প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী যথার্থ ও ন্যায্য আয়ের সম্পদ বিবরণ কিনা তা কখনও জানতে পারি না!
দেশের সর্বত্র নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করেছে। যদিও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়ে শঙ্কা এখনও পুরোপরি কাটেনি। তবে দেশের জাতীয় গণমাধ্যমগুলো নির্বাচনী হাওয়া তৈরি করতে 'ব্যস্ত' হয়ে পড়েছে। দেশের বৃহত্তম একটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচন নিয়ে ভিন্নমতের কথা গণমাধ্যমগুলোতে তেমন চোখে পড়ে না। গত শতাব্দীর ৯০ দশকের মাঝামাঝিতে উচ্চ আদালতের এক নির্দেশে বর্তমানে নির্বাচনী বিধি অনুসারে প্রতি প্রার্থীর ব্যক্তিগত সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে হয়। নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণীর এই তথ্য গণমাধ্যমের বড় স্থান দখল করে নিয়েছে। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম ও টেলিভিশন টকশোগুলোতে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রার্থীদের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী গণমাধ্যমগুলো প্রতিযোগিতা করে প্রকাশ করছে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, মন্ত্রী, নেতা প্রায় সকলের সম্পদ বিবরণীর প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে প্রতিদিন।
প্রতিটি বিবরণীতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কে কত সম্পদ আহরণ করেছেন, কে কত গুণ সম্পদ বৃদ্ধি করেছেন, কার কাছে কত নগদ স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ রয়েছে– তার উল্লেখ থাকলেও বৃদ্ধির কারণ যথাযথভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে না। এর ফলে জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি মানুষের সম্পদের বিবরণ ও বৃদ্ধি আয়কর বিভাগের কাছে দেওয়া আছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে দেওয়া তথ্যগুলোর ভুল-ভ্রান্তি বা যাচাই-বাছাই করার কোনো বিধান নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই বলেই জানি। ফলে প্রার্থীর দেওয়া এই তথ্যগুলোর তেমন কোনো গুরুত্ব বহন করে না।
একজন গুরুত্বপূর্ণ সংসদ সদস্য যিনি আজীবন চিকিৎসা পেশায় জড়িত তার সম্পদ বিবরণীতে স্ত্রীর স্বর্ণালঙ্কারের দাম ধরা হয়েছে প্রতি ভরি ২১ হাজার টাকা। আমরা সকলেই জানি, সোনার উচ্চ মূল্যের কথা। কেউ ব্যবসা ছেড়ে রাজনীতিবিদ হওয়ার পরেও সম্পদের বৃদ্ধি ঘটেছে ১২২ শতাংশ(!)। তথ্যগুলো চমকপ্রদ সন্দেহ নেই। এই চমকগুলোই গণমাধ্যমের আগ্রহের মূল জায়গা। যত চমক তত কাটতি।
সম্পদ বিবরণীর প্রকাশের যে মহৎ উদ্দেশ্য তা কতটা বাস্তবায়িত হয়। সম্পদ বিবরণী প্রকাশ এবং তা নিয়ে গণমাধ্যমে শিরোনাম হওয়ার পেছনে যে উদ্দেশ্য তা অস্পষ্ট। নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে এই সম্পদ বিবরণী প্রকাশের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয় কিনা সেটি একটি প্রশ্ন। কারণ সম্পদ বিবরণীতে কিছু যায় আসে না। বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে সবগুলোয় সম্পদ বিবরণী দেওয়ার বিধিবিধান চালু আছে, কিন্তু এই সম্পদ বিবরণী প্রকাশের পরে তার কোনো অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেল কিনা কিংবা যারা যে সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করেছেন তা যথার্থ ও ন্যায্য আয়ের সম্পদ কিনা তা কখনও আমরা জানতে পারি না।
প্রার্থীদের আয়ের নৈতিকতা নিয়ে কোনো গবেষণা আমাদের নেই। সম্পদ বিবরণী গণমাধ্যমে প্রকাশ করার ভেতর থেকে রাজনীতিবিদদের প্রতি একটি অনাস্থার জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই সম্পদ বিবরণী এভাবে গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা নেই। ওই দেশগুলোতে আয়কর বিভাগ এতটাই কার্যকর যে অবৈধ সম্পদ অর্জন করা খুব কঠিন। সে কারণে প্রার্থীদের আয়ের বৃদ্ধি বা কমতি গণমাধ্যমের মনোযোগ পায় না।
ব্রিটেনের নির্বাচনী ব্যবস্থা পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, সেখানে প্রার্থীকে তার নির্বাচনী ব্যয় সংকলনের সূত্র ঘোষণা করতে হয় এবং দেখা হয় যে সূত্র থেকে তিনি এই অর্থ সংগ্রহ করেছেন তাদের সেই অর্থ প্রদান করার বৈধ সঙ্গতি আছে কিনা? আমাদের দেশের মতন ভারতেও একইভাবে সম্পদ বিবরণী পেশ করতে হয় এবং তা নিয়ে গণমাধ্যম একই ধরনের প্রকাশনার ব্যস্ত হয়, তবে আমাদের দেশের ব্যস্ততা একটু বেশি। গত কয়েকদিনের গণমাধ্যমের প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি।
দেশের অর্থ ব্যবস্থাপনার প্রধান অঙ্গই হলো কর বিভাগ। দেশে কর ব্যবস্থাপনার সঠিক এবং কার্যকর অবস্থান থাকলে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী গণমাধ্যমে প্রকাশের এই মহোৎসব সৃষ্টি হতো না। প্রার্থীরা এখানে যে বিবরণী দিয়েছেন তা আয়কর বিভাগে জমা দেওয়া ব্যক্তিগত কর বিবরণীতে যথার্থভাবে উল্লেখ আছে কিনা নির্বাচন কমিশন তা যাচাই করার সুযোগ কতটুকু পায় সেটাও এক প্রশ্ন। ব্যক্তিগত আয়কর বিবরণীর সাথে অসংগতি থাকলে নির্বাচন কমিশন কী ব্যবস্থা নিতে পারবে তার স্পষ্ট উল্লেখ থাকা দরকার। অতীতে দেখা গেছে, এ ধরনের অসঙ্গতি অনুসন্ধান করতে কয়েক বছর পার হয়ে যায়। অসঙ্গতিপূর্ণ বিবরণী নিয়ে প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিলেন, পাস করলেন, ভাগ্য ভালো থাকলে মন্ত্রীও হলেন- নির্বাচন কমিশন তখন সেই প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল করতে পারবেন? অনেক কারণেই তা কঠিন।
প্রতিবার নির্বাচনের সময় যে সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করা হয় তা নিয়ে কিংবা তার পরবর্তীতে কখনও এ বিষয়ে আয়কর বিভাগের কোন মন্তব্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না ফলে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা বৃদ্ধি পায়।
সম্পদ বিবরণী প্রকাশের পরে তার কোন অসঙ্গতি খুঁজে পাওয়া গেল কিনা কিংবা যারা যে সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করেছেন তা যথার্থ ও ন্যায্য আয়ের সম্পদ কিনা তা কখনও আমরা জানতে পারি না।
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়