আর্থিক দুরবস্থা মোকাবিলার ১২টি কার্যকর উপায়
আর্থিক দুরবস্থা এমন একটি সংকট যা আমাদের জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যখন কেউ আর্থিক মন্দায় পড়ে, তখন তাকে অসহায় বোধ করতে হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানো যায়, তার জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক মন্দা থেকে মুক্তি পেতে সচেতনভাবে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে, যা মানুষকে সামগ্রিকভাবে আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে সাহায্য করবে।
এখানে আলোচনা করা হয়েছে ১২টি কার্যকর উপায়, যা আর্থিক দুরবস্থার মোকাবেলায় সহায়ক হতে পারে।
১.
আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। অনেক মানুষ তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হন।
তাই প্রথম ধাপটি হবে আয় ও ব্যয়ের খাতগুলোকে পর্যালোচনা করা এবং একটি স্পষ্ট বাজেট তৈরি করা। ব্যয়ের খাতগুলো বিশ্লেষণ করলে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনতে সহায়তা হবে, যা আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে।
ফিনান্সিয়াল প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন-এর গবেষণায় (২০১৯) বলা হয়েছে, সঠিক বাজেটিং প্রায় ৪০% মানুষের আর্থিক সংকট নিরসনে সহায়তা করে।
২.
দ্বিতীয় ধাপ হলো অতি প্রয়োজনীয় খরচের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। অনেক সময় আমরা এমন খরচ করি যা না করলেও চলে।
অর্থনৈতিক সংকটের সময়, অপ্রয়োজনীয় খরচগুলো বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সবচেয়ে জরুরি খরচগুলোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত।
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান-এর এক গবেষণায় (২০২০) বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর মাধ্যমে ২০-৩০% আয় সঞ্চয় করা সম্ভব হয়।
৩.
পাওনাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে যদি কেউ দেনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন, তবে পাওনাদারদের সঙ্গে সময়মতো যোগাযোগ করা উচিত।
ইএমআই বা লোনের ক্ষেত্রে, পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো যায় কি না, তা নিয়ে আলোচনা করলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সহজ হতে পারে। এ পদ্ধতি অনেক মানুষকে আইনি সমস্যার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
৪.
অর্থনৈতিক বিষয়ে পরামর্শ নেওয়া জরুরি, বিশেষত যখন কেউ সংকটের মধ্যে থাকে এবং কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তা বুঝতে পারে না।
অর্থনৈতিক পরামর্শদাতারা সম্পূর্ণ আর্থিক অবস্থা বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারেন।
ইন্টারন্যাশনাল ফিনান্স কর্পোরেশন-এর গবেষণায় (২০২০) বলা হয়েছে, সঠিক পরামর্শ পাওয়া ব্যক্তিরা ৩০-৪০% দ্রুত আর্থিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
৫.
অতিরিক্ত আয়ের ব্যবস্থা করাও আর্থিক সংকট মোকাবিলার একটি চমৎকার উপায়।
দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন আয়ের উৎস খুঁজে বের করা যেতে পারে। পার্ট-টাইম কাজ, টিউশন বা আউটসোর্সিংয়ের মতো কাজগুলো নতুন আয়ের সুযোগ করে দিতে পারে।
৬.
আপদকালীন ফান্ড গঠন করা সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।
ইমার্জেন্সি ফান্ড না থাকলে, আর্থিক সংকটের সময় খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ৩-৬ মাসের জরুরি খরচগুলোর জন্য একটি আপদকালীন ফান্ড গঠন করলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক সংকট সহজে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
ইকোনোমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-এর প্রতিবেদনে (২০১৯) বলা হয়েছে, যারা ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করেন, তারা ৫০% কম আর্থিক চাপ অনুভব করেন।
৭.
অপ্রয়োজনীয় ঋণ থেকে বিরত থাকা অত্যন্ত জরুরি।
ক্রেডিট কার্ড, উচ্চ সুদের ঋণ, এবং অন্যান্য ঋণগ্রস্ত অবস্থার মধ্যে থাকলে আর্থিক মন্দা আরও গভীর হয়। ঋণগুলো দ্রুত পরিশোধ করা উচিত এবং অপ্রয়োজনীয় ঋণ থেকে বিরত থাকা উচিত।
বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় (২০২০) বলা হয়েছে, অপ্রয়োজনীয় ঋণমুক্ত থাকা মানুষদের আর্থিক সংকট মোকাবিলা করার ক্ষমতা দ্বিগুণ হয়।
৮.
বিলের খরচ কমানো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়।
বৈদ্যুতিক বিল, ইন্টারনেট, ক্যাবল টিভির মতো দৈনন্দিন খরচগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে মাসিক খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। ১০টি ছোট ছোট খরচ কমিয়ে বড় একটি অর্থ সঞ্চয় করা যেতে পারে।
ফোর্বস-এর রিপোর্ট (২০২১) অনুযায়ী, নিয়মিত বিলের খরচ কমিয়ে বছরে প্রায় ১০-১৫% খরচ সঞ্চয় করা সম্ভব।
৯.
অপ্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করা একটি সঠিক উপায় হতে পারে।
বাসা বা অফিসে জমে থাকা অপ্রয়োজনীয় গ্যাজেট বা আসবাবপত্র বিক্রি করে তা থেকে প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহ করা সম্ভব।
১০.
নিজেকে প্রশিক্ষিত করা হলো সবচেয়ে ভালো বিনিয়োগ। দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন আয়ের পথ খুলতে পারে।
বর্তমানে ইন্টারনেটে ফ্রিতে অনেক ট্রেনিং পাওয়া যায়, যা শেখার মাধ্যমে নিজেকে আরও দক্ষ করে তুলতে পারে। এতে আয় বাড়ানোর পাশাপাশি খরচও কমানো সম্ভব হবে।
১১.
ইমোশনাল ওয়েলবিং-এর প্রতি যত্নশীল হওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মানসিক চাপ থাকলে অপ্রয়োজনীয় খরচ বেড়ে যায়।
নিজেকে সুস্থ ও মানসিকভাবে ভালো রাখলে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো সহজ হয়।
ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন-এর গবেষণায় (২০২০) বলা হয়েছে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখলে আর্থিক চাপ কম অনুভূত হয়।
১২.
পজিটিভ চিন্তা করা এবং ধৈর্যশীল হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। খারাপ সময়ে পজিটিভ মাইন্ডসেট এবং ধৈর্যশীলতা আমাদের অনেক সুযোগের পথ খুলে দিতে পারে। পজিটিভ চিন্তাধারা আর্থিক মন্দার সময় মনকে স্থির রাখে এবং নতুন আয়ের উৎস খুঁজতে সহায়তা করে।
আলোচ্য এ ১২টি উপায় অনুসরণ করলে আর্থিক দুরবস্থার মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে এবং মানুষকে একটি সফল আর্থিক জীবন গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
সাইফুল হোসেন: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।