ভারত কি তার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি এবং চরিত্র ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে?
ভারতের জাতীয় রাজনীতির পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটেছে। ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে অবমুক্ত হয়ে ১৯৪৭ এ যে ভারত জন্ম নিয়েছিল, ১৯৫০ সালে যে সংবিধান গ্রহণ করা হল, যেখানে ভারত তার নিজের পরিচয় গড়ে তুলেছিল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে। দেশের সকল ধর্মের মানুষকে সমান অধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে। বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন এক জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছিল। যা হচ্ছে মুসলিম ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যায় ধর্ম কখনও প্রাধান্য পায় না।
জাতীয়তাবাদের ব্যাখ্যা হচ্ছে, তার ভাষা এবং তার সংস্কৃতি। সেই অর্থে ভারত বহুকাল যাবৎ একটি বহুজাতিক ভূখন্ড। ১৯৫০ সালে যখন ভারত সংবিধান গ্রহণ করে তখন সেই সংবিধানের প্রধান দিক ছিল ভারত একটি বহুজাতিক ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্রব্যবস্থা। ১৯৪৭ সালে এর বিপক্ষে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের জন্য ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ পেয়েছিল। ভারতে সেই রাজনৈতিক অবস্থা গত দুই দশকে দ্রুততার সাথে ফিরে আসছে।
বাবরি মসজিদ, রাম মন্দির থেকে যে ঘটনার সূচনা হয়েছিল ১৯৯২ সালে কংগ্রেসের নরসিমা রাও যখন প্রধানমন্ত্রী। তখন ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি বিল আনা হয়েছিল। যে বিল এর মূল বক্তব্য ছিল, রাম মন্দির ছাড়া আর কোথাও মন্দির, মসজিদ যদি থেকে থাকে তা সেই অবস্থানেই বিরাজ করবে। যদিও রাম মন্দির নামক কোন মন্দিরের অস্তিত্ব তখন ছিল না। বর্তমানে ভারতের কাশিতে এই মন্দির- মসজিদ ইস্যু আবার ফিরে এসেছে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। যোগী আদিত্যনাথ ও তার দল বিজেপির ইস্যুটিকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। কাশিতে মন্দির মসজিদ অবস্থিত ১০ হাতের মধ্যেই। এই দুটি প্রতিষ্ঠান একত্রে দাঁড়িয়ে আছে এবং স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায় বলছেন যে, স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের কোনো সঙ্কট নাই। বর্তমানে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একদল হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করে মসজিদ এলাকায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। এমনকি ভারতীয় কোনো সংবাদিককেও সেখানে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে একটি বিতর্ক চলছে কর্ণাটক রাজ্যের কলেজ প্রাঙ্গণে। হঠাৎ করে হিজাব পরিহিত ছাত্রীকে গেরুয়া পোশাকধারী কিছু বহিরাগত উত্তক্ত করতে থাকলে তার বিপক্ষে মেয়েটি 'আল্লাহু আকবার' ধ্বনিতে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। কর্নাটকের বিজেপি সরকার সেখানে ধর্মীয় পোশাক নিষিদ্ধ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। অথচ বর্তমান বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠী ব্যাপক হারে হিজাব ব্যবহার করছে। যদিও হিজাব শব্দটি কোন ধর্মীয় শব্দ নয়। ইসলাম ধর্মে নারীদের পর্দার বিধান থাকায় সেই পর্দার অংশ হিসেবে মুসলিম ধর্মাবলম্বী নারীরা তাদের চুল প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে চায়। বিষয়টি ব্যক্তিগত স্বাধীনতার।
ভারতের বহু মানুষ গেরুয়া পোশাক পরেন, এমনকি যোগী আদিত্যনাথ যে মুখ্যমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশের তিনিও এই পোশাকে ধারণ করেন। সেখানে কোনো আপত্তি নেই। রাষ্ট্রীয় কাজে দেশের অভ্যন্তরে যেখানেই যাচ্ছেন তিনি ওই পোশাক পরিধান করে থাকছেন। তাহলে ভারতীয় নারীদের ক্ষেত্রে কেন হিজাব বিরোধী অবস্থান নেওয়া হবে? আসলে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচিতি এবং চরিত্র ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় যে ঘটনাটি ঘটলো সাম্প্রতিক নির্বাচনে। মমতা বিপুল ভোটে বিজয়ী হলো। এই মমতাই বিজেপিকে সাথে নিয়ে একসময় কংগ্রেস এবং সিপিএম এর বিরোধিতা করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। সেখানে তার প্রধান শত্রু ছিল সিপিএম এবং কংগ্রেস। মমতা এবং বিজেপির সঙ্গে এখন যে যুদ্ধ এটি একটি কৌশলগত যুদ্ধ। কারণ মমতা বিজেপিকে পশ্চিম বাংলায় প্রতিষ্ঠা করেছে। ভারতের দক্ষিণ অঞ্চলের রাজ্যের কর্নাটকের বহুকালের ইতিহাসের দিকে তাকালে এই ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কট অতীতে কখনোই রাজ্যটিতে দেখা যায়নি। ওই রাজ্যটি বর্তমানে বিজেপি ক্ষমতায়।
ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের জয়গানের ফসল পাকিস্তান। এ দেশটির শাসন ব্যবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা উপভোগ করেছে। পাকিস্তান জন্মের ৭০ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সব মিলিয়ে সরাসরি প্রায় ৩৫ বছর পাকিস্তানের সেনা শাসন ছিল। সেনাবাহিনী দেশ শাসন করত সরাসরি। এখন যদিও পাকিস্তান সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরাল থেকে দেশ চালাচ্ছে। জেনারেল জিয়াউল হক যখন প্রথম পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসেন তখন ভুট্টোকে অপসারণ করে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। এবং বিচারিক আদালতের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর করেন। এরপরে দেশটিতে আরো ধর্মীয় প্রলেপ যুক্ত করে বিচারের আদালতগুলোতেও শরিয়া ব্যবস্থা কায়েম করেন পাকিস্তানি হাইকোর্টে শরীয়া মুসলিম আইন বাস্তবায়নে ব্যবস্থা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই মুসলিম আইন ধারণ করে দেশটিকে ভারত বিরোধী অবস্থানে রেখে লক্ষ কোটি টাকা সেনাবাহিনীর পকেটস্থ করেছে। যার ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি এখন একটি দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হতে চলছে। তার অর্থনৈতিক ব্যর্থতা সারা বিশ্বের কাছে প্রকাশিত।
এমনি একটি অবস্থায় বিজেপি যে পথে হাঁটছে তাতে মনে করি বাংলাদেশ একটা চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই চাপ বৃদ্ধি পাবে কারণ, বিজেপির নেতৃত্ব সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে বাংলাদেশকে টার্গেট করে নানান রাজনৈতিক ইস্যু সৃষ্টি করছে। যেমন আসামে এনআরসি করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের অনুপ্রবেশের গল্প বলা হয়েছে। এখনো পশ্চিমবাংলার সাম্প্রতিককালের নির্বাচনেও বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আসামের এনআরসি প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে যে, তথ্যটা একেবারেই মিথ্যা। কারণ, যাদেরকে বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল পরবর্তীতে দেখা গেছে তারা কেউই বাংলাদেশি নয়। তারা সবাই একাত্তরের আগেই ভারতে মাইগ্রেশন করেছিলেন।
ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স, বিজেপির নেতৃত্বে এগারটি রাজনৈতিক দলের এক মোর্চা। যাদের কাছে এখন ভারতের পার্লামেন্টের ৩২৩টি আসন আর এর বিপক্ষে আছে ইউপিএ নামক আরেকটি জোট, কংগ্রেসের নেতৃত্বে। যে জোটের দলের সংখ্যা মোট আট লোকসভায় আসন সংখ্যা ৯১ যার মধ্যে কংগ্রেসের ৪৪ টি মাত্র। এই দুই জোটের বিগত নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিগত নির্বাচনে কংগ্রেসের ভোট প্রাপ্তির পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু তার থেকে বেশি বেড়েছে বিজেপি জোটের। সে কারণে আগামী ২৪ এর নির্বাচনে আবারো ধর্মীয় চেতনাকে কাজে লাগানোর কৌশল গ্রহণ করেছে বিজেপি। উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করবে বিজেপির সেই কৌশল কতটা কার্যকর হলো।