অবাঙালি ঘাতকের রোজনামচা
স্বাধীনতার পক্ষে 'ফিকটিশাস' বানোয়াট কাহিনী হরহামেশাই শোনা যায়, এমনকি স্বাধীনতার বিরোধিতা করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ গ্রহণকারীর দেখা পাওয়া দুর্লভ কোনো ঘটনা নয়। এই রচনাটি একাত্তরে বাংলাদেশে সক্রিয় একজন বাংলাদেশ বিরোধীর রোজনামচা। ইংরেজি ভাষায় লিখিত। আমি সাধ্যমতো মূল রোজনামচার অনুগত থেকে বাংলায় ভাষান্তর করেছি। রোজনামচার ঘটনাগুলো বানোয়াট মনে হবার কোনো কারণ নেই।
রোজনামচা লেখকের নাম- কামারুজ্জামান। তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় পার্বতীপুরের অবাঙালি বাসিন্দা ছিলেন। তিনি ছিলেন পার্বতীপুর টাউন কমিটির চেয়ারম্যান ও প্রশাসক। তার ইংরেজি রোজনামচা বলে দেয় তিনি প্রচলিত অর্থে শিক্ষিত। পার্বতীপুর ১৯৭১ সালের অবাঙালি অধ্যুষিত শহর।
২৬ মার্চ ১৯৭১
মেজর শাফায়াতের সাথে দেখা করে পার্বতীপুরের পরিস্থিতি তাকে জানালাম। তাকে অনুরোধ করলাম তিনি যেন তার লোকদের উপর বেশি বিশ্বাস না রাখেন, কারণ মোটের উপর তারা বাঙালি এবং তারা মেজর সাহেবকে হত্যাও করতে পারে। তিনি আমার কথায় হেসে উঠলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সামরিক আইনের আহ্বানের পরিপন্থী হলেও বাঙ্গালিরা সকলে অস্ত্র সমর্পণ না করা পর্যন্ত আমরাও অস্ত্র সমর্পণ করব না। পার্বতীপুর শহরের পূর্বাঞ্চলীয় গ্রামগুলোতে বাঙ্গালিদের বেশি রকম জমায়েত হচ্ছে। তবে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে এবং সজাগ দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
২৭ মার্চ ১৯৭১
সকাল ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আমেরিকান ক্যাম্পের উত্তর আঙ্গিনায় (শহরের উত্তর দিকে) এবং পেট্রল গুদাম এলাকায় (শহরের দক্ষিণ দিকে পেট্রোল ইয়ার্ড) বাঙালিদের বড় ধরনের জমায়েত হয়, তারা উত্তর আঙ্গিনায় (রেলওয়ে নর্থ ইয়ার্ড) আক্রমণ চালায়। পুরো এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটতরাজ করে। পেশ ইমামসহ চারজন মসজিদে আশ্রয় নেয়। বাঙালিরা সন্ধ্যায় তাদের হত্যা করে। আগামীকাল সকাল পর্যন্ত কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে।
২৮ মার্চ ১৯৭১
সকাল ৮টার দিকে পেট্রোল ইয়ার্ডে আক্রমণ চালায়, আমাদের একজন তাতে নিহত হয়। দুপুর দেড়টার দিকে চারদিক থেকে প্রায় এক লক্ষ বাঙালি শহরে আক্রমণ চালায়। শুরুতে তারা বন্দুকের গুলি চালায় পরে একইসঙ্গে বন্দুক ও রাইফেলের গুলি ছুড়তে থাকে। শহরের ভেতরে থাকা পুলিশ ও ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল) তাদের সহায়তা করে। আমরা যখন বাঙ্গালিদের মুখোমুখি লড়াই করছিলাম তখন তারা পেছন থেকে আমাদের উপর গুলি চালায়। তাদের গুলিতে আমাদের দু'জন নিহত হয়।
বাঙালিদের আক্রমণ ঠেকিয়ে, তাদের তাড়া করে এবং তাদের গ্রাম পুড়িয়ে আমাদের লোকজন যখন ফিরে আসছিল তখন তাদের গুলিতে অনেকেই জখম হয়। শহরের চারদিক থেকে পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতালে আসা প্রায় ৩০ জন আহত মানুষকে একজন মাত্র মহিলা ডাক্তার খুরশিদ বানু তার স্বামী ও ছেলের সহায়তায় নিজ বাড়িতে চিকিৎসা দেন। তার মনোবল অত্যন্ত উঁচু, তিনি অত্যন্ত যত্ন করে দ্রুত এবং সাহসের সাথে এতগুলো আহত মানুষকে সামাল দেন। আমাদের সাহসী জখমিদের একমাত্র তিনিই চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করেছেন।
২৯ মার্চ ১৯৭১
কর্নেল তারিক রসুল সপরিবারে দিনাজপুর থেকে এখানে এলেন। তিনি বেশ সকালে এসেছেন এবং দিনাজপুরে যা ঘটেছে তার পুরো কাহিনী শোনালেন। শহরে উত্তেজনা বিরাজ করছে।
৩০ মার্চ ১৯৭১
কর্নেল টি. রসুল (তারিক রসুল) ও তার পরিবার এবং পার্বতীপুরে পদায়ন হওয়া কিছু অবাঙালি ইপিআর সদস্য সৈয়দপুর চলে গেলেন। কর্নেল টি. রসুল যাবার সময় আমাদের কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিলেন। আমার শুভানুধ্যায়ীদের কেউ কেউ আমার স্ত্রী ও সন্তানদের কর্নেল টি. রসুলের সাথে সৈয়দপুর পাঠিয়ে দিতে বললেন, কিন্তু আমি তা নাকচ করে দিলাম কারণ তাতে শহরের লোকদের মনোবল ভেঙ্গে পড়বে।
অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা পার্বতীপুর ছেড়ে যাওয়াতে শহরের লোকজন হতাশ হয়ে পড়েছিল। আমি তাদের মনোবল চাঙ্গা করার চেষ্টা করলাম। বাচ্চা খান এবং মতিউর রহমানের তত্ত্বাবধানে সারা শহরে শক্তিশালী টহল মোতায়েন করলাম। তারা রাতভর প্রহরায় থাকবে এবং শহর প্রতিরক্ষা করবে।
১ এপ্রিল ১৯৭১
রাত সাড়ে তিনটার দিকে মেজর শাফায়েত বাড়িতে এসে আমার সাথে দেখা করলেন। বললেন, বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে কারফিউ বলবৎ করবেন। তিনি তার বাঙালি সৈনিকদের তিনজনের এক একটি দল করে পেট্রোলিং-এ পাঠাবেন এবং আমাদের দায়িত্ব এ সময় তাদের হত্যা করা।
আমি তাকে পরামর্শ দিলাম, এই অপারেশনটা আমাদের এখনই শুরু করতে হবে। নতুবা তা অনেক দেরি হয়ে যাবে এবং এমনও হতে পারে আল্লাহ না করুন বাঙ্গালিরা তাকেই হত্যা করতে পারে। তিনি তাতে সায় দিলেন না। কিন্তু তিনি যখন সকাল ৯টায় ক্যাম্পে ফিরে গেলেন তার সেই লোকেরা তাকে হত্যা করল।
এর পরপর ১১টার দিকে তার রেজিমেন্ট পালিয়ে যায়; ওসি পার্বতীপুর গ্যারিসন ও কনস্টেবল ৯ রাইফেল নিয়ে পালায়। বিকেল ৪টার দিকে আমি এবং মতিউর রহমান পার্বতীপুর রেলওয়ে পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করি। সামান্য প্রতিরোধের পর বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা আত্মসমর্পণ করে। ৯টি ভাল রাইফেল, বোল্টছাড়া ২৮টি রাইফেল এবং থ্রিওথ্রি রাইফেলের ২০০ গুলি আমাদের দখলে আসে। বিষয়টি আমি ফোনে সৈয়দপুরে কর্নেল টি. রসুলকে নিশ্চিত করি। তিনি থানাও দখল করে নেবার পরামর্শ দেন।
২ এপ্রিল ১৯৭১
ইপিআর- এ কর্মরত বাঙালি ফৌজ পার্বতীপুর ছেড়ে হলদিবাড়ি কলোনিতে তাদের বাঙালি ভাইদের সাথে মিলিত হয়েছে। বাঙালি পুলিশ এবং ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ছেড়ে যাওয়া পুলিশরাও তাদের সাথে যোগ দিয়েছে। হলদিবাড়ির দিক থেকে আমরা এমনিতেই প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছি, এখন হলদিবাড়ি কার্যত বাংলাদেশের পক্ষে বড় ধরনের ক্যাম্প হয়ে উঠেছে। এবং তা আমাদের জন্য বড় বিপদেরও কারণ।
৩-৬ এপ্রিল ১৯৭১
পরিস্থিতি উত্তেজনাপুর্ণ। যখন তখন গোলাগুলি হচ্ছে। আমরা শহর প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত। গত রাতে থানা ঘেরাও করেছিলাম, কিন্তু সফল হইনি। রাত ১২টায় আমি বাচ্চা খান, মতিউর রহমান ও ৮ মুজাহিদকে সাথে নিয়ে আবার স্থানীয় থানা ঘেরাও করলাম।
আমি ও মতিউর রহমান থানার ভেতরে ঢুকে ওসিকে বললাম আমাদের লোকেরা থানা ঘিরে ফেলেছে; যদি ওসি আত্মসমর্পণ না করে আমরা তাকে এবং তার লোকদের হত্যা করব।
ওসি আত্মসমর্পণ করল। আমরা ভালো অবস্থায় ৪০টি রাইফেল এবং থ্রিওথ্রির ৫০০টি বুলেট উদ্ধার করলাম। থানা দখলের পর থানার উত্তর দিকে যেখান থেকে আমাদের উপর গুলি ছোড়া হয়েছে আমরা সেদিকে গুলি ছুঁড়তে শুরু করলাম এবং আমাদের লোক সেদিক এগুতে শুরু করল। এ সময় তারা দুজন বাঙ্গালিকে হত্যা করল, গ্রামের ২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে বাঙালিদের ধাওয়া করে দূরে সরিয়ে দেওয়া হল। রাত ১১টার দিকে সেখানে শক্ত পাহারা বসিয়ে বাড়ি ফিরলাম।
৭ এপ্রিল ১৯৭১
আজকের দিনটি আমাদের জন্য মারাত্মক একটি দিন। ভোর ৫.৪০ মিনিটে পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ চালানো হয়। ভয়ঙ্কর শব্দ করে দুটি বোমার শেল আমার বাড়িতে পড়ে, তাতে কিছুটা ক্ষতি হয়। ভোর ৬টা থেকে বৃষ্টির মতো রাইফেলের গুলি আসতে থাকে। ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে পুলিশ, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল এবং পুলিশসহ প্রায় এক লক্ষ লোক আক্রমণ চালায়। পূর্ব দিক আক্রমণ ছিল সবচেয়ে মারাত্মক।
তারা রকেট, ২ ইঞ্চি ও ৩ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি চাইনিজ অটোমেটিক রাইফেল, থ্রিওথ্রি রাইফেল ও অন্যান্য মরণাস্ত্র ব্যবহার করছিল। আমি শহরের এক মোর্চা থেকে অন্য মোর্চায় ছুটে গিয়ে আমাদের লোকদের মনোবল বাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। যেখানে লোকবল ও অস্ত্র যোগান দেওয়া জরুরি তাই করে যাচ্ছিলাম। বাচ্চা খান ও মতিউর রহমান সাহসের সাথে তাদের লোকবল নিয়ে লড়াই করেছে। পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ ধীরে ধীরে আরো বেড়ে গেল, আমাদের উপর ঘন ঘন রকেট শেল নিক্ষেপ করা হচ্ছে। আমরা খুব সতর্কভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করছিলাম। তবে রাত ১২টার দিকে আমাদের গোলাবারুদ ফুরিয়ে আসা শুরু করল।
প্রচন্ড রকেট নিক্ষেপ ও মর্টারের গোলাবর্ষণের ভেতরে শত্রুরা আসতে থাকলে, আমরা ধীরে ধীরে পূর্ব দিক থেকে পশ্চাদপসরণ করতে থাকি। আমি এদিক থেকে নারী, শিশু ও দর্শকদের সরাতে থাকি এবং একই সঙ্গে আশু-সহায়তার জন্য সৈয়দপুরে আর্মিকে অনুরোধ জানাতে থাকি। সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বুঝতে পারছিলাম এবং আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে আসছে।
আমাদের গোলাবারুদ একেবারে শেষ দিকে। বাচ্চা খান যতটা সম্ভব ঠেকাতে ঠেকাতে পশ্চাদাপসরণ করছে। এর মধ্যে শত্রুরা আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে একটি মোর্চার মধ্য দিকে বাজারে এসে পৌছেছে। তারা দোকান লুট করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দুপুর দুইটার দিকে তারা আমাদের রেলওয়ে স্টেশনের একদিকে ঢুকে অবস্থান নিল। আমরা তখনও তাদের অগ্রগতি প্রতিহত করতে এবং আরো দখল ঠেকাতে আপ্রাণ লড়াই করে যাচ্ছি।
আড়াইটার সময় প্রথম ব্যাচে আমাদের সৈন্যরা এসে পৌঁছল। কিন্তু ততক্ষণে বোমা বিস্ফোরণ, স্বয়ংক্রিয় মরণাস্ত্র ও রাইফেলের গুলিতে আমাদের একজন প্রাণ হারায়। আহত প্রায় ১০০ জনকে নিয়ে ডাক্তার খুরশিদ বানুর বাড়ির দিকে ছুটতে হয়। শহরের পূর্বাঞ্চলের সবাই চলে গেলেও তিনি বাড়ি ছেড়ে যাননি। তিনি সাহস ও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে গেছেন।
সেনাবাহিনী পূর্ব দিক থেকে শত্রুদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হলো, ততক্ষণে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাচও এসে হাজির হলো। আমি সেনাবাহিনীর সাথে শহর প্রদক্ষিণ করলাম। দুই ঘন্টার মধ্যে সেনাবাহিনী শত্রুদের আক্রমণ বন্ধ করতে সক্ষম হলো। এই সময়ের অপারেশনে তিনজন সৈন্য গুরুতর আহত হলো। তাদের সকলকে ডাক্তার বানুর কাছে পাঠানো হয়।
অপারেশন শেষে আমি মেজর দুররানি, ক্যাপ্টেন চিমা ও ক্যাপ্টেন শারাফতকে নিয়ে ডাক্তার বানুর বাড়িতে যাই। একশতেরও বেশি আহত মানুষ তার বাংলাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। দু'জন সৈনিকের চিকিৎসা সেরে তিনি তৃতীয়জনকে নিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার নিরন্তর প্রচেষ্টার পরও এই সৈনিক মৃত্যুবরণ করল।
ততক্ষণে কর্নেল শফি এসে হাজির হলেন, তিনি ডাক্তার বানুর সেবার প্রশংসা করলেন। অফিসাররা সে রাতটি কাটায় ডাক্তার বানুর বাংলোতে এবং সৈন্যরা রাত কাটায় এই বাংলোর কাছাকাছি জিন্নাহ ময়দানে। আমি তাদের খাবার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সেই দুপুর তিনটা নাগাদ শহরের যারা আশা হারিয়ে ফেলেছিল, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছে তাদের আশাবাদ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলাম।
৮ এপ্রিল ১৯৭১
হলদিবাড়ি এলাকায় যেতে সেনাবাহিনীকে সঙ্গ দিলাম। আমার লোকজন অবাঙ্গালি ইপিআর ও পুলিশ মিলে কিছু বাড়িঘর পুড়াল। দুটি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করলাম। একটি নিয়ে গেলেন মেজর দুরবানি আর একটি আমাদের সাথে রয়ে গেল। সেনাবাহিনী হলদিবাড়িতে রয়ে গেল। তাদের জন্য খাবার বিছানা ইত্যাদির আয়োজন করলাম। সেনাবাহিনীর নির্দেশ মতো আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠিত করলাম।
৯ এপ্রিল ১৯৭১
শহরের কাছাকাছি দুটো গ্রাম ভিট্টিপরান্দ ও বসুপাড়ায় অপারেশন পরিচালনা করার জন্য মুজাহিদ নির্বাচন করে পাঠালাম, সামান্য প্রতিরোধের চেষ্টা করে শত্রুরা পালিয়ে গেল। আমি সেনাবাহিনীর জন্য খাবারের আয়োজন করলাম এবং স্থানীয় সমস্যা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক কাজ পর্যবেক্ষণ করলাম।
১০ এপ্রিল ১৯৭১
রাতের বেলা হুগলিপাড়ায় পেট্রোল পার্টি পাঠালাম: সেখানে শত্রুর কোনো চিহ্নও নেই।
১১ এপ্রিল ১৯৭১
মেজর কামারের নির্দেশে আমি এবং আমার ১৫ জন লোক কালকাবাড়িতে অপারেশন চালালাম, কয়েকজন শত্রুকে হত্যা করলাম, দুটি রাইফেল উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর হাতে অর্পণ করলাম।
১২ এপ্রিল ১৯৭১
মেজর কামারের নির্দেশে ফুলবাড়ির দিকে রেললাইন ও টেলিফোন লাইন মেরামতের জন্য বাচ্চা খানের অধীনে আমার লোকদের পাঠালাম। এসময় কিছু লোক নিয়ে আমি শহরের পূর্বাঞ্চলে কয়েকটি গ্রামে অপারেশন চালালাম।
১৩ এপ্রিল ১৯৭১
বিলাইচান্দিতে অপারেশন চালানোর জন্য মেজর কামারের সাথে আমার একজন লোককে (রব্বানী) পাঠাই। মেজর কামারের অনুমোদন নিয়ে আমি বাচ্চা খানকে সাথে নিয়ে হুগলিপাড়াতে অপারেশন চালাই।
১৪- ১৬ এপ্রিল ১৯৭১
শহরের স্থানীয় সমস্যা ও অন্যান্য বিষয় নিরসন করি। মেজর কামার আমাকে পার্বতীপুরের প্রশাসক নিয়োগ করেন এবং শহরের প্রশাসন ও প্রতিরক্ষার দায়িত্ব প্রদান করেন। আমি দ্রুত সরকারি দফতর এবং স্থানীয় প্রধানদের বৈঠক ডাকি এবং বেসামরিক প্রশাসন ও রেলওয়ে প্রশাসন নিয়ে তাদের নির্দেশনা দেই। কঠোর পরিশ্রম করতে বলি।
১৭- ২০ এপ্রিল ১৯৭১
রেলওয়ে পুলিশ থানা, স্থানীয় থানা, খাদ্য বিভাগ, বাজার পুনস্থাপন করি, শরণার্থী শিবির চালু করি। যাদের ঘরবাড়ি ও দোকান পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেই।
পার্বতীপুরের ডিএমই মুস্তফা সাহেব এবং স্টেশন মাস্টার মল্লিক সাহেবের সহায়তায় রেলওয়েকে স্বাভাবিক চলাচলে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেই। পার্বতীপুরের সিগন্যাল ইন্সপেক্টর মিস্টার শেল্টনের সহায়তায় স্থানীয় রেলওয়ে ক্রসিং নির্মাণ কাজ শুরু করি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেই। লোকজন প্রচুর পরিশ্রম করে রেল ও বিদ্যুতের কাজ শেষ করে। আহত মুজাহিদ, সেনাবাহিনীর পাঠান, শরণার্থী, পার্বতীপুরে আসা সকল মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য ডাক্তার বানুকে নিয়োগ করি।
২১ এপ্রিল ১৯৭১
বদরগঞ্জ অপারেশনের দায়িত্ব দেই মেজর জোয়াইদ, বাচ্চা খান এবং রব্বানীকে। প্রায় ৫০০ মানুষ গ্রেফতার হয়। অনেক গ্রাম পুড়ে গেছে। দুটি শটগান উদ্ধার হলে তা সেনাবাহিনীকে দিয়ে দিই। গ্রেফতারকৃত ৮৬ জন হিন্দু ও ছাত্রকে পার্বতীপুর আনা হয়, অন্যদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
২২ এপ্রিল ১৯৭১
মেজর জোয়াইদ, বাচ্চা খান এবং রব্বানীর সাথে খোলাহাটি ও ভবানীপুরের দিকে যাই। ২৩টি গ্রামে আগুন ধরানো হয়। কিছু সংখ্যক প্রহরী ও ছাত্রকে হত্যা করা হয়। একটি শটগান উদ্ধার করে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
২৩ এপ্রিল ১৯৭১
বাচ্চা খান ও রব্বানীকে মেজর জোয়াইদের সাথে কাওগায়ের দিকে পাঠালাম। আর আমি নিজে লেফটেন্যান্ট শহীদের সাথে ফুলবাড়ি গেলাম। লুটতরাজের অভিযোগে লেফটেন্যান্ট আকবর আমার লোকদের একজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। সৈয়দপুর মিলিটারি হেডকোয়ার্টার্সের নির্দেশে সেনাশক্তি বাড়াবার জন্য রাত দশটায় বাচ্চা খানের কমান্ডে ১৫ জন মুজাহিদকে পাঠালাম।
এই সৈন্যরা রংপুর থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত রিলিফের ট্রেনের সাথে এসেছিল, রেললাইন খুলে নেওয়ায় তারা খোলাহাটিতে আটকা পড়ে গিয়েছিল, তখন শত্রুরা তাদের উপর গুলিবর্ষণ করেছে। গুলিবর্ষণ শুরু করলে সৈন্যরা কিছুসময় প্রতিরোধ করে তারপর পালিয়ে আসে। রাতের বেলা সেতু ও রেললাইন মেরামত করা হয়। খোলাহাটিতে সৈনিক ও রেলের রিলিফ ট্রেনের কর্মচারীদের খাবার দেওয়া হয়। সৈন্যদের নিয়ে ট্রেন সকালে পার্বতীপুর এসে পৌছে।
২৪ এপ্রিল ১৯৭১
মন্থথপুর থেকে খবর এসেছে বাঙালিরা চালের কল লুট করেছে। সৈয়দপুর থেকে আদেশ পেয়ে মন্থথপুরের দিকে রওয়ানা হই, বাঙালিদের তাড়া করি এবং ৩০০ মন চাল পার্বতীপুর নিয়ে আসি।
২৫ এপ্রিল ১৯৭১
কর্নেল শফির নির্দেশ পেয়ে পার্বতীপুর থেকে সৈয়দপুর রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করি। স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পার্বতীপুর থেকে ৫০০ লোক এই কাজে যোগ দেয়। সেনাবাহিনীর নির্দেশে চিরির বন্দর থেকে ৬৭৫ মণ চাল নিয়ে আসি।
২৯- ৩০ এপ্রিল ১৯৭১
সেনাবাহিনীর অপারেশন সহায়তার জন্য আমি বেসামরিক লোকের যোগান দিই। স্থানীয় প্রশাসন ও বেসামরিক ও রেলওয়ে প্রশাসনের কাজ তত্ত্বাবধান করি, পার্বতীপুর সৈয়দপুর রাস্তার নির্মাণ কাজ দেখি, ৫০০ মণ চাল আনি; ২০০ গুলিসহ থ্রিওথ্রি রাইফেল চিরির বন্দর থেকে এবং ৩২৫ মণ চাল মন্থথপুর থেকে আনি। ২টি রাইফেল সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
১ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর সৈয়দপুর রাস্তা নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে গেলাম। কাজটিতে গতি আনতে সারাদিন সেখানেই ছিলাম। রাতে স্থানীয় বিষয়গুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
২ মে ১৯৭১
মেজর জোয়াইদের নির্দেশে আমার লোকজন আর বাচ্চা খানকে নিয়ে চরকাই গেলাম। সেখানে শত্রুরা সরকারি গুদামের চাল ও গম লুট করছিল। আমরা ৯৯৪ বস্তা চাল ও গম নিয়ে পার্বতীপুর ফিরলাম।
৩-৪ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর-সৈয়দপুর রাস্তার তত্ত্বাবধান করে সন্ধ্যায় ফিরে পার্বতীপুরের বিভিন্ন ক্যাম্পের বহু সংখ্যক শরনার্থীর বিভিন্ন বিষয় সমাধান করতে লেগে গেলাম।
৫ মে ১৯৭১
বাচ্চা খানকে ও আমার লোকদের চরকাই পাঠিয়ে ৩৬০ বস্তা গম এবং ৪৮০ বস্তা চাল লুটতরাজের জন্য আসা শত্রুদের কাছ থেকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম। তারা এসব লুটতরাজ করছিল। আমি পার্বতীপুর সৈয়দপুর রাস্তার কাজ তদারক করলাম।
৬-৭ মে ১৯৭১
বাচ্চা খানকে আমার লোক পাঠিয়ে চরকাই থেকে ৩৬০ বস্তা চাল ও ৭২০ বস্তা গম আনালাম। আমি রাস্তার নির্মাণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। রাত ১১টার দিকে শহরের পশ্চিম দিকে টর্চ লাইট হাতে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেল। পূর্ব দিকে প্রহরারত আমাদের লোকদের সেদিকে পাঠালাম। রাইফেলের কিছু গোলাগুলি খরচ করে তাদের তাড়া করা হলো। পূর্ব দিকে শক্তিশালী পিকেটার নিয়োগ করে বাড়ি ফিরে এলাম।
৮ মে ১৯৭১
শহর থেকে আরো শ্রমিক আনার জন্য পার্বতীপুর-সৈয়দপুর সড়ক নির্মাণ কাজে শ্রমিক ও তত্ত্বাবধায়ক পুনর্গঠিত করি। এতে ভালো ফল মেলে। আরো ১০০ জন শ্রমিক ও তত্ত্বাবধায়নের লোক নিয়োগ করি। বাচ্চা খানের সাথে আমাদের লোক চরকাই পাঠিয়ে দিয়ে ৭০০ বস্তা গম আনাই।
১১ মে ১৯৭১
আমার লোক পাঠিয়ে চরকাই থেকে ৮৪০ বস্তা গম আনাই। মেজর জোয়াইদের নির্দেশে নায়েক সুবাদার মৌলাদাদকে নিয়ে পার্বতীপুরের হাবিব ব্যাঙ্ক ও ইউনাইটেড ব্যাংকের টাকার হিসেব করি। দুই ব্যাংকের অবশিষ্ট টাকা হিসেবের সাথে মিলেছে। ন্যাশনাল ব্যাংক তালামারা অবস্থায় আছে। ম্যানেজার ও ক্যাশিয়ার বাঙালি, তারা পালিয়েছে। কাজেই ন্যাশনাল ব্যাংকের স্থিতি নিরীক্ষা করা গেল না।
পুলিশকে ১৪টি রাইফেল এবং ৭০০ রাউন্ড গুলি ইস্যু করলাম এবং চিরির বন্দর গিয়ে তাদের থানা খুলে কাজ শুরু করার নির্দেশ দিলাম। বিভিন্ন ট্রেন সার্ভিস, ইপিআরটিসি কোচ সার্ভিস এবং পিআইএর উড়োজাহাজ সার্ভিস চালুর ঘোষণা দিলাম। মেজর জোয়াইদের নির্দেশে সৈয়দপুর এয়ারপোর্টে ১৫ জন রাজমিস্ত্রিকে কাজে নিয়োজিত করলাম। বাচ্চা খানের সাথে আমার লোক পাঠিয়ে ৮৪০ বস্তা গম আনালাম। রাস্তার নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করলাম।
১৩ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর সৈয়দপুর রাস্তার অগ্রগতি দেখতে দেখতে হেঁটে সৈয়দপুর পৌঁছলাম। কর্নেল শফি ও ব্রিগেডিয়ারের সাথে দেখা করলাম। রাস্তার এলাইনমেন্ট নিয়ে কথা হলো। কর্নেল শফি রাস্তা পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করলেন। তারপরও তিনি দ্বিগুণ শ্রমিক নিয়োগ করে বর্ষাকাল আসার আগে কাজ শেষ করতে বললেন। পার্বতীপুর ফিরে এলাম।
১৪ মে ১৯৭১
খবর পেলাম প্রায় ১০দিন আগে বাঙালিরা জশাইহাটে একজন বিহারি ফুড ইন্সপেক্টর ও একজন বিহারি ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে। মেজর জোয়াইদের কাছ থেকে আদেশ নিয়ে বাচ্চা খান, মতিউর রহমান ও আমার লোকদের নিয়ে পায়ে হেঁটে জশাইহাট অপারেশনে বেরিয়ে গেলাম। তখন দুপুর পৌনে একটা। তিনটার দিকে মন্থপুরে দুজন হিন্দুকে ধরলাম, তারা গরুর গাড়ি ভর্তি চাল ও ধান নিয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছে। আমরা দুজন হিন্দুকে হত্যা করে তাদের গরুর গাড়ির চাল ও ধান নিকটে বসবাসকারী মুসলমানদের মধ্যে বন্টন করে দিলাম।
পৌনে পাঁচটায় আমাদের টার্গেটে পৌঁছে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললাম। ২৫০ জন বাঙালিকে গ্রেফতার করে তাদের মধ্য থেকে ৯ জনকে রেখে বাকীদের সতর্ক করে ছেড়ে দিলাম। দুটি শটগান এবং ভারতীয় টাকার নোট পেলাম। বন্দুক দিয়ে দিলাম পার্বতীপুরের নায়েব সুবাদার মৌলাদাদকে। একজন বাঙালির বাড়ি থেকে এক বিধবা বিহারীকে উদ্ধার করলাম। সম্প্রতি বাঙালিরা তার স্বামীকে হত্যা করেছে। আর একজন বাঙ্গালির বাড়ি থেকে এক বিহারি মেয়েকে উদ্ধার করলাম। বিধবাকে শরণার্থী শিবিরে পাঠিয়ে দিয়ে এতিম মেয়েটিকে আমার বাড়িতে নিয়ে এলাম। ফিরে মেজর জোয়াইদকে টেলিফোনে সব বিস্তারিত জানালাম।
১৫ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর-সৈয়দপুর রাস্তার নির্মাণ কাজ দেখতে বেরোলাম। বিকেলে তিনটার দিকে খবর পেলাম শত্রুরা খোলাহাটিতে রেললাইন তুলে ফেলছে এবং রেলের সম্পদ ধ্বংস করছে। শোনার পর বাচ্চা খান যখন সেখানে ছুটে যায়, শত্রুরা তাকে ঘিরে ফেলে। আমি দ্রুত পার্বতীপুর ছুটে আসি এবং সৈয়দপুর সেনা সদর দপ্তরের সাথে কথা বলে নায়েব সুবাদার তাজা গুলের নেতৃত্বে আমার ২৫ জন জওয়ান ও সেনা সদস্যদের নিয়ে খোলাহাটি রওয়ানা হই।
আমরা প্রায় ৪টার দিকে পৌছাই। তখন শত্রুরা পালাতে শুরু করে। আমরা তাদের অনেককে ঘিরে ফেলি এবং ২৫ জনকে হত্যা করি। ১২টি শটগান এবং সেনাবাহিনীর দুটি পোশাক উদ্ধার করি। রাত দশটায় সকলে পার্বতীপুর ফিরে আসি। সৈয়দপুর বিস্তারিত জানাই। বাচ্চা খান তার অনুমতি না নিয়ে খোলাহাটি যাওয়ায় কর্নেল শফি রেগে গেলেন। যে ২৭ জনকে গ্রেফতার করে এনেছিলাম। তাদের মধ্যে ৩ জনকে রেখে অবশিষ্টদের কঠোর সতর্কবার্তা দিয়ে মেজর জোয়াইদের নির্দেশে ছেড়ে দিলাম।
১৬ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর-সৈয়দপুর সড়ক পরিদর্শন করে মেজর জোয়াইদ পার্বতীপুর পৌঁছলেন। খোলাহাট্টিতে গতকালের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন পার্বতীপুরের সাথে সম্পর্কিত অফিসারবৃন্দ ও আমাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলেন। খোলাহাট্টিতে সশস্ত্র শত্রুর উপস্থিতি নিয়ে তিনিও উদ্বিগ্ন বলে মনে হলো। চিরিরবন্দর থানার ওসিকে দিনাজপুরে বদলির নির্দেশ দিলেন।
খোলাহাট্টির কয়েদিদের তার সাথে সৈয়দপুর পাঠিয়ে দেওয়া হলো। রেললাইন পার্বতীপুরকে দুই ভাগে ভাগ করে রেখেছে। গত ১৫ বছর ধরে কোনো না কোনো অজুহাতে লেভেল ক্রসিং নির্মাণ বাদ দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের উদ্যোগে পাকিস্তান ইস্টার্ন রেলওয়ে পার্বর্তীপুরের সিগন্যাল, লেবেল ক্রসিং ইন্সপেক্টর মিষ্টার শেলটনের চেষ্টায় এক পক্ষকালের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হল।
আজ সন্ধ্যায় আলহাজ মোহাম্মদ শোয়েব লেভেল ক্রসিং উদ্বোধন করেন এবং বিশেষ সম্মান জানাতে নাগরিকদের প্রবল করতালির মধ্যে ডাক্তার বানুর গাড়িকে সবার আগে লেভেল ক্রসিং পার হতে দেওয়া হয়।
১৭ মে ১৯৭১
পার্বতীপুর-সৈয়দপুর সড়ক নির্মাণ তত্ত্বাবধায়ন করতে গেলাম। পার্বতীপুরে নায়েব সুবাদার নেয়ামত উল্লাহর সাথে একটি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিলাম। দিনাজপুর, সান্তাহার এবং আরো অনেক স্থান থেকে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে ব্যস্ত রইলাম। শরণার্থীদের অধিকাংশই বিধবা ও এতিম। এই শরণার্থীদের সংখ্যা রীতিমত আতঙ্কজনক। প্রায় ২,০০০ এর মধ্যে এসে হাজির হয়েছে। সর্বশক্তিমানই জানেন আর কতজন এখনো আসা বাকী।
তাদের অধিকাংশের অবস্থাই মর্মান্তিক, নিজেদের স্বজনসহ সবই হারিয়েছে। তারা সবকিছুর জন্য এখন আল্লাহ ও আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। পার্বতীপুরের টাউন অ্যান্ড মিনিস্ট্রেটর কামারুজ্জামানের ডায়েরি থেকে কিছু পুনরাবৃত্তি বাদ দিয়ে অনুবাদ করা হয়েছে। তিনি সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য বলেও উল্লেখ করেছেন। শহর প্রশাসক নামের কোনো পদ থাকার কথা নয়। তিনি ডায়েরিতেই উল্লেখ করেছেন এটি সেনাবাহিনীর দেওয়া দায়িত্ব। তিনি তার ডায়েরির অনুলিপি তার কর্মকান্ডের প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছেন।
ডায়েরির যে পৃষ্ঠা পত্রের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তাও অনুদিত হচ্ছে:
মহোদয়,
আপনার সানুগ্রহ অবগতির জন্য আমার দৈনন্দিত কাজের ডায়েরির উদ্ধৃতি এই চিঠির সাথে যুক্ত করছি। ডায়েরিতে আমি পার্বতীপুরে যা ঘটেছে এবং এই শহরের মানুষ ১ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৭ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত কী যাতনার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে- তা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
আল্লাহ এই শহর ও এখানকার নাগরিকদের রক্ষা করেছেন। আল্লাহ না করুন এই শহর যদি শত্রুদের দখলে চলে যেত- তা হলে ৫০ হাজার মোহাজিরের মৃত্যু ঘটত। তাহলে এই ঘটনা আমাদের সেনাবাহিনীকে সমগ্র উত্তরবঙ্গের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে ভয়ঙ্কর সমস্যার মধ্যে ঠেলে দিত। আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিই।
এই শহরের সাহসী মানুষ এবং আমাদের সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ দিই- তাদের উদ্যোগেই শত্রুদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এই সাহসী কাজের মাধ্যমে এ শহরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে যারা বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন; তাদের প্রশংসা করার উপযুক্ত ভাষা আমার জানা নেই। বাচ্চা খান, আলহাজ মোহাম্মদ শোয়েব, মোহাম্মদ মতিউর রহমান, জনাব এবং বেগম খুরশিদ বানু এই শহরের জন্য অত্যন্ত মহান সেবাদান করে গেছেন। নারী হয়ে ডাক্তার বানু যা করেছেন এবং করে যাচ্ছেন- তা কখনো কোনো পুরুষও করেননি। আমার পক্ষ থেকে এবং শহরের মানুষের পক্ষ থেকে আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে নিরবিচ্ছিন্ন সেবাদানের জন্য তাকে অনেক ধন্যবাদ জানানো হয়েছে; তিনি শহরের বহু সংখ্যক ভুক্তভোগীকে সেবা প্রদান করেছেন। এ চার জনকে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রদানের জন্য আমি জোর সুপারিশ করছি।
কামরুজ্জামান, শহর প্রশাসক, পার্বতীপুর।