অবশেষে তাঁর স্বপ্ন সত্যি হলো
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের তুলনায় নিজেদের উৎকৃষ্ট যোদ্ধা ও উন্নত মেধাবিশিষ্ট প্রজাতির মনে করত পাঞ্জাবি সার্বিক নেতৃত্বের অধীন পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের সাধারণভাবে নিজেদের চিরশত্রু ভারতের দালাল মনে করত তারা। এমনকি বাঙালি মুসলিম সমাজও তাদের বিবেচনায় সাচ্চা মুসলমান ছিলেন না। তাই ১৯৭০-এ নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয়ের পর তাদের টনক নড়ল। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে তারা অবাস্তব রাষ্ট্র পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ইতোমধ্যে স্থগিত ঘোষিত জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান, সংবিধান প্রণয়ন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাংসদদের সম্ভাব্য অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ইত্যাদি নিয়ে সংলাপের বাহানায় পূর্ণ সমর প্রস্তুতি নিতে থাকল।
২৫শে মার্চ সন্ধ্যার অন্ধকার নামার পর শুরু হলো পাক বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের জেনোসাইড। যার কোড নাম ছিল অপারেশন সার্চলাইট। পূর্ব পাকিস্তান অগ্নিগর্ভ হয়েই ছিল। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রামের। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনতা, বিশেষ করে ছাত্র, যুবা, কৃষক, শ্রমিক ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল দলে দলে দেশমাতৃকার অপমানের উপযুক্ত জবাব দিতে।
সারা বিশ্বে তখন চলছে ঠান্ডা যুদ্ধ। এক পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব। অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অকপট সমর্থক হিসাবে পেলাম ভারতকে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঠিক কূটনৈতিক পদক্ষেপে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব আমাদের সমর্থনে এলো।পশ্চিমা বিশ্ব স্বভাবত রইল আমাদের বিপক্ষে। বিশ্বের নতুন মেরুকরণের কারণে পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে চীন-মার্কিন সুসম্পর্ক তখন গড়ে উঠছে। এরা সবাই বাঙালিদের স্বাধিকারের এই সংগ্রামকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার দেখিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়াল। কিন্তু সারা বিশ্বের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আওয়াজ তুলল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। পাকিস্তানি জেনোসাইডের নৃশংসতা বন্ধে সোচ্চার হলো বিশ্বের জনগণ।
অতি অল্পসংখ্যক পাকিস্তানি নাগরিকও বাদ থাকেননি। তারাও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন। নিজ দেশের এক অংশের নাগরিকদের ওপর পাক সেনাবাহিনীর অবর্ণনীয় আচরণের বিরুদ্ধে তারাও আওয়াজ তুললেন। তাদের মধ্যে ছিলেন প্রগতিশীল ছাত্র, কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা।
এরকমই একজন আজকের আলোচ্য নায়ক, সৈয়দ আসিফ শাহকার ছিলেন সেই প্রতিবাদকারীদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন তখন পাঞ্জাব প্রদেশের ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক। পাঞ্জাবের হরাপ্পায় জন্ম নেয়া এই তরুণ তখন লাহোরে লেখাপড়া ও ছাত্র সংগঠন করেন। স্বজাতি, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী সবার ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করে তিনি সংগঠিত করলেন ছাত্র র্যালি। লিখলেন কবিতা, প্রবন্ধ। তাঁর ক্ষীণ কণ্ঠ ঠিকই পাক জেনারেলদের কাছ পৌঁছাল। এই অকুতোভয় তরুণকে কারাবন্দী করা হলো। চলল অমানুষিক নির্যাতন। স্তব্ধ করা গেল না আসিফকে।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ বাংলাদেশ পাক হানাদারমুক্ত হলে পাক বাহিনীর ৯৩ হাজার সৈন্য যুদ্ধবন্দি হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ কমান্ডের হাতে। পাক মিডিয়া ও কর্তৃপক্ষ সেই পরাজয় ও আত্মসমর্পণ স্বীকার না করে তার নাম দেয় ফল অভ ঢাকা। আজও পাকিস্তানি শিশুরা এই ভুল ইতিহাস শিখে বড় হচ্ছে।
ওদিকে ভুট্টো ক্ষমতায় এসে রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়ায় আসিফ শাহকার জেল থেকে মুক্তি পান। ফিরে যান পড়াশোনায়। লাহোর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাশ করে পাকিস্তান টেলিভিশন ইনস্টিটিউট থেকে টিভি ও ফিল্ম প্রোডাকশনে কোর্স করেন। কিছুদিন এই লাইনে চাকরিও করেন। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় জেনোসাইডবিরোধী ভূমিকার জন্য তাঁর কপালে তকমা জোটে দেশবিরোধীর। সমাজ, দেশ, প্রতিবেশী এমনকি পরিবারেও তিনি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে চিহ্নিত থাকেন। ওই অসহ্য, দমবন্ধ অবস্থায় তিনি দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
সুইডেনে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেন আসিফ। সেখানেও টিভি প্রোডাকশন ও মার্কেটিং বিষয়ে তিনি পড়াশোনা করেন। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকতা, টিভি প্রোডাকশন, তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টরে কাজ করেন তিনি। শেষ অবধি সুইডেনের বিচার বিভাগে যোগ দেন আসিফ । কর্মজীবন শেষ করেন সুইডিশ হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে। ইতোমধ্যে তিনি ব্যপ্তি লাভ করেন লেখক, কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। বাংলাদেশের পাকিস্তানি জেনোসাইডের কোনো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না হওয়ায় এবং অদ্যাবধি পাকিস্তান এজন্য ক্ষমাপ্রার্থী না হওয়ায় তিনি ক্ষুব্ধ।
২০১২ তাঁর জন্য একটা বিশেষ প্রাপ্তির বছর। যে বাংলাদেশ তাঁর অন্তরে, যার জন্য তিনি লড়াই করে অত্যাচার সয়েছেন, সেই দেশ তাঁকে ডাকল। তিনি সম্মানিত হলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের মৈত্রী সনদে। সাথে যথাযথ সম্মান। প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করে তিনি হলেন আবেগে আপ্লুত। বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ তাঁকে মুগ্ধ করল। তাঁর মনে হলো এটাই তাঁর আসল দেশ, যেখানে তিনি সন্মান পেলেন। তিনি স্বপ্ন দেখতে লাগলেন মৃত্যুর পর এই দেশেই লাখো মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের মাঝে সমাহিত হতে। এই স্বপ্ন সফল করতে তিনি একদিন চিঠি লিখলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে। প্রার্থনা করলেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ও মৃত্যুর পর এদেশে সমাহিত হওয়ার অনুমতি। সম্ভবত সেই চিঠি সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত হয়নি। তিনি এর কোনো উত্তর পাননি।
সুযোগ আবার এল ২০২২ সালে। এই বছর ৩ অক্টোবর তারিখে জেনেভায় জাতিসংঘ হেডকোয়ার্টারে একটি সাইড ইভেন্ট হচ্ছিল জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনের পাশাপাশি। বিষয় ছিল ১৯৭১-এর বাংলাদেশ জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান নেদারল্যান্ডসের রাজধানী হেগভিত্তিক প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন, বিএএসইউজি—বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল সেমিনারে বক্তা হিসাবে। নিজের অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জোর সওয়াল করেন তিনি।
সেবারকার জেনেভা সফরে বিএএসইউজি চেয়ারম্যান বাংলাদেশি-ডাচ নাগরিক বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়ার সাথে তাঁর স্বপ্নের ব্যাপারে আলাপ করেন আসিফ। বিকাশ তাঁকে যোগাযোগ করিয়ে দেন বাসস-এর বলিষ্ঠ সাংবাদিক মাহফুজা জেসমিনের সাথে। মাহফুজার ঢাকার বিভিন্ন সরকারি দফতরে বিষয়টি উপস্থাপন করার সুযোগ ছিল, যেটা হল্যান্ডে থেকে বিকাশের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
'আমরা একাত্তর' মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত একটি সংগঠন। তাঁরা বিএএসইউজি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের সাথে মিলে বাংলাদেশে ১৯৭১-এর পাকিস্তানি জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি নিয়ে বিশ্বব্যাপী সোচ্চার।
আমরা একাত্তরের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ আসিফ শাহকারের অন্তিম ইচ্ছার বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যথাযথ গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করে। এদিকে আসিফ শাহকার তাঁর পূর্বপরিচিত (২০১২ সালে তিনি মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা পাওয়াকালীন সময় থেকে পরিচিত) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব লে. ক. সাজ্জাদ জহিরের সাথেও যোগাযোগ করে তাঁর সহযোগিতা চান। তাঁর নাগরিকত্বের বিষয়টির সাথে স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের দিকনির্দেশনা প্রয়োজন ছিল। লে. ক. সাজ্জাদ জহির বিপি তাঁর বিভিন্ন কাজ সম্পন্ন করতে এসব অফিসে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন। তাঁর বিশেষ হস্তক্ষেপে আসিফ শাহকারের ফাইলটি বিশেষ গতি পায়।
ফলশ্রুতিতে গত ১ নভেম্বর বিচারপতি সৈয়দ আসিফ শাহকারের বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য করা দরখাস্ত বাংলাদেশ সরকার মঞ্জুর করেছেন। তাঁর স্বপ্ন এখন বাস্তবে পরিণত হতে আর কোনো বাধা থাকল না। তিনি মৃত্যুর পর তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের মাটিতে সমাহিত হতে পারবেন। তিনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন বিদেশি সৈনিক। পরম বন্ধু।
খবরটি পেয়ে আসিফ শাহকারের আনন্দের পরিসীমা নেই। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। ধন্যবাদ জানিয়েছেন তাঁর সহযোগিতায় যাঁরা এগিয়ে এসেছেন তেমন সকলের প্রতি।
আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা রইল এই বন্ধুর প্রতি।