দারিউশ মেহেরজুইয়ের বাস্তবতা
১.
দারিউশ মেহেরজুই ইরানি নবতরঙ্গ চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ ছিলেন- এ কথাটি বললে যথেষ্ট বলা হয়ে ওঠে না। কেননা ইরান এমন এক রাষ্ট্র যেখানে সৃজনশীল মানুষ তো বটেই, সাধারণ নাগরিকেরও নিজস্ব মতামত প্রকাশ করতে হয় ভেবেচিন্তে। আমরা যদি দারিউশের শুরুর সময়টির ইতিহাসের দিকে তাকাই, দেখবো শিল্পনির্মাণের প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তাব্যক্তি হয়ে বসে আছেন সর্বোচ্চ নেতার আত্মীয় পরিজন। সম্রাজ্ঞীর নিকট সম্পর্কের তুতো ভাই রেজা ঘটবি ন্যাশনাল ইরানিয়ান রেডিও অ্যান্ড টেলিভিশন -এর ডিরেক্টর জেনারেল; সম্রাট শাহের শ্যালক মেহেরদাদ পাহলবী সংস্কৃতি ও শিল্পমন্ত্রী, আরেক শ্যালক মেহেদী বুশরি ইরানের চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার প্রধান। শিশু-কিশোরদের জন্য কাজ করবে যারা তাদের প্রধান হয়ে বসলেন শাহের স্ত্রী ফারাহ'র ঘনিষ্ঠ বান্ধবী লিলি আমির আর্জুমান্দ। শাসক দম্পতির আনুগত্য লাভের চেষ্টা ইরানের শিল্প- সংস্কৃতিতে ধস নামিয়ে এনেছিল। পাহলবী রক্ষণশীল ছিলেন, আর ঘটবি বেশ খানিকটা মুক্তচিন্তার। আবার, তারা যথাক্রমে শাহ এবং তার স্ত্রীর প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করতেন।
রাষ্ট্রীয় সেন্সরশিপ এবং দমনপীড়ন ইরানি চলচ্চিত্রের জন্মলগ্ন থেকে লেগে আছে। বিশেষ করে যেসব চলচ্চিত্র হলিউডের গ্যাংস্টার কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নকল না করে নিজেদের মানুষের প্রাণের বেদনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকতে চেয়েছে সেইসব চলচ্চিত্রের জন্যে পরিস্থিতি সবসময়েই জটিলতর। নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্রকারদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে এগিয়ে আসে গোলেস্তান ফিল্ম ওয়ার্কশপ- বছরে ৯২টি চলচ্চিত্র নির্মাণে সক্ষম হয়। তাদের উৎপাদন পদ্ধতিতে, পাবলিক অর্থাৎ সরকার এবং প্রাইভেট তথা বাণিজ্যিক - এই দুই সেক্টরকেই তারা সফলভাবে মিশ খাওয়াতে পেরেছিলেন। বিভিন্ন রকম চলচ্চিত্র উৎসবে বিশ্বের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র দেখবার সুযোগ ঘটে তরুণ নির্মাতাদের। যেমন তেহরান চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয় ১৯৫৮ সালে।
২.
বেশিরভাগ নবতরঙ্গের নির্মাতা আর কিছু বাণিজ্যিক পরিচালক দেশের বাইরে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রে। কাজার আমলে তাদের একটা যৌথ প্রভাব দৃশ্যমান। ফেরাইদুন রাহনেমা (ফ্রান্স), ফারুখ গাফফারী (ফ্রান্স), বাহমান ফারমানারা (যুক্তরাষ্ট্র), দারিউশ মেহেরজুই (যুক্তরাষ্ট্র), কামরান শিরদেল (ইতালি), পারভেজ কিমিয়াভি (ফ্রান্স), সোহরাব শাহিদ সালেস (অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স), খসরু হারিতাস (যুক্তরাষ্ট্র) এবং হাজির দারিউস (ফ্রান্স)- এই ট্রান্সন্যাশনাল অঞ্চলে এতোজন নবতরঙ্গ পরিচালকের শিক্ষাগ্রহণ ইরানি চলচ্চিত্রকে বিশ্বজনীনতা দিয়েছে। স্ব-শিক্ষিত বা দেশেই প্রশিক্ষণ পাওয়া বাহরাম বেইজাই, আব্বাস কিয়েরোস্তামি, নাসের তাকভাই, পারভিজ সায়াদ এবং আমির নাদেরি- এই কয়েকজনের সম্মিলিত অবদান বাইরে প্রশিক্ষিত পরিচালকদের কাজকে ধারাবাহিক মর্যাদা দিয়েছে। তারা সকলে মিলে নবতরঙ্গের ভিত্তিটা তৈরি করেছেন।
এবার দারিউশ মেহেরজুইয়ের কথায় আসা যাক। জন্মেছেন ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরের অষ্টম দিনে। কচি বয়সে আগ্রহী ছিলেন মিনিয়েচার চিত্রকলা এবং সুরের প্রতি। পিয়ানো এবং সন্তুরের নিয়মিত চর্চা করতেন। বারো বছর বয়সে ভিত্তোরিও দে সিকা'র 'বাইসাইকেল থিফ' ছবিটি দেখে চমকে যান। আমাদের মনে পড়ে যাবে, উপমহাদেশের মায়েস্ত্রো পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের কেন্দ্রীয় প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো এই চলচ্চিত্র।
চলচ্চিত্র একবার যার রক্তে মিশে যায় তাকে আর ছাড়ে না। এ এক সর্বগ্রাসী আশ্লেষ- শুদ্ধ প্রেমপ্রতিম! দারিউশ যুক্তিরাষ্ট্রে পাড়ি জমালেন চলচ্চিত্র বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে। কিংবদন্তী ফরাসী নির্মাতা জ্যঁ রেনোয়াকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন। অভিনেতাদের সঠিকভাবে পরিচালনার শিক্ষাও ফরাসি গুরুর কাছেই। কিন্তু সব মিলে ভালো না লাগায় দর্শনে পড়া শুরু করলেন, চলচ্চিত্রশিক্ষা মুলতুবি রেখে। স্নাতক শেষে দেশে ফিরলেন।
তার রক্তে আর প্রতিটি শ্বাসবিন্দুতে ছিলো দেশের প্রতি আত্মার টান। ফরাসি নির্মাতা ক্লদ শ্যাব্রলের সাথে একাধিক কাজ করা চিত্রনাট্যকারের চিত্রনাট্যে কাজের প্রস্তাব পেয়েও প্যারিস গেলেন না তিনি । কেননা গল্পের কাঠামোয় শিকড়ের টান অনুভব করছিলেন না। প্রথম চলচ্চিত্র 'ডায়মন্ড ৩৩' নির্মাণ করেছিলেন ভালো ছবি নির্মাণের জন্যে পয়সা সংগ্রহ করতে। পরের চলচ্চিত্র 'দ্য কাউ' চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের বিচারে ইরানি নবতরঙ্গের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ বলে বিবেচিত হয়।
৩.
'দ্য কাউ' কেন সকল স্তরের মানুষের মন জয় করে নিয়েছিল?
মানুষের সাথে গৃহপালিত প্রাণী গরুর সম্পর্ক এখানে সুফীদের অধ্যাত্মবাদী প্রেমের রূপকে উপস্থিত। আমরা গল্পটি একবার অতি সংক্ষেপে মনে করে নিতে পারি।
খুবই গরীব এক গ্রামে মাশ হাসান থাকে তার গর্ভবতী গরু নিয়ে। প্রতিটি মুহূর্তে ধ্যান জ্ঞান তার এই গরুটি। তার জীবিকা এবং সারা গ্রামের দুধের উৎস অবলা এই প্রাণী। মাশ তাকে স্নান করায়, জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খায়, হাতভর্তি খড় খেতে দেয়। এমনকি নিজে কিছু খড় খেয়ে গরুকে বোঝায় এবার তাকেও খেতে হবে। এ দৃশ্যটি শেষ হয় গরুকে ভালবেসে বলা দুটি শব্দে - 'নজম, জনম!' (আমার প্রিয় আমার আত্মা)। এক রাতে মাশ ব্যবসার কাজে অন্য গ্রামে গেলে রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতকারীর হাতে গরুটি নির্মমভাবে খুন হয়। নিজেদের অসাবধানতা ঢাকা দিতে গ্রামের বিচক্ষণ নেতা গরুটিকে কবরস্থ করে। মাশ হাসান ফিরে এলে জানায়, গরুটি পালিয়েছে। আস্তে আস্তে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে হাসান। ভালবাসার গরুর পরিণতি আবিষ্কারে ব্যর্থতা তাকে আরো বিপন্ন করে তুললো। উন্মাদ হয়ে যেতে থাকলো সে। এই ধরনের চিহ্নিতকরণ ইরানি মিস্টিক সুফি দর্শন ও কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয়। সুফি দর্শনের স্রষ্টা ও সৃষ্টি যেমন এক দেহে লীন তেমনি ভালোবাসার পাত্ররা নিজেদের মধ্যে বিভেদ করতে পারে না। চলচ্চিত্রের শেষে গ্রামবাসীরা হাসানকে মানসিক চিকিৎসা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো ঘোর বৃষ্টির মধ্যে আর সে তাদের বাধ্য করছিলো তাকে মানুষ নয়, গরুর মত নিয়ে যেতে। তারা তার জেদের কাছে হার মানলো। গরুর মতোই নিয়ে যাচ্ছিলো। কখনো ধাওয়া, কখনো রশিতে বাঁধা। দু'জন গ্রামবাসীর আনন্দিত বিবাহ উৎসবের মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটি সমাপ্ত হয়।
মাশ হাসানের স্ত্রী তাকিয়ে থাকে দিগন্তের দিকে, যেমন করে সে তাকিয়েছিলো গরুর অপেক্ষায় মরুভূমির রুক্ষ প্রান্তরের দিকে। এই অপেক্ষা আর প্রতীক্ষা কারোর জন্যে- একজন ভালোবাসার মানুষ, একজন ত্রাতা, একজন হৃদয়বান- ইরানি চলচ্চিত্র, সাহিত্য, মিষ্টিসিজমের প্রাথমিক বিষয়। 'দ্য কাউ ' গ্রামের গল্প উপস্থাপনে বিরল ধরণের সত্য নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। কোনো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বানানো কৃত্রিমতার স্থান নেই এখানে। ইরানি চলচ্চিত্র আকাশে 'দ্য কাউ' অতি উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির অন্যতম। আমাদের 'দ্য কাউ' প্রসঙ্গে মেহেরজুইয়ের প্রিয়তম ছবি 'বাইসাইকেল থিফ'- এর কথা মনে পড়বে কিন্তু নির্মাণ, অভিনয়শলীর দিক থেকে বিচার করে দেখলে মেহেরজুই অনেক বেশি মাত্রায় বহুমাত্রিক ও দার্শনিক তাৎপর্য অনন্য।
৪.
চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাকে বাস্তবতায় পরিণত করার জন্য জরুরী ছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। সমাজ বাস্তবতাবাদী নির্মাতা গাফফারি এবং গোলেস্তান 'সাউথ অফ সিটি নাইট অফ দা হাঞ্চব্যাক ' (১৯৬৪) এবং 'মাডব্রিক অ্যান্ড মিরর' (১৯৬৫) চলচ্চিত্র দিয়ে যে আগুনের স্ফূলিঙ্গ জ্বালিয়ে দিলেন তাকে আরো উজ্জ্বল করে তুললো রাহনেমা'র আধুনিকতাবাদী নির্মাণ 'সিয়াভাস ইন পারসেপোলিস' (১৯৬৭) এবং মৌলাপুরের বাস্তব ধারার 'আহু'স হাজব্যান্ড'(১৯৬৮)। চূড়ান্ত দাবানলের আগ্রাসী বিস্তার দেখা গেলো- কিমিয়াইয়ের 'কাইসার' এবং মেহেরজুইয়ের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র - 'দ্য কাউ '- এই দুই নির্মাণে ৷ যদি 'কাইসার' আধুনিক শক্তপোক্ত মারদাঙ্গা ছবির অর্থাৎ 'জাহেলি' জনরার উজ্জীবন ঘটায়- 'দ্য কাউ' নবতরঙ্গের চলচ্চিত্রের নেতৃত্ব দিয়েছে।
একত্রে তারা প্রথাগত বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র শিল্পের ধারাটি নাড়িয়ে দিলেন এবং শিল্প-বাণিজ্যের মেলবন্ধনে মিশ্র উৎপাদন পদ্ধতিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেন। ১৯৭০ প্রথম ইরানি চলচ্চিত্র উৎসব অনুষ্ঠিত হলে 'কাইসার' শীর্ষ সিনেমার পুরস্কার জেতে, 'দ্য কাউ' দ্বিতীয় হয় এবং 'আহু'স হাজব্যান্ড' তৃতীয়। 'দ্য কাউ' জীবনের জটিলতা, প্রাপ্তি, প্রতিবন্ধকতা অপূর্ব চলচ্চিত্রীয় বিস্তার, শৈলী এবং দুই দিকেই ধারালো তরবারির মতো পরিস্থিতি বিবৃতকরণে সফল হয়।
দারিউশ মেহেরজুই সস্ত্রীক নিহত হয়েছেন মৌলবাদীদের হাতে। এই লেখাটি লেখার সময় চারদিন গড়িয়ে গেলো। হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা না গেলেও তাদের আদর্শ আমরা জানি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি হুমকি পাচ্ছিলেন নানা মাধ্যমে। ঘাতকেরা কখনো নিহতকে সঠিকভাবে মাপতে পারে না। প্রত্যেক নিহত মুক্তমনা একটা মুক্ত পৃথিবীর জন্যেই আত্মাহুতি দিয়েছেন। দিতে বাধ্য হয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের দেশে এই উদাহরণ অপ্রতুল নয়। অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ থেকে অভিজিৎ রায় হয়ে তালিকা অশেষ। টু বি কন্টিনিউড…
দারিউশ পৃথিবী জুড়ে হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় নতুন সংযোজন। যেহেতু এখনো হত্যাকারী সনাক্ত হয়নি, তাহলে কি ইরানি সরকার যথেষ্ট তৎপর নয়? আমরা যারা সিনেমা দেখতে পছন্দ করি, লিখতে ভালোবাসি তারা যদি তিরাশি বছরে নিহত হওয়া মেহেরজুইয়ের জীবন থেকে শিক্ষা নেই তাহলে চলচ্চিত্রকে নিছক বিনোদন পদ্ধতি না ভেবে অন্যতর এক রণকৌশল ভাবার মাধ্যমে চেষ্টা শুরু করা যেতে পারে।