ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের জেরে পৃথিবীর নয়া মেরুকরণ: বাংলাদেশ যাবে কোন পক্ষে?
আজ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের দশম দিন। ইতোমধ্যে পৃথিবীর বিভেদরেখা অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ৪০ বছর পর স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের মতো পৃথিবী আজ বিভক্ত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব নিতে ব্যর্থ হওয়ার পর জরুরি ভিত্তিতে সাধারণ পরিষদের বৈঠক আহ্বান করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবটি এখানে নুতন করে উপস্থাপন করা হয়। ইউক্রেন হামলা বন্ধ, ইউক্রেন থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার এবং এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধের নিন্দা প্রস্তাব তোলা হয়। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকরা তিন দিন তুমুল বিতর্কের পর গত দুই তারিখ বুধবার প্রস্তাবটি ভোটাভুটির মাধ্যমে গৃহীত হয়। ভোটাভুটিতে অংশ নেয় ১৮১টি সদস্য রাষ্ট্র। ১৪১টি দেশ প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়। এই ভোটাভুটির মধ্য দিয়েই পৃথিবীর নয়া মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠে।
প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় ৫টি দেশ—রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া, বেলারুশ, ইরিত্রিয়া ও সিরিয়া। চীন, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। এখানে ভোটদানে বিরত থাকার অর্থই রাশিয়ার পক্ষ অবলম্বন করা। মার্কিন, ইউরোপ ও অন্যান্য মিত্র যেমন ইউক্রেনের পক্ষে থাকবে, অন্যদিকে চীন ও অন্যান্যরা যে রাশিয়ার পক্ষ নেবে, তা আরও আগে থেকে বোঝা যাচ্ছিল। রাশিয়া প্রশ্নে চীনের সাথে ভারত ও পাকিস্তানের অভিন্ন অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। দ্বিপাক্ষিক প্রশ্নে ভারত-চীন বা ভারত-পাকিস্তান যতই বৈরিতাপূর্ণ অবস্থানে থাকুক না কেন, রাশিয়ার প্রশ্নে তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। শ্রীলংকা এই পক্ষে থাকলেও নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান মার্কিন-ন্যাটোর পক্ষ অবলম্বন করল।
তিন দিন ধরে চলা এই বিতর্কে বাংলাদেশ অবিলম্বে এই যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র সফরে থাকলেও এই বিতর্কে সরাসরি অংশ নেননি। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে গিয়ে বলেন, 'বাংলাদেশ কখনোই যুদ্ধ চায় না এবং যুদ্ধে কোনো পক্ষভুক্ত হয় না। সে কারণেই আমরা ভোটদানে বিরত থেকেছি। আন্তর্জাতিক আইন, জাতীয় সংহতি ও সার্বভৌমত্বের নীতির প্রতি বাংলাদেশ শ্রদ্ধাশীল।' শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দেয় বাংলাদেশ। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় অখণ্ডতার নীতিতে বাংলাদেশ সমর্থন জানায়। ভারতীয় প্রতিনিধিও অভিন্ন মত পোষণ করেন।
যুদ্ধের এই দশম দিনেও যুদ্ধ কমার কোনো লক্ষণ স্পষ্ট নয়। রুশ সেনারা ইউক্রেনের সামরিক ও অন্যান্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে হামলা জোরদার করেছে। ন্যাটো গতকালের বৈঠকে ইউক্রেনের 'নো ফ্লাই জোন'-এর প্রস্তাব আমলে নেয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই ন্যাটোর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইউক্রেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। রুশ হামলার প্রথম দিন থেকেই ন্যাটোর ভূমিকায় জেলনস্কি হতাশা ব্যক্ত করে আসছেন। এরকম একটি পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের প্রত্যাশা ছিল নো ফ্লাই জোন জোরদার করা গেলে একটা কৌশলগত অগ্রগতি তৈরি হতে পারে। ইউক্রেনের এই দাবি ন্যাটো প্রত্যাখান করায় প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি বলেছেন, 'আজ থেকে কোনো প্রাণহানি ঘটলে তার জন্য দায়ী হবেন আপনারা [ন্যাটো]।' গতকাল ইউক্রেনে অবস্থিত ইউরোপের সর্ববৃহৎ পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রে একের পর এক বোমা হামলায় বিদুৎকেন্দ্রের এক কোনায় আগুন ধরে যায়। জেলেনস্কি বলেন, আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা গেছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এই কেন্দ্রে বিস্ফোরণ ঘটলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। এর তেজষ্ক্রিয়তা চেরনোবিলের চেয়ে ৬ গুণ বেশি।
যুদ্ধের সময় হাজারো তথ্য, হাজারো প্রোপাগান্ডা—কোনটা ছেড়ে কোনটা নেব। সব যুদ্ধেই এটা সাধারণ নিয়ম। প্রধান মিডিয়াগুলো পশ্চিমাদের হাতে। মিডিয়া যেভাবে জেলেনস্কির যুদ্ধপোশাক পরিহিত ছবি প্রকাশ করছে, তাতে একালে চে গুয়েভারা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ইউক্রেন-রাশিয়ার ইতোমধ্যে দুইদফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হলেও শীঘ্রই আবার বসার সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা আশা করতে চাই, দ্রুতই যুদ্ধ ও অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।
আমাদের প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম শক্তিধর চীনের সাথে রাশিয়া প্রশ্নে যে এক কাতারে দাঁড়াল এটা বাড়তি কোনো তাৎপর্য বহন করে কি না। বিশ্বব্যাপী করোনা অভিঘাতের মধ্যে চলমান এই যুদ্ধ উন্নয়শীল ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে প্রচেষ্টা মারাত্মক হুমকির মধ্যে ফেলবে। ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান যুদ্ধ এই দুই দেশ থেকে খাদ্য ও জ্বালানি সংগ্রহ ও সরবরাহে ভীষণ সংকট সৃষ্টি করবে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে মার্কিন ও ইউরোপের নানামুখী অবরোধ বিশ্ববাণিজ্য অর্থনীতিতে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি করবে। ক্ষতি করবে আমাদের মতো দেশগুলোর অর্থনীতি।
২০০১ সালে টুইন টাওয়ার হামলার পর বিশ্ব রাজনীতির চেহারায় আমূল বদল ঘটে। মার্কিনসহ পশ্চিমা বিশ্ব এ ঘটনার বদলা নিতে মরিয়া। বিশ্বব্যাপী আল কায়েদার অনুসন্ধান চলে ব্যাপকভাবে। মার্কিনিদের চিন্তার বিরোধিতা করার মাশুল দিতে হয়েছে অনেক চড়া দামে। ইরাক তার বড় উদাহরণ। ইরাকের আগে পশ্চিমারা দখলে নেয় আফগানিস্তান। পশ্চিমারা মাঠে নামে ধর্মীয় সন্ত্রাস নির্মূলের কাজে। এই এক অজুহাতে টানা বিশ বছর ধরে চলে সন্ত্রাসী অনুসন্ধানের কাজ! মার্কিনিদেরই একটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের 'কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট'-এর তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধে আফগানিস্তানে ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ নিহত হয়; যার মধ্যে সাড়ে ৪৭ হাজার আফগান বেসামরিক নাগরিক, প্রায় ৭০ হাজার আফগান সামরিক ব্যক্তি ও পুলিশ এবং কমপক্ষে ৫১ হাজার বিরোধী যোদ্ধা রয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, তাদের লক্ষ্য 'ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুদ ধবংস করা, সাদ্দামের সন্ত্রাসের প্রতি সহযোগিতা শেষ করা, এবং ইরাকী জনগণকে মুক্ত করা।' সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ৫ লাখ মানুষ জীবন দেয়। যুক্তরাষ্ট্র ৮৪৫ বিলিয়ন ডলার এবং ব্রিটেন ব্যয় করে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ইউরো। তারও আগে ভিয়েতনাম ও কোরিয়া যুদ্ধের হিসাব নিলে অর্থব্যয় ও জীবনহানি কাছাকাছি থাকবে। এত জীবন ও অর্থব্যয়ের ফলাফল জানতে চাইলে, আমেরিকার জবাব কী হতে পারে! মার্কিন ও পশ্চিমা মিত্রদের এই কাজের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে পৃথিবীর প্রথম সারির মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের মজুত রয়েছে প্রচারকারী মিডিয়া যতক্ষণে ভুল স্বীকার করেছে, ততক্ষণে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন দিতে হয়েছে।
তারপরও মার্কিনীদের পৃথিবীব্যাপী 'শান্তি' প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ থেমে নেই। কখনও কোয়াড কখনও অকাস, সামরিক ও বাণিজ্য সহযোগিতা যে নাম ব্যবহার করা হোক না কেন, প্রকৃত সত্য হলো যুদ্ধের পাঁয়তারা এবং অস্ত্র ব্যবসা। বিশ্ব সংস্থা হিসেবে জাতিসংঘ এগুলো জেনেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ।
সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের মতো অর্থনীতির দেশগুলোর চিন্তার স্বাধীনতা অনেকাংশে আটকা থাকে বাণিজ্য সুবিধা ও পণ্য বাজারের ওপর। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশের পণ্যের যে বাজার তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়। মধ্যপ্রাচ্যের যে শ্রমবাজার বা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশের যে অংশগ্রহণ, তা আমাদের দেশের উন্নয়ন, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। অন্যদিকে চীন আমাদের বড় উন্নয়ন অংশীদার, ভারত আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী ও বড় অর্থনীতির দেশ। এমতাবস্থায় বাংলাদেশ কোন পক্ষ অবলম্বন করবে? সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সামান্য ভুল বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।