বাংলাদেশে প্রসারিত ‘গিগ অর্থনীতি’ বনাম তরুণদের বিসিএস জনপ্রিয়তা
বাংলাদেশে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী কিংবা চাকরি প্রত্যাশীদের মাঝে বিসিএস জনপ্রিয়তা নতুন কিছু নয়। স্নাতক সম্পন্নের পূর্বেই শুরু হয় তরুণ-তরুণীদের বিসিএস গাইড গলাধঃকরণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সিটের জন্য ভোর থেকে শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইনই বলে দেয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিসিএস নামক সোনার হরিণের জন্য আকাঙ্ক্ষা কতটুকু।
দাপ্তরিক ক্ষমতা, সরকারি চাকরির নিশ্চয়তা, সেই সাথে আসা সুযোগ-সুবিধার লোভ কিংবা বিসিএস ক্যাডারদের প্রতি সমাজে 'অস্বাভাবিক' সম্মান প্রদর্শন অথবা দেশের বেসরকারি চাকরি ক্ষেত্রের অনিশ্চিত ও অনুন্নত অবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকা— এরকম নানা কারণে বিসিএসের দিকে ঝুঁকছে তরুণ সমাজ।
চাকরি পরীক্ষার সুস্থ পদ্ধতি হিসেবে বিসিএস কতটুকু যৌক্তিক, তা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার শেষ নেই। তবে বিসিএসের জনপ্রিয়তা না কমলেও বাড়ছে তরুণদের মাঝে আউটসোর্সিং ভিত্তিক কাজের প্রতি ঝোঁক। স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে এ ধরনের নতুন আগ্রহ তরুণদের মাঝে দেখতে পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং যেখানে অনলাইনভিত্তিক কর্মক্ষেত্র হয়ে উঠছে বিশ্বের অন্যতম চালিকা শক্তি, বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে 'গিগ অর্থনীতি'।
গিগ ইকোনমির সাথে বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ পরিচিত না হলেও, দেশের বড় একটি অংশ বিশেষ করে শহুরে বা প্রযুক্তিগতভাবে উন্নতসমাজের বেশিরভাগই এ অর্থনীতির ভোক্তাসমাজ। পাঠাও, উবার, ফুডপান্ডা, দারাজ, রকমারি ইত্যাদি এ গিগ ইকোনমির অংশ।
গিগ ইকোনমি মূলত এক ধরনের অনলাইনভিত্তিক বাজার ব্যবস্থা, যেখানে কর্মসংস্থান সাময়িক ও শর্তসাপেক্ষ। প্রতিষ্ঠানগুলো স্বল্পমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে তাদের ইচ্ছামতো কর্মীদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজে নিয়োগ দেয় এবং কাজের মানের ওপর পারিশ্রমিক প্রদান করে। তবে গিগ ইকোনমির জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ, কর্মীরা তাদের কাজের ধরণ, পারিশ্রমিক, কাজের সময়কাল ও সময়সীমা এবং কাজের কর্মপরিবেশ ইত্যাদি পছন্দমতো দরদাম এবং নির্ধারণ করতে পারে।
করোনা মহামারিকালীন সময়ে সারা বিশ্বে বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি ছিল, ফলে ইন্টারনেটভিত্তিক কর্মসংস্থাণের জনপ্রিয়তা হঠাৎ বেড়ে যায়। যদিও করোনার আগেও বিশ্বব্যাপী কর্মসংস্থানের প্রায় ৩৪ শতাংশ ছিল গিগ অর্থনীতির দখলে।
বাংলাদেশের তরুণদের মাঝেও গিগ অর্থনীতির জনপ্রিয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ২০২১ সাল অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট ২৭ শতাংশ জনবল গিগ অর্থনীতির সাথে যুক্ত। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বোস্টন কনসালটিং গ্রুপের (বিসিজি) এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ফ্রিল্যান্সারদের ১৫ শতাংশই বাংলাদেশের। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শুধু ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেসে সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার কাজ করছেন।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, প্রথমত, ঢাকা কিংবা যেকোনো শহুরে পরিবেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রা মানের ব্যয় বেশি। সেক্ষেত্রে চাকরি প্রস্তুতির ইচ্ছা সত্ত্বেও বেশিরভাগ তরুণ খরচ সামাল দিতে যুক্ত হয়ে পরেন টিউশন ব্যবসা কিংবা নানা খণ্ডকালীন কাজে।
দ্বিতীয়ত, জনবলের তুলনায় চাকরির স্বল্পতার কারণে আজকাল যোগ্যতা প্রমাণের জন্য সার্টিফিকেট কিংবা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া কোথাও খুব একটা নিয়োগ দেয়া হয় না। সেক্ষেত্রে, তরুণদের জন্য অনলাইনভিত্তিক নানা কাজ করে পোর্টফলিও ভারী করাই হলো সর্বশেষ বাজি।
বিসিএস যেখানে নিশ্চিত করছে স্থায়ী কর্মপরিবেশ ও সুযোগ সুবিধা, গিগ অর্থনীতিতে তরুণেরা সময় ও পরিবহণ খরচ বাঁচিয়ে বাসায় বসেই কাজ করার সুযোগ পান, পাশাপাশি কারোর অধীন না থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বাধীনতা ভোগ করেন।
গিগ অর্থনীতি যেহেতু ইন্টারনেট ভিত্তিক, তাই বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বসে যেকোনো দেশের প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করা যায়, এমনকি সুযোগ থাকে ব্যবসা সম্প্রসারণেরও। প্রশিক্ষণ বাবদ স্বল্প বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের পুঁজি সংরক্ষণ করতে পারে। ঠিক তেমনি কর্মীরা তাদের পছন্দমতো নানা দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করতে পারেন।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিকে যে মর্যাদা দেয়া হয়, ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে গিগ অর্থনীতির কদর বেশি, তেমনি তাদের পারিশ্রমিকের পরিমাণ দেশের তরুণদের কাছে ন্যায্য হিসেবে বিবেচিত । তাই প্রয়োজন মোতাবেক দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ থাকলেই তরুণেরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী কাজ থেকে অর্থ উপার্জন করতে পারে।
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় অনলাইনভিত্তিক মার্কেটপ্লেস, ফাইবার। ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান হলেও বাংলাদেশের তরুণদের মাঝে এটি অন্যান্য মার্কেটপ্লেস যেমন- ফ্রিল্যান্সিং, আপওয়ার্ক, পিপল পার আওয়ার ইত্যাদি থেকে তুলনামূলক বেশি জনপ্রিয়।
ফাইবারের মাধ্যমে ঘরে বসেই তরুণেরা গ্রাফিক্স ডিজাইন, গান কম্পোজ, লেখালেখি, অনুবাদ, অ্যানিমেশন ইত্যাদি নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার সুযোগ পায়, পাশাপাশি পোর্টফলিও কাজের অভিজ্ঞতা হিসেবে এগুলো যোগ হয়।
পুঁজিবাদী অর্থনীতির ডিজিটাল বিন্যাস এই গিগ অর্থনীতি। গিগ অর্থনীতি এর সবচেয়ে বড় অসুবিধা, তরুণদের ঘরকেন্দ্রিক হয়ে যাওয়ার প্রবণতা। অল্প পরিশ্রমে বাসায় বসে অনায়াসেই বেশি পারিশ্রমিক অর্জন অবশ্যই উল্লেখযোগ্য একটি সুবিধা। তবে এতে করে তরুণদের যোগাযোগ ক্ষমতা কিবোর্ডে টাইপিং পর্যন্তই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ছে। অনলাইনের বাইরের দুনিয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।
গিগ অর্থনীতি মূলত উচ্চশিক্ষিত মজুরদের কর্মক্ষেত্র। পারিবারিক আর্থিক সামর্থ্য, যথাযথ দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক প্রযুক্তি অনুকূল হলে এ অর্থনীতিতে অবদান রাখা অধিকতর সহজ। কিন্তু বাংলাদেশের আলোকে, যেখানে চাকরি প্রত্যাশীদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত কিংবা আর্থিকভাবে সচ্ছল নন এবং নিজের ও পরিবারের জন্য একটি স্থায়ী ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে উদগ্রীব, সেখানে তারা এ অনিশ্চিত কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হতে উদাসীন।
তবে নানা সমালোচনা বাদেও, গিগ অর্থনীতি তরুণদের চাকরি নিয়ে একটি ভিন্ন মানসিকতা তৈরি করছে, ঠিক তেমনি তাদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিসিএসের জনপ্রিয়তা তরুণদের মাঝে এখনও যথেষ্ট প্রবল। তাই এখনও দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় সকালে লাইব্রেরির সামনে বিসিএস প্রত্যাশী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের লম্বা লাইনের ছবি প্রাধান্য পায়।
গিগ অর্থনীতি যেভাবে সারা বিশ্বে প্রসার লাভ করছে, বাংলাদেশেও ইন্টারনেটের মতই এর জনপ্রিয়তা বাড়বে। তবে যতক্ষণ না পর্যন্ত সরকার দেশের অনলাইনভিত্তিক চাকরি ব্যবস্থাতে বিনিয়োগ করছে, দেশে এ চাকরি সংকটকালে তরুণদের অন্যান্য কর্মসংস্থানে নিয়োগের জন্য উৎসাহিত করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত না বিসিএস কিংবা অন্যান্য সরকারি চাকরিতে নিয়োগের নামে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করা যাবে, না দেশের চাকরি সংকট ঘুচবে।
আয়েশা হুমায়রা ওয়ারেসা, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত।
এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদকীয় নীতিকে প্রতিফলিত করে না।