তারা কি বেঙ্গল রেজিমেন্ট!
ফ্রান্সের নারী এলিজাবেথ বিয়ে করেছেন স্প্যানিশ পুরুষ গনহালেসকে। তো এলিজাবেথ গেলেন স্পেনে। সমস্যা একটাই। এলিজাবেথ স্প্যানিশ ভাষা জানেন না। কাউকে বোঝাতে গেলে হিমশিম খান। তা-ও আঙুল দেখিয়ে বোঝাতে পারলেন একবার যে তিনি আংটি কিনতে চায়। এরপর চশমা কিনতে যেয়েও পড়লেন বিপদে। চশমা পরা লোক দেখিয়ে তিনি বোঝাতে পারলেন কী কিনতে চান। এরপর মুরগীর রান ফ্রাই বোঝাতে নিজের পায়ের দিকে ইশারা করতে হলো।
ভাষা না বোঝার বা ঠিকমত বলতে না পারার 'প্যারা' অনেক। কারণ 'পারে না' জিনিসটা হতাশ করা একটা বিষয়। ছোটকালে খেলাধুলায় সহপাঠী বা বন্ধুদের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলে 'পারে না'র জন্য ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ্য করতে হতো। অনেকটা একালের 'ট্রলের' মতো। দুর্বলদের কেউ খেলায় নিতে চায় না। যারা ভালো করে সাঁতরাতে পারে না নৌবাহিনীর চাকরিতে, তাদের বলা হয় 'উইক সুইমার বা দুর্বল সাঁতারু'!
এবার আসা যাক ইংরেজি না পারার প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ একদা আক্ষেপ করে বলেছিলেন—'বাংলা ভুলেছিস ক্ষতি নেই কিন্তু শুদ্ধ করিয়া দুই লাইন ইংরেজি লিখিতে বা পড়িতে পারিলি না।' এই না পারার সাথে মিশে আছে 'বেঙ্গল রেজিমেন্ট'। এই বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে সেনাবাহিনীর কোন সম্পর্ক নেই। যারা ইংরেজি দৈনিক বা কোনো ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করেন, কিন্তু ইংরেজিতে রিপোর্ট, ফিচার বা মতামত লিখতে পারেন না এমন কিছু মানুষকেও চাকরি দেয়া হয়। তারা কাজটা করে এনে বাংলায় লিখে দেন এবং পরে সেটা ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়। যারা ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করে বাংলায় লিখেন তাদেরকে বলা হয় 'বেঙ্গল রেজিমেন্ট'!
ইদানীং আরও কিছু বেঙ্গল রেজিমেন্টের খবর জানা গেছে। এরা অবশ্য উর্দু, আরবি, পালি, সংস্কৃত বা ফারসিতে অনার্স করলেও এরা ভালোমতো উর্দু, আরবি, পালি, সংস্কৃত বা ফারসিতে কথা বলতে পারেন না কিংবা লিখতেও পারেন না। পরীক্ষাপত্রে উত্তর লেখেন বাংলায়। এদেরকেও কি 'বেঙ্গল রেজিমেন্ট' বলা যাবে?
ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করা উচিত। 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের ২৫০ জন সাবেক শিক্ষার্থীর মধ্যে কেবলমাত্র একজন সিলেট সরকারি আলিয়া মাদ্রাসায় উর্দু প্রভাষক হিসেবে কাজ করছেন। বাকিদের কারও এই ভাষার সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এমন কী তারা কোন গবেষণাও করছেন না'—এটা ২৮ জানুয়ারি ২০২২ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত একটা রিপোর্ট। এই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে—'২০২১ সালের ৭ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের সংস্কৃত বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পেতে চাকরিপ্রত্যাশী ১১ জন মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেন। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে প্রার্থীরা সংস্কৃত পড়তে যেয়ে রীতিমতো হিমশিম খান। অথচ নিয়োগ পেলে শিক্ষার্থীদের এই ভাষাই শেখানোর কথা!'
এই রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায়, ২০১৬ থেকে ২০২২ পর্যন্ত তিনবার সার্কুলার জারি করা হলেও উর্দু ভাষায় পর্যাপ্ত জ্ঞানসহ শিক্ষক খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দু বিভাগ। এই সমস্যা শুধু সংস্কৃত এবং উর্দু ভাষার শিক্ষার্থীদের নিয়েই নয়। ঢাকা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি ভাষা ও সাহিত্য এবং পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজের মতো বিভাগগুলো থেকে স্নাতক করা বহু শিক্ষার্থীই ভাষাগুলো ঠিকমতো পড়তে বা লিখতে জানেন না। এই তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭১০ জন শিক্ষার্থী ও ১২৮ জন শিক্ষক রয়েছেন যাদের পেছনে বছরে সরকারের খরচ ৫৬ কোটি টাকা। রিপোর্টে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড.ইমতিয়াজ আহমেদের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি মন্তব্য করেন—'উদ্বেগের বিষয় এই যে উর্দু, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ এবং সংস্কৃত বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় বাংলায় উত্তর লেখেন!'
এই রিপোর্টে আরো অনেক বাস্তবতা উঠে এসেছে। যেমন কোনো শিক্ষার্থী ইচ্ছে করে এসব বিভাগে ভর্তি হন না। যারা অন্য কোন বিষয়ে চান্স পান না, তারা এসব বিষয়ে ভর্তি হতে বাধ্য হন। এই কয়েক বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ভেতর বেকারত্বের হার খুব বেশি। চাকরি পেতে কষ্ট হবে ভেবে এরা দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএস বা চাকরি পাবার জন্য অন্যান্য বিষয়ে পড়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ভালো শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অভাবে কেউ কেউ এই বিভাগগুলোকে 'বিলুপ্ত' করতে বলেছেন, কেউ কেউ আসন সংখ্যা কমিয়ে দেয়ার সুপারিশ করেছেন।
তাহলে আমরা কী সুপারিশ করতে পারি? সুপারিশ হচ্ছে ভাষা কোনো ব্যাপার না। বিশ্বাস হচ্ছে না? বিবি হাওয়া আর আদম যখন পৃথিবীতে আসেন তখন তারা কোন ভাষায় কথা বলতেন? আমির খান অভিনীত 'পিকে' ছবিটা মনে আছে? পৃথিবীতে নামার পর আমির খান কোনো ভাষা বুঝতেন না। এক ভোজপুরি বাইজীর সাথে তাকে রাত কাটাতে পাঠানো হয়। আমির ১০০০ পান খাবার পরে বাইজির হাতের স্পর্শ নিয়ে তিনি ভোজপুরি ভাষায় কথা বলতে শিখে যান। এই হাতের স্পর্শটা দরকার সংস্কৃত, উর্দু, আরবি, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ কিংবা ফারসিতে অনার্স করতে আসা শিক্ষার্থীদের! তারা মুহূর্তেই ভাষা শিখে যাবেন আর অতীতের স্মৃতি জেনে যাবেন!
কিংবা ধরুন টম হ্যাঙ্কসের 'কাস্টঅ্যাওয়ে' ছবির কথা। ফেডারেল এক্সপ্রেস নামের এক কুরিয়ার সার্ভিসে কাজ করতেন চাক নোল্যান্ড (টম হ্যাংকস) বিমান দুর্ঘটনায় বসবাস অযোগ্য এক দ্বীপে ঠাঁই হয় তার। কেউ থাকে না তার সাথে। একটা হাতঘড়ি আর একটা বাস্কেটবলকে নিয়েই সে দিন পাড়ি দেয়। এই বাস্কেটবলের নাম রাখে উইলসন। টম হ্যাঙ্কস এই বাস্কেটবল উইলসনের সাথে কথা বলে, রাগ করে, লাথি মারে আবার দুঃখ প্রকাশ করে বলে—'উইলসন, উইলসন, নেভার অ্যাগেইন। অ্যাই অ্যাম সরি…'
চোখ ভিজে আসা এক ছবির নাম কাস্টঅ্যাওয়ে। তেমনি বাস্তবতার ভাষায় মেশানো এক বিখ্যাত কবরের 'ফলক'ও চলে আসতে পারে আলোচনায়। এই কবরে শুয়ে আছেন পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। 'উর্দু একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' যিনি বলেছেন, তার কবরের ফলকে তিন ভাষায় লেখা আছে তার পরিচয়! ইংরেজি, উর্দু এবং বাংলায়!
সবশেষে ভাষা পড়তে না পারার কিংবা যে ভাষা পড়ালেখার বিষয় সেটা বলতে না পারার বেদনা নিয়েই শেষ করি। না পারার বেদনা আসলেই মারাত্মক।
চীন থেকে এক লোক এসেছে বাংলাদেশে। এক বাঙালিকে নিয়ে সে বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছে। এসময় ঝড় তুফান শুরু হলো। বাঙালি বলল—সাঁতার পারেন? চীনা নাগরিক উত্তর দিলো—সাঁতার না পারলেও চীনাসহ আরও নয়টা ভাষা পারি। নদীতে পড়ে গেলে দশ ভাষায় চিৎকার দিতে পারব!
চিৎকার দিতে পারাটাই আসল! কান্না, হাসি, চিৎকার, চুমু বা ভালোবাসার হয়তো আলাদা কোনো ভাষা নেই!
- আহসান কবির: রম্য লেখক