কয়েকজন ‘ফেরেশতা’র খোঁজে
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ আরও চার নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তিপর্যায় থেকে প্রস্তাবিত ৩২২ জনের নাম এখন আমাদের জানা।
আগামী বছরের শেষে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় প্রতি পদের বিপরীতে দুইজনের নামসহ ১০ জনের তালিকা তৈরি করতে অনুসন্ধান (সার্চ) কমিটির আহ্বানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কাছে প্রস্তাবিত নামগুলো পাঠানো হয়।
প্রস্তাবিত নাম প্রকাশ করে প্রশংসনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে অনুসন্ধান কমিটি। ২০১৩ এবং ২০১৭ সালে আগের দুই কমিটি এ কাজ করেনি। পুরোনো চর্চা থেকে সরে এসে বর্তমান সার্চ কমিটি ভালো উদাহরণ স্থাপন করেছে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন আইন প্রণয়নের পর এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে আসন্ন নির্বাচন সংক্রান্ত আরেকটি ইতিবাচক সংকেত মিলেছে।
আশা করা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো ১০ জনের প্যানেলের নামও প্রকাশ করবে সার্চ কমিটি।
প্রস্তাবিত নাম প্রকাশ করার বিষয়টি নতুন ইসি গঠনে বিতর্ক সৃষ্টির সম্ভাবনা কমিয়ে স্বচ্ছ নিয়োগ নিশ্চিতকরণে ভূমিকা রাখবে।
শুরু থেকেই বিতর্ক মুক্ত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ইসির সক্ষমতা নিয়ে মানুষের সন্দিহান থাকার প্রবণতা কমবে। আর এরকম হলে তা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক সংসদ নির্বাচন আয়োজনের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজের প্রস্তুতি নিতে আসন্ন কমিশনের ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকায় কয়েকজনের নাম খানিকটা আশার আলো দেখাচ্ছে।
কর্মজীবনে বিচার বিভাগ, প্রতিরক্ষা ও জনপ্রশাসনের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নৈতিকতা বজায় রাখা এবং পেশাদারিত্বের কারণে পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকায় সমাজে তারা সুপরিচিত।
এরকম পাঁচজনকে ইসি গঠনে নিয়োগ দেওয়া হলে নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা নির্বাচনকে দুরবস্থা থেকে উদ্ধার করতে সচেষ্ট হবেন।
কিন্তু এর সঙ্গে আরও কিছু প্রশ্ন আছে।
সার্চ কমিটিতে নাম পাঠাতে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা কি প্রস্তাবকদের সম্মতি দিয়েছেন?
মঙ্গলবার বিশিষ্ট একজন আমাকে জানান, তিনি সার্চ কমিটিতে নিজের নাম পাঠানোর বিষয়টি জানতেন না। নাম দেওয়ার আগে তার সঙ্গে কেউ আলোচনা করেনি।
আগে থেকে আলোচিত নয় এমন কোনো নাম ইসি নিয়োগে আসা নিয়ে এবার কোনো হইচই হবে না, তা প্রায় নিশ্চিত।
শেষ কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হলো: ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত দুই সাধারণ নির্বাচন এবং পরবর্তীতে স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে নির্বাচিত হওয়ার যে অসুস্থ রাজনীতি দেখা গেছে- তার পরে নিয়োগ পেলেও কয়েকজন "ফেরেশতা" একাই কি জনগণের দীর্ঘ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে?
তবে এবার কয়েকটি ঘটনা ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
হঠাৎ করে ইসি গঠন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে আগামী সাধারণ নির্বাচন ঘিরে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তন করার বিষয়টি পরিষ্কার।
প্রথমে কয়েকজন মন্ত্রী আইন প্রণয়নের দাবি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে আইন প্রণয়ন সম্ভব নয় বলে স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন তারা।
রাষ্ট্রপতির সাথে আলোচনায় দলগুলো আইনের জোর দাবি জানায়। ক্ষমতাসীন দল তাদের দাবিকে সম্মান জানিয়েছে। কিছু ঘাটতি থাকলেও দ্রুততম সময়ে আইন প্রণীত হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের বিশ্বাস, ক্ষমতায় থাকা দলটি বাস্তবতা সম্পর্কে ভালমতোই অবগত। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো আরও একটি নির্বাচন পার করা সম্ভব হবে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এখন তাদের গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক একজন বিশ্লেষকের মতে, ''আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া আগের দুটি নির্বাচনের মতো নাও হতে পারে। ঢাকায় পশ্চিমা এক রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি বলেন, আগামী নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অগ্রগতির ওপর তারা নজর রাখছেন।''
র্যাবের সাবেক কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার সম্ভবত কিছুটা চাপ অনুভব করছে। পরিস্থিতির অবনতি ঘটুক এমনটা তারা চায় না বলেই ধারণা করেন তিনি।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে দেওয়া এক প্রতিবেদনে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে দৈনিক প্রথম আলো জানিয়েছে, "ধারণা করা হচ্ছে, মানবাধিকার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কিছু বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।"
মন্ত্রণালয়টি সংসদের কাছেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য সরকারের কাজ করে যাওয়ার কথা জানিয়েছে।
এছাড়া রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এবার সরকার একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপযোগী পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করবে বলে মনে করছে জনসাধারণ।
একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন সেই লক্ষ্যের প্রথম ধাপ।
গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন পেতে সার্চ কমিটির ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এখন পর্যন্ত কমিটি সঠিকভাবেই এগিয়ে চলছে।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে দীর্ঘ আলোচনা শেষে সার্চ কমিটি এখন ৩২২ জনের তালিকা থেকে ১০ জনকে বেছে নেওয়ার মতো কঠিন কাজটি করতে প্রস্তুত।
বাকিটা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। সার্চ কমিটির পাঠানো তালিকা থেকে রাষ্ট্রপতি কাকে সিইসি ও চার নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেবেন সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভর করবে।
তবে দিন কেমন যাবে তা যদি সকালই বলে দেয়, তাহলে এবার ভালো কিছু আশা করা চলে।
লেখক: উপ-নির্বাহী সম্পাদক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড
অনুবাদ: তামারা ইয়াসমীন তমা
মূল লেখা: EC formation: In search of 'angels'