ফানুস: হৃদয় আকাশের আগুন পোড়া ঘুড়ি?
'দিতে পারো একশ ফানুস এনে?
আজন্ম সলজ্জ সাধ
একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই'
-উৎসর্গপত্র: শঙ্খনীল কারাগার, হুমায়ূন আহমেদ
একসময়ের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের সংলাপ 'জিনিস হালকা হলেই খারাপ না' কিন্ত অন্য অনেক ক্ষেত্রেই খাটে! যেমন জল ও বাতাসের চেয়ে হালকা কিছু জল ও বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। মানুষ যে জলে ভাসে তার নাম সাঁতার। জলে নৌকা বা জাহাজও ভাসে। আর আকাশে ভাসা মানে ওড়া। যেমন ফানুস কিংবা বেলুন। বাতাসের চেয়ে সামান্য ভারী কিছুও ওড়ে। যেমন ঘুড়ি। মানুষ বেলুন, ঘুড়ি বা ফানুস বানাতে পেরেছে, পেরেছে বিমান তৈরি করতেও। শুধু পারেনি পাখি হতে!
পাখি ও ফানুস খুব বেশি আছে মানুষের সৃষ্টিশীলতায়। কারণ পাখি ও ফানুসের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ধর্ম বা মিথে আগুনের দেবতা পুরুষ। সেখানে প্যান্ডেরার বাক্স যে খুলে ফেলে, সে একজন নারী। খোলামাত্রই সেই বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে দুঃখ, জরা, রোগ, শোক কিংবা দুঃখ। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মে ফানুসের ব্যাপারটা অন্যরকম। প্রবারণা পূর্ণিমাতে ফানুস ওড়ানো হয়। সাধারনত আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শুরু করে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের শেষ দিন প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস ও জাহাজ ভাসানো উৎসবের আয়োজন করা হয়। শুভ আষাঢ়ী পূনির্মাতে গৃহত্যাগ করেছিলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ বা গৌতম বুদ্ধ। ভোগ বিলাস,রাজত্ব,ধনদৌলত সব কিছু ত্যাগ করেন দুঃখমুক্তির চির সংকল্প নিয়ে। গৌতম বুদ্ধ সঙ্গী-সারথী ছন্দককে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, অনোমা নদীর তীরে এসে রাজ পোশাক পরিবর্তন করেন। তারপর রাজ পোশাক সারথী ছন্দককে ফিরিয়ে দিয়ে সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করেন, তরবারি দিয়ে কেটে ফেলেন চুলের গোছা। এরপর কামনা করেন তিনি বুদ্ধ হবেন এবং চুল শূন্যে উড়িয়ে দিলে সেটা মাটিতে পড়বে না। তিনি চুল ছুড়ে মারেন শূন্যে এবং একটা চুলও ফেরে না মাটিতে। স্বর্গের ইন্দ্ররাজ হীরা, মণি-মানিক্য সাজানো এক পাত্রে সেই চুল তাবতিংস নামের স্বর্গে কেশধাতু হিসেবে স্থাপন করে এক চৈত্য নির্মাণ করেন এবং নাম দেয়া হয় চুলামনি চৈত্য। স্বর্গের দেবতারা এই চুলামনি চৈত্যর পূজা করেন,মর্তেও এই চুলামনি চৈত্যকে পুজোর উদ্দেশ্যে ফানুস ওড়ানো হয়, জাহাজ ভাসানো হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমাতে এটা করার কথা থাকলেও মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টির কারণে আশি^ণের প্রবারণা পূর্ণিমায় প্রার্থণার সুরে সুরে ফানুস ওড়ানো হয়।
ফানুস ওড়ালে ফানুসের সাথে রোগ, শোক. জরাও উড়ে যাক বা মিলিয়ে যাক শূন্যে এমন প্রার্থই করা হয়। প্রার্থনা করা হয় মানুষের মনোষ্কামনা বা স্বপ্ন যেন পূরণ হয়। ফানুস কেন শূন্যে ভাসতে ভাসতে শূন্যেই মিলায়? তপ্ত আগুনের উপরের বাতাস সাধারন ঠান্ডা বাতাসের চেয়ে বেশ হালকা তাই ফানুস গতির সাথে সাথে উপরে উঠতে থাকে। বাতাসে ভেসে থাকা অনেক ময়লা ধূলা কি পুড়িয়ে ফেলে ফানুসের আগুন? খানিক শুদ্ধ কি হয় বাতাস? আগুনের ধোঁয়া কাপড়ের থলিতে আটকে রেখে জ্বলন্ত আগুনের সঙ্গে যা ছেড়ে দেয়া হয় তার নাম ফানুস। আর মজবুত এক ফানুসের নাম বেলুন। আমরা ঘর সাজানোর জন্য যে ছোট্ট বেলুন ফুলাই সেটাও উড়তে পারে! কিন্তু বেলুন বা ফানুস কী অক্সিজেন ধ্বংস করে? পরিবেশের কি ক্ষতি হয় বা আমাদের জন্য বিরূপ পরিবেশ তৈরি করে?
বিশ্বাসে মিলায় বস্তু। কিন্তু পরিবেশ? অথবা উৎসব যদি মৃত্যু ডেকে আনে? যদিও ফানুস নিয়ে দর্শন, কবিতা, গান বা সিনেমাও কম নেই। সৈয়দ শামসুল হকের লেখা জনপ্রিয় গান 'হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস/দম ফুরাইলে ফুস', জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লার গানে আছে 'আমিও সুখে-দুঃখে মানুষ/পরেছি স্বপ্নের ফানুস'। হুমায়ূন আহমেদের 'শঙ্খনীল কারাগারে'র উৎসর্গপত্রে ফানুসের উল্লেখ প্রথমেই করা হয়েছে। ফানুস নিয়ে কবিতা আছে অজস্র—যেমন, 'উড়তে উড়তে পুড়তে পুড়তে শেষ/কেউ রাখেনি মনে/ ঝরাপাতা ফলও পায় মাটি/মাধ্যাকর্ষণে!/ পাতার চেয়েও হালকা আমি/ফানুস হয়ে উড়ি/তোমার মনের আকাশে এক আগুন পোড়া ঘুড়ি!'
ফানুস কি শেষমেষ আগুন পোড়া ঘুড়ি, যে ঘুড়ির লাটাই থাকে না কারো হাতে? যতই দুঃখ করে বলা হোক না কেন যে 'আমি পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে শূন্যে মিলাই', আসলে কি তাই? ফানুসের কি পতন নেই, নাকি পোড়ার পর আকাশে স্থাপিত স্যাটেলাইটের মতো বর্জ্য হয়ে পৃথিবীতেই ফিরে আসে? নববর্ষের উৎসবে আতশবাজি কী পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলে না?
ধর্মীয় উৎসবের অংশ হয়ে যাওয়া কিছু 'লন্ঠন' বা 'ফানুস' টাইপ উৎসব আছে যা চলে আসছে হাজার বছর ধরে। চীন,ভিয়েতনাম বা কোরিয়াতে বিশেষ করে দ্বীপ রাষ্ট্রে যখন 'ফানুস' ওড়ানোর উৎসবের আয়োজন করা হতো সেখানে দুর্ঘটনা হয়তো ঘটতো না। কিন্তু গত এক যুগ ধরে গ্লোবাইজেশান বা বিশ্বায়নের যুগে যখনই আতশবাজি বা ফানুস কেন্দ্রিক উৎসব বাড়ছে তখনই বাড়ছে দুর্ঘটনা,মৃত্যু এবং পরিবেশ দুষণ। ভারতে দেওয়ালি ও বিবিধ উৎসবে আতশবাজি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। চীন বা কোরিয়ায় নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া 'ফানুস' ওড়ানো যায় না। বাংলাদেশে ২০২১ এর শেষ আর ২০২২ সন শুরুর উৎসবে ফানুসের কারখানায় আগুন ধরেছে,ফানুস আকাশে না উড়ে বিদ্যুৎের তারে যেয়ে পরেছে,ঢাকার যাত্রাবাড়ি,মাতুয়াইল,রায়েরবাগ,মিরপুর,লালবাগ,খিলগাও ও মোহাম্মদপুরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে,মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কোন উৎসবের জন্যই কারো মৃত্যু কাম্য নয়।
আগে জানতাম আশাবাদ ও প্রার্থণা নিয়ে উড়ে যাওয়া 'ফানুস' দুঃখ পোড়ানোর মতো বাতাসের ধুলো ময়লাও পুড়িয়ে ফেলে। এখন জানছি অক্সিজেন পোড়ায়। সাগর বা নদীতে নাকি বর্জ্য হয়ে ফিরে আসে ফানুস। জলজ প্রাণীরা নাকি এই ফানুসের তাপ নিতে পারে না, মরে যায় তারাও। তাহলে উৎসব নিয়ে কী ভিন্ন ভাবনার অবকাশ আছে? বলা হচ্ছে:
এক. অক্সিজেন কমে আসছে পৃথিবীতে। সেই অক্সিজেন পোড়ানো কি ঠিক?
দুই. পরিবেশ দূষণের চিরস্থায়ী প্রভাব পড়ে আবহাওয়াতে। আতশবাজি নিষিদ্ধ করে কঠিনভাবে কি এটি বাস্তবায়িত করা যায়? এ বছর বাংলাদেশে আতশবাজি ফোটার শব্দে একজন শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
তিন. বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। একারণে যদি ওড়াতেই হয় 'ফানুস' এর জন্য কী আলাদা কোন এলাকা নির্বাচিত করা যায়?
চার. সময় কী উৎসব কিংবা বিশ^াসের প্রচলিত ধারণাকে বদলে দিতে পারে?
ধর্ম বা বিশ্বাস মানুষের জীবনযাপনের বাইরে নয়। ফানুস বেঁচে থাক কবিতায় কিংবা গানে। ফানুস বেঁচে থাক রূপকথায়। বেঁচে থাকুক বাধাহীন কিংবা মুক্ত বিশ্বাসে। প্যান্ডেরার বাক্স থেকে বের হওয়া সব রোগ, শোক, জরা, ক্লান্তি নিয়ে নিয়মের মধ্যে উড়ে যাক ফানুস। এমন অনেক কিছু আর ব্যস্ততার বাইরে এসে মানুষ উৎসবে মাততে চায়। সেই উৎসব হোক আনন্দের। উৎসব হোক নির্বিঘ্নে।
ফানুস যেন আগুন পোড়া ঘুড়ি হয়ে নেমে না আসে কারো জীবনে। ফানুসের আগুনে বা আতশবাজির শব্দে কারো মৃত্যু না হোক।
নাকি দোয়েল আর ফড়িং এর মতো যে ফানুস প্রার্থনার, যে ফানুস বিশ্বাসের, মানুষের সাথে তার কোনোকালে হয় না তো দেখা!