আমার প্রিয় রাজা কুমার শরৎকুমার রায়
২০১২ সালের আগুনঝরা এক গ্রীষ্মদিনে নির্নিমেষ চেয়েছিলাম দুই হাজার বছর আগের আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত পম্পেই নগরীর কোনো এক কানাগলিতে। ইতিহাসের অনেক ভুলে যাওয়ার অধ্যায়কে অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ছিল ১৯০০ সালে সেখান ইতিহাসের টানে ঘুরতে আসা বরেন্দ্রভূমির এক সন্তানের কথা; নাম তার কুমার শরৎকুমার রায়।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করে একই বছর ইউরোপ ভ্রমণে এসেছিলেন শরৎকুমার রায়, জ্ঞানের চোখে ইতিহাসের টানে বুভুক্ষুর মতো ঘুরে বেরিয়েছিলেন থিবস, পম্পেই, প্রাচীন মিশর। অতীতের চিহ্নকে বর্তমানে দেখে তাদের মূল্য অনুভব করেছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের তাড়না থেকে, যা বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
ভিনদেশের মাটিতে জীবন্ত ইতিহাসকে অনুভবকে করেই ক্ষান্ত হননি সেই তরুণ, বরেন্দ্রভূমিতে ফিরে নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিশাল বাংলার ইতিহাসকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করার। গড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর, বিশ্বখ্যাত বরেন্দ্র জাদুঘর।
নাটোরের বিখ্যাত দিঘাপতিয়া রাজপরিবারে ১৮৭৬ সালের ২২ এপ্রিল (১১ বৈশাখ, ১২৮৩ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন কুমার শরৎকুমার রায়। বাবা ছিলেন রাজা প্রমথনাথ রায় এবং মা রানি দ্রবময়ী দেবী। প্রমথনাথ রায় ঠিক জন্মগত উত্তরাধিকারসূত্রে রাজা হননি, দিঘাপতিয়ার রাজা প্রসন্ননাথ নিঃসন্তান থাকার দরুন তাকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। রাজা প্রমথনাথ রায় রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন, রাজশাহী দাতব্য চিকিৎসালয় এবং বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়ে নিজেও ব্যাপক অর্থসাহায্য করেছিলেন। ১৮৮৩ সালে মৃত্যুর পরে তার জমিদারি দুই পক্ষের উত্তরাধিকারীদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে যান। প্রথম পক্ষের পুত্র প্রমদানাথ দিঘাপতিয়াতেই থেকে যান। উইল অনুযায়ী দ্বিতীয় স্ত্রীর তিন পুত্র বসন্তকুমার রায়, শরৎকুমার রায় এবং হেমেন্দ্রকুমার রায় দিঘাপতিয়া থেকে আলাদা হয়ে অভিরামপুরে বসবাস শুরু করেন। তাদের পূর্বপুরুষের নামানুসারে স্থানটির নামকরণ হয় দয়ারামপুর। জ্যেষ্ঠভ্রাতা বসন্তকুমার নিঃসন্তান অবস্থায় মারা গেলে কুমার শরৎকুমার রায় এস্টেট পরিচালনার সমগ্র দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
পদ্মাপারের রাজশাহীতেই উনার বেড়ে ওঠা, কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের পর কলকাতা গমন করেন। উচ্চতর শিক্ষালাভের পর নিজ বাসভূমে ফিরে আসেন। ইতিহাসের প্রতি প্রগাঢ় টান এবং বিদেশ ভ্রমণের অমূল্য অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল প্রাচীন পুঁথি, উপকথা, কিংবদন্তি ইত্যাদি সংগ্রহ, সংকলন ও সংরক্ষণ। বরেন্দ্রভূমিতে প্রত্যাবর্তনের পরপরই কুমার শরৎকুমার রায় পুরোনো বইপত্র, যার সিংহভাগই ছিল তালপাতা এবং তুলট কাগজে লেখা প্রাচীন পুঁথি, সংগ্রহের কাজ শুরু করেন এবং তা দিয়ে রাজশাহী শহরের মিয়াপাড়ায় নির্মিত দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদের একাংশে জমা করে একটি গ্রন্থাগার গড়ে তোলেন।
ভাগলপুরের সমৃদ্ধ পুরাকীর্তির ভান্ডার দেখে তার মনে পড়ে যায় ইউরোপ-আফ্রিকার জাদুঘরগুলোর কথা, মনের মাঝে দানা বাঁধে এক মহাপরিকল্পনা। সে পরিকল্পনার সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় (সে সময় রাজশাহী কোর্টের উকিল) এবং নৃতাত্ত্বিক ও পুরাতত্ত্ববিদ রমাপ্রসাদচন্দ্র (রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক)। পরিকল্পনা মোতাবেক ১৯১০ সালে শরৎকুমার রায়, অক্ষয়কুমার, রমাপ্রসাদ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের রামকমল সিংহ এবং কলকাতা জাদুঘরের অধীক্ষক রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়কে নিয়ে একটি ক্ষুদে অনুসন্ধানী দল গঠন করা হয়। তারা রাজশাহী জেলার পালপাড়া, দেওপাড়া, চব্বিশনগর, কুমুরপুর, খেতুর, মান্দোইল, জগপুর, মালঞ্চ ইত্যাদি জনপদ ঘুরে ৩২টি দুষ্প্রাপ্য পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন সংগ্রহ করেন।
সে সমস্ত পুরাকীর্তি নিয়ে অনুসন্ধানী দল রাজশাহী ফিরলে প্রত্নবস্তগুলোর সংরক্ষণ এবং অবস্থান নিয়ে বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। রাখালদাস বন্দোপাধ্যায় প্রস্তাব রাখেন উল্লেখযোগ্য সংগ্রহগুলো তিনি কলকাতা জাদুঘরের জন্য নিয়ে যাবেন। একইভাবে রামকমল সিংহও কিছু নিদর্শন পরিষদের সংগ্রহশালার জন্য নিয়ে যাবার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কিন্তু রমাপ্রসাদচন্দ্র এ ব্যাপারে জোরালো প্রতিবাদ উপস্থাপন করেন। শেষে অন্যান্যদের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে কুমার শরৎকুমার রায় এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, সংগৃহীত পুরাকীর্তি কোথাও নিয়ে যেতে দেওয়া হবে না, বরং এগুলো দিয়ে রাজশাহীতেই একটি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হবে, যার কাজ হবে বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাসে আলোকপাত করা।
সেই যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে কুমার শরৎকুমার রায়ের স্বপ্ন। প্রথম দিকে প্রশিক্ষণবিহীন কয়েকজন উৎসাহী কর্মী দিয়ে কীভাবে এ বিপুল কর্মযজ্ঞ চালাবেন তা নিয়ে বিস্তর চিন্তায় পড়লেও তার সামনে উদাহরণ হিসেবে ছিলেন ডা. বুকানন হ্যামিল্টন, জেনারেল কানিংহামসহ অন্যান্য অতীতসন্ধানীরা, যারা সকল বাধা পায়ে দলেছিলেন কেবল নিষ্ঠা এবং জ্ঞানের প্রতি ভালবাসা থেকে।
এক ভাষণে কুমার শরৎকুমার রায় বলেছিলেন:
'সত্য আবিষ্কার এবং তাহার দ্বারা মনুষ্য জাতির জ্ঞানভান্ডার পরিপুষ্ট করাই অনুসন্ধান সমিতির মুখ্য উদ্দেশ্য। জ্ঞানভান্ডারে পুষ্ট না হইলে মনুষ্যজাতি উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে না। সুতরাং মনুষ্যসমাজকে উন্নত করিতে হইলে অনুসন্ধান সমিতির বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রহিয়াছে। … তৎকালীন বাংলাদেশের কৃষ্টির প্রভাব যে ভারতের বাহিরে বর্তমান নেপালে, তিব্বতে, চীনে, জাপানে, কম্বোডিয়ায় এমনকি সুমাত্রা, জাভা, বালি প্রভৃতি সুদূর দ্বীপপুঞ্জেও বিস্তার লাভে সমর্থ হইয়াছিল ইহা সর্বজনবিদিত। তারপর বাঙ্গালীর অধঃপতনের কাহিনীও ভাবিবার বিষয়। যে জাতি একসময়ে এতদূর উন্নতির পথে অগ্রসর হইয়াছিল, সে জাতি ক্রমে অবনতির এত নিম্নস্তরে নামিয়া গেল কেন? … আমাদিগকে অনুসন্ধান করিয়া এই সকল তথ্যের প্রকৃত কারণ জানিতে হইবে এবং কারণ জানিয়া তাহার সাহায্যে আমাদের জাতীয় জীবনকে গড়িয়া তুলিতে হইবে। নচেৎ আমরা যতই স্বায়ত্তশাসন লাভ করি না কেন উহা বজায় রাখিতে পারিব না। আমাদের অপেক্ষা অধিক বুদ্ধিমান, অধিক বলবান ও যোগ্যতর জাতি আসিলে পুনরায় আমাদিগকে তাহাদের পদানত হইতে হইবে।'
উল্লেখ্য, বরেন্দ্র অনুসন্ধান কমিটি ১৯১৪ সালে রেজিস্ট্রিভুক্ত হয় এবং সমিতির সকল আর্থিক দায়ভার প্রথমদিকের বছরগুলোতে কুমার শরৎকুমার রায় নিজেই বহন করেন। পরবর্তীতে অগ্রজ রাজা প্রমদানাথ রায়ের প্রদত্ত জমিতে নিজেই সে আমলের তেষট্টি হাজার টাকা ব্যয় করে গৌড়ের প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণে অপূর্ব সুষমামণ্ডিত ভবন নির্মাণ করেন। জানা যায়, এ ভবনের নকশাকারও ছিলেন স্বয়ং কুমার শরৎকুমার রায়। ১৯১৬ সালের ১৩ নভেম্বর সে সংগ্রহশালা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল এবং তিনবছর বাদে ১৯১৯ সালের ২৭ নভেম্বর এর দ্বারোদঘাটন করেন বাংলার আরেক গভর্নর লর্ড রোনাল্ডসে।
কুমার শরৎকুমার রায়কে কোথাও রাজা বলে উল্লেখ করা হয় না। উনি আসলে রাজকুমারই ছিলেন, কিন্তু তিনি ছিলেন গণমানুষের রাজা, মনের রাজা। তাকে অধিকাংশ প্রজাই বেশ পছন্দ করতেন, যদিও পুরাতত্ত্ব বিষয়ে অধিক উৎসাহের কারণে তাকে পাগলা বলতেও দ্বিধা করতেন না। জানা যায়, অনেক সময়েই মজাপুকুর খননের সময় মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেলে হাতি পাঠিয়ে সে মূর্তি জাদুঘরে আনার ব্যবস্থা করতেন কুমার শরৎকুমার রায়। আর মানুষ বলত: 'দ্যাখ, পাগলা রাজার কীর্তি; রাজারা বাইজী নাচায় আর উনি ভাঙা মূর্তি নিয়া যান হাতি দিয়া!'
সংগ্রহশালা স্থাপনের পরপরই ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুবাদে ভারতবর্ষের নানা স্থান থেকে বেশকিছু দুর্লভ নিদর্শন কুমার শরৎকুমার রায়ের কাছে আসে উপহার হিসেবে। এখনো বরেন্দ্র জাদুঘরে গেলে সে উপহারগুলোর নামফলকে শরৎকুমারের নামসহ দাতার নাম দেখতে পারবেন।
সাহিত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগের পরিচয় সারাজীবনই দিয়েছেন তিনি, যদিও নিজে লিখেছেন খুব কম। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ছয়খানা: ভারতীয় সাধক, তৌলিক জাতি, রবীন্দ্রস্মৃতি, বুদ্ধের জীবন ও বাণী, মোহন লাল, এবং শিবাজী ও মাহাট্টজাতি। যদিও সে যুগের নানা পত্রপত্রিকায় তার রচনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। রবিঠাকুরের সঙ্গে তার প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বখ্যাত বন্ধুর দ্বারা এতটাই প্রভাবিত ছিলেন কুমার শরৎকুমার রায় যে, নিজপুত্র বিধুধনাথকে কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক করতে আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন (রবীন্দ্রনাথ যেভাবে পাঠিয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথকে)।
নিজের খামারে উৎপাদিত আখের সুষ্ঠু ব্যবহারের লক্ষে শরৎকুমার রায় প্রতিষ্ঠা করেন চিনিকল, যা ছিল উত্তরবঙ্গের প্রথম চিনিকল। এছাড়া কৃষিশিক্ষা প্রসারের জন্য অগ্রজের নামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বসন্তকুমার এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট।
ব্যক্তিগত জীবনে অন্ধবিশ্বাসমুক্ত মানুষ ছিলেন কুমার শরৎকুমার রায়। তার রান্নাবান্নার কাজে নিয়োজিত প্রায় সকল কর্মচারীই ছিলেন মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক। এমনকি বুধনরুহি দাস নামক একজন চর্মকারকে অন্যতম পাচক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তিনি হিন্দুশাস্ত্রের বর্ণপ্রথার প্রতি চরম প্রতিবাদ উত্থাপন করেছিলেন। তিলি বা তৌলিক সম্প্রদায়ে অন্তর্ভুক্ত হবার কারণে অনেক বর্ণহিন্দুই তাকে বাঁকা চোখে দেখত।
বিদ্যোৎসাহী কুমার শরৎকুমার রায়ের নিরন্তর সাধনা ছিল জ্ঞান অন্বেষণ। একবার তাকে প্রশ্ন কর হয়েছিল, কেমন করে একাকী তিনি রাজপ্রাসাদে রাত্রিযাপন করেন (অনেকপূর্বেই তার স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে, পুত্র-কন্যারা নানা শহরে থাকেন)। হাসিমুখে তিনি বলেছিলেন: 'এটা ভুল ধারণা, আমি একা রাত্রিযাপন করি না। আমার সঙ্গে তখন থাকেন বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, শেক্সপীয়ার, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, বায়রন, শেলী, কীটস। আমি তাদের সান্নিধ্যেই রাত কাটাই।'
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৬ সালের ১০ এপ্রিল (২৯ চৈত্র, ১৩৫২) তার জীবনাবসান ঘটে।
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমাদের দেশটার রাজাভাগ্য না নেতাভাগ্য বড়ই খারাপ। সবাই এসে চালিয়েছিল শোষণ আর বজ্রকঠিন শাসন, করেছে সীমাহীন লুটপাট। এদের মাঝে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম কুমার শরৎকুমার রায়। অথচ মহাসমুদ্রের মতো উম্মুক্ত হৃদয়ের অধিকারী মানুষটি নিজের নামে কিছুই করে যাননি রাজশাহী শহরে বা বরেন্দ্র অঞ্চলে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।