আবার সহিংসতার পথেই…
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি কখন থেকে চালু হয়েছে তার কোন সঠিক ইতিহাস নাই। তবে বহুদিন ধরেই এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই দলের রাজনীতিতে সংযুক্ত হয়েছে। ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সম্ভবত প্রথম নজরে এসেছিল ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত সাহার বিরুদ্ধে ২০০২ এর গুজরাট দাঙ্গার পরে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু কখন সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলো কিংবা বিষয়টি কিভাবে নিষ্পত্তি হল তা বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনের খবরাখবর যারা রাখেন তারা কেউ জানেন না। কিন্তু একদিন বিশ্ব দেখল, নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিশেষভাবে সংবর্ধিত হচ্ছেন আমেরিকায়। এটা কখন কিভাবে বদলে গেল! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকরা সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা কখনো দেননি। কিভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কালে মোদিজীর আমেরিকাতে প্রত্যাবর্তন ঘটল কিংবা কিভাবে তার সেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলো, কোনো ব্যাখ্যা নাই।
গত শনিবার (২৮ অক্টোবর) বাংলাদেশে যে রক্তাক্ত রাজনীতির নতুন মেরুকরণ হলো সেই রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস একটি বক্তব্য নামনে এনেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে-এ বিষয় বিবেচনা করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টির প্রভাব বা তাৎপর্য কি তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। কারণ এ বিষয়ে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সহ আরো অনেকেই মুখ খুলেছেন। বলেছেন, মার্কিন ভিসা নিয়ে তাদের কেন আগ্রহ নাই।
রাজনীতির মেরুকরণে ক্ষমতাসীনদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে। পর্দার ওপারে, সমস্ত কথার অন্তরালে কী ঘটছে তা বোঝা যাচ্ছে না। অতি সাম্প্রতিককালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড কর্মসূচিকে নিয়ে শীর্ষ সম্মেলন হয়েছে, ১৭টির মতো দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের অংশগ্রহণে। কিন্তু আমরা সদস্য দেশ হিসেবে থাকা সত্ত্বেও সেই শীর্ষ সম্মেলনে অমাদের কোন প্রতিনিধিত্ব কেন হলো না তা আমাদের কাছে এখনো অস্পষ্ট; পর্দার অন্তরালে বিশ্ব রাজনীতির নতুন কোন মেরুকরণ হয়েছে কি-না!
আজকের সরকারের গর্বের পদ্মা সেতুর মূল স্থপতি যে-ই হোক না কেন, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চীনা ভূমিকা একক কৃতিত্বের দাবিদার সন্দেহ নেই। শীর্ষ সম্মেলনে আমাদের প্রতিনিধিত্ব না থাকার পেছনে সঠিক ব্যাখ্যা আমরা জনগণ জানি না।
দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে নির্মিত সুরঙ্গ দিয়ে গাড়ি চলাচল করা এই প্রথম। ভারত এখনও এই কৌশল অর্জন করতে পারেনি। কিংবা ভারত নদীর নিচে টানেল-সড়ক বানানোর কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি । বাংলাদেশের কর্ণফুলীর এই টানেল চীনাদের দ্বারাই তৈরি হয়েছে।
বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের গাজা উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়া যুদ্ধে, ইসরাইলের নির্বিচার বোমাবষর্ণে এ পর্যন্ত আট হাজারের বেশি সাধারণ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, আর ফিলিস্তিনিদের এই ব্যাপক প্রাণহানি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মন্তব্য করেছেন: গাজায় প্রাণহানির প্রকাশিত তথ্য সঠিক নয়, তিনি মনে করেন। এর পরপরই গাজার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৃতের সংখ্যার পূর্ণ বিবরণী প্রকাশ করে।
পশ্চিমা বিশ্বের মানবাধিকার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবই আমরা দেখছি। হামাসকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন বলার আগে তাদের সংগঠনটির ইতিহাসের প্রতিটি পথকে পর্যালোচনা করা দরকার ছিল পশ্চিমাদের। তারা সেপথে এগোয়নি। পৃথিবী স্বীকৃত সকল সুধীজন বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে ইসরায়েল কর্তৃক গাজা উপত্যকায় সংঘটিত ঘটনাকে গণহত্যা বলেই উল্লেখ করছে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গাজায় নিহতদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন, হত্যার সংখ্যায় তার আস্থা নেই।
শনিবারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠিত বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠী। এই ভূখণ্ড আবার রক্তাক্ত হবে কিনা সেই প্রশ্ন সবার মাঝে। একটি দেশের সামাজিক উন্নয়ন ঘটে না যতক্ষণ পর্যন্ত সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হয়। সামাজিক উন্নয়ন না হলে কখনো কোনো উন্নয়নই স্থায়িত্ব পায় না।
আজকের মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, সুপার হাইওয়ে সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়বে যদি সমাজের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়। জবাবদিহিতার সৃষ্টি না হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না হয়। দেশে আইনের শাসন যথেষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত কি-না তা প্রশ্নের সম্মুখীন। বিভাজিত সমাজের সংঘর্ষে সকল উন্নয়ন ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
পরশুর সন্ত্রাসের পরিণতিতে একজন সাধারণ কনস্টেবল জীবন হারিয়েছেন, আমাদের দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে ঘটনাটির দায় কার তা অস্পষ্ট। যুবদলের একজন কর্মী নিহত হয়েছেন বলেও বিএনপির দাবি। এই দুটি হত্যাকাণ্ডের জন্য পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করছে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দল। কিন্তু এই পরিবারদ্বয়কে সহমর্মিতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে প্রায় সকলেই। সমাজের সকল স্তরের রাজনৈতিক দলগুলো তেমন কোনো মানবিকতা প্রকাশ করতে পারেনি এখনো।
আগামী তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই তিন মাস আমাদের পরিপার্শ্ব লড়াইয়ের ময়দান হয়ে থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। বিগত ১৩-১৪ সালের লড়াইয়ের কথা আমাদের মনে পড়ে; আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনের সেই নির্বাচনের সময়ের রক্তপাতের কথা আমরা ভুলি নাই। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংঘর্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অন্যতম পাঠ এরশাদের পতনের সময়কাল থেকেই, সেই সময়ে এই নির্বাচনী সংঘর্ষ আমরা দেখেছি। এরপর থেকেই নির্বাচনে সংঘর্ষ যেন একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে গেছে। '৯৬ সালের সংঘর্ষের কথা আমাদের মনে আছে। বর্তমানের সরকারি দল আওয়ামী লীগ তখন বিরোধী দলে আর বিএনপি যখন ক্ষমতায়. তখন বিতর্কে ছিল আজকের এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিটি।
আন্দোলনে আওয়ামী লীগ রাজপথ নিয়ন্ত্রণে নেয়- বিএনপি ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগের সাথে রাজপথ দখলের লড়াইয়ে, তখন বিএনপি অনেকটা বাধ্য হয়ে এক ধরনের সমঝোতার রাস্তা গ্রহণ করে, ১৯৯৬ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। এবং মধ্যরাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ করিয়ে পরবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। এরপরেও বিএনপি আবার রাজনৈতিক ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাজপথের আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয় এবং তারপর ওই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি হয়, ২০০৭ সালে হয় নতুন সরকার।
ইতিহাসের পাতা থেকে আমরা যদি দেখি, তাহলে বিএনপি কখনোই রাস্তার আন্দোলনে জয়লাভ করতে পারেনি। একাধিকবারের এই অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি সেই রাস্তার আন্দোলনের পথেই হাঁটছে যা গত শনিবার আবার রাজপথে রক্তপাতের ঘটনার সূত্রপাত করেছে। পরশুর ঘটনার পরও আমরা তাকিয়ে থাকবো পশ্চিমারা কী বলছেন, কী করছেন সেদিকে! আমাদের আলোচনা থাকবে কোন দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি ইত্যাদি অনুমান করার চেষ্টায়।
বর্তমানে ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদল অতীতের রক্তাক্ত পথের দিকেই হাঁটছে। লগি-বৈঠা, জনতার মঞ্চ সবই আমরা দেখেছি। সাধারণ মানুষের ভাগ্য উন্নয়ন কতটুকু হয়েছে তা আলোচনার দাবি রাখে। দেশে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। কিন্তু এ বিষয়গুলোর দিকে মনোযোগী না হয়ে উচ্চবিত্তদের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াই দিনে দিনে আরো তীব্র হচ্ছে, এর শেষ কোথায়?
ইতিহাসের পাতা উল্টালে আমরা আরও দেখতে পাই, বাংলাদেশের জন্মের পরে আওয়ামী লীগ দলটির উপর দিয়ে নানা-ঘাত, প্রতিরোধ-প্রতিবাদের মধ্যেও প্রায় সব ক'টি নির্বাচনী তারা অংশ নিয়েছে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন সব রাজনৈতিক দল প্রত্যাখ্যান করায় সে নির্বাচনে তারা অংশ নেয়নি। দ্বিতীয়বার ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি নির্বাচন তা নির্ধারিত একটি নির্বাচন হওয়ার কারণেই সেখানেও তারা অংশ নেয়নি। অপরদিকে অন্য রাজনৈতিক দলটি স্বাধীনতার কয়েক বছর পরে জন্ম নিয়েছিল, তারা '৮৬, '৮৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আর ২০১৩ ও ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচন দুটি সঠিকভাবে অনুষ্ঠিত না হওয়ায় দলটি ক্ষতির মুখে পড়ে, আমার মতে। পরশু সারাদিন দেশে যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ছিল তা পরিসমাপ্তি হলো একজন সাধারণ কনস্টেবল এবং অন্য একজন যুবদলের নেতার জীবনহানির ভেতর দিয়ে। এখন আমরা কি ওই পথেই হাঁটবো, আরো বেশি হত্যা আরো বেশি মৃত্যুর দিকে?
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।