিনি ১৮৯৪ সালে ব্যারিস্টার হন। ইউরোপে থাকাকালীন পশ্চিমা ক্লাসিকাল সংগীত পছন্দ করে সে ধারা আত্মস্থ করেন।
দেশে ফিরে তিনি প্রথম বঙ্গদেশেই পেশায় থিতু হওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কয়েক বছর রংপুর ও কলকাতায় কাটিয়ে তার মন টিকল না। পারিবারিক কিছু কারণও ছিল। তিনি ইতোমধ্যে তার মামাতো বোন স্যার কে জি গুপ্তের কন্যা হেমকুসুমের সঙ্গে মন দেয়া-নেয়ায় জড়িয়েছেন। এ সম্পর্কে পরিবার অসন্তুষ্ট ছিল এবং তৎকালীন আইনও এরূপ বিবাহের পক্ষে ছিল না।
অতুলপ্রসাদ লক্ষ্ণৌ গিয়ে পরবর্তীকালে আইন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি আউধ বার অ্যাসোসিয়েশন ও বার কাউন্সিল উভয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতিপদ অলংকৃত করেছিলেন। তিনি ১৯০০ সালে ইংল্যান্ডে যান এবং স্কটল্যান্ডের আইনে কোনো বাধা না থাকায় সেখানে হেমকুসুমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই পুত্রসন্তানের জন্ম হয় সেখানেই। তিনি সেখানে আইনবিদ হিসেবে কিছু কাজও শুরু করেন। নবজাতক দুই পুত্রের একজনের অকালমৃত্যু, ইংল্যান্ডের আবহাওয়া পছন্দ না হওয়া ও আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সময়সাপেক্ষ প্রতীয়মান হওয়া — এসব বিবেচনায় ১৯০২ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং আমৃত্যু লক্ষ্ণৌতে আইন ও সংগীতচর্চা করে কাটান।
লক্ষ্ণৌ সংগীত ও নৃত্যকলার জন্য প্রসিদ্ধ। অতুলপ্রসাদ প্রচুর সময় সংগীতসাধনায় ব্যয় করতেন। সংগীতের আসর বসাতেন লক্ষ্ণৌর তৎকালীন সকল বিশিষ্ট ওস্তাদদের নিয়ে। রচনা করতেন গান, সুরারোপ করতেন তাতে। গাইতেনও নিজে। তার গানসমূহের প্রধান উপজীব্য দেশপ্রেম, ভক্তি, প্রেম ও জীবনের দুঃখবেদনা। তিনি বাংলা গানে রাগপ্রধান ধারা চালুর অন্যতম সারথি। লক্ষ্ণৌ থেকে সংগীতচর্চা করায় তার গানে ঠুমরির প্রভাব প্রচুর। প্রথম বাংলা গজলও তিনিই প্রচলন করেন বলে জানা যায়। তার লেখা ও সুরারোপিত মোট ২০৬টি গান তার সম্পর্কের বোন সাহানা দেবী সংকলিত করে গেছেন।
এ মহান বঙ্গসন্তানের জীবনাবসান হয় সুদূর লক্ষ্ণৌতে ১৯৩৪ সালের ২৬ আগস্ট। তার শেষকৃত্য সেখানেই সম্পন্ন হয়। চিতাভস্মের এক অংশ তার প্রিয় বঙ্গদেশে মাতামহ প্রতিষ্ঠিত কাওরাইদ ব্রাহ্ম মন্দির প্রাঙ্গণে মাতামহ, মাতুল ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমাধির পাশেই সমাহিত করে সমাধিফলক স্থাপন করা হয়। সে সমাধির সামনে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমরা ঢাকার দিকে রওনা দিলাম।
অতুলপ্রসাদ সেনের কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে রয়েছে 'মোদের গরব মোদের আশা', 'কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে', 'বঁধূয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে', 'সবারে বাস রে ভালো'। পঞ্চকবির অন্যতম অতুলপ্রসাদের স্মৃতির উদ্দেশে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।