সেকালের যানবাহন: ঘোড়ার গাড়ি, রিকশা, আর জিপ গাড়ি
৫০-এর দশকের শেষের দিকে টিকাটুলিতে যেসব যানবাহন আমরা দেখতাম, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ত ঘোড়ার গাড়ি।
ঢাকা শহর তখন ছিল ঘোড়ার শহর
দুই রকম ঘোড়ার গাড়ি ছিল। এক নম্বর ঘোড়ার গাড়ি ছিল সাধারণ মানের। আর দুই নম্বরটা ছিল বেশি দামি, সবল ও শক্তিশালী ঘোড়ার গাড়ি। চলত বেশি এক নম্বরগুলোই।
আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকেই ছিল কামরুন্নেসা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। সে সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের কাছে এই স্কুলটি ছিল খুব বিখ্যাত। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই স্কুল থেকে লেখাপড়া করেছেন। শুনেছি ৫২-র ভাষা অন্দোলনের সময় ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মধ্যে এই কামরুন্নেসা স্কুলের প্রতিবাদ ছিল উল্লেখযোগ্য।
যা-হোক, কামরুন্নেসা স্কুলের অনেক মেয়েদের দেখতাম এই ঘোড়ার গাড়িতে করে আসা-যাওয়া করত। বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আমি ঘোড়ার গাড়িগুলো দেখতাম।
এখন এই ঘোড়ার গাড়িগুলো ঢাকা শহরে আর দেখা দেখা যায় না। কিন্তু তখন ওইসব গাড়ির ঘোড়াগুলোর কিছু আমাদের চোখের সামনেই থাকত। মাঝে মাঝে হাত-পা ছুড়ে জোরে হাঁক দিলে দেখতাম ভয় পেয়ে যেত।
আমাদের পারিবারিক ডাক্তার আইয়ুব আলীর মেয়েকে দেখতাম ঘোড়ার গাড়ি থেকে কামরুন্নেসা স্কুলের গেটে নামত, আবার ছুটির পর এই গাড়ি করেই ফিরত।
গাড়িতে সবসময় দুজন কোচওয়ান বসা থাকত। একজন ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখত, আরেকজন পাশে বসে থাকত। যেহেতু ঘোড়া থেমে থাকলেও কোচওয়ানরা গাড়িতেই বসে থাকত, তাই আশেপাশের মানুষদের সঙ্গে তাদের আড্ডা জমে উঠত খুব। ঘোড়া চালানোর বাকি সময়টা এরা আড্ডা, হাসিঠাট্টা আর গল্পগুজব করেই কাটাত।
এলাকার ডানপিটে যেসব ছেলে থাকত, গাড়িগুলো যাত্রী নিয়ে চলা শুরু করলেই দৌড়ে গিয়ে গাড়ির পেছন দিকে উঠত। পেছনে একটি বসার জায়গাও ছিল। আর এই দৃশ্য দেখে চারপাশের লোকজন বলাবলি করে উঠত, 'এই এই গাড়ির পেছনে ছেলেরা উঠল।' কোচওয়ানরাও তখন ছেলেগুলোকে গাড়ি থেকে নামানোর জন্য গালিগালাজ শুরু করে দিত। অনেক সময় চাবুকও মারত পেছন দিকে। আমি নিজেও একবার এই দৃশ্য দেখেছি।
তখনও ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করেই চলাচল করতে হতো। ঘোড়াগাড়ি ভাড়া দেয়ার কতগুলো নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড ছিল।
ঘোড়ার রেস নিয়ে জুয়া খেলার আসর!
ঢাকার আস্তাবলগুলোতে ঘোড়াগুলো থাকত, কে দেখাশোনা করতো, কারা তাদের খাওয়াতো জানিনা। ঢাকা ইউনিভার্সিটির এস এম হল এবং সূর্যসেন হলের মাঝামাঝি কাঁটাবন বস্তিতে একটা আস্তাবল ছিল। আস্তাবলের ঘোড়াগুলোকে নিয়ে ঢাকা শহরে রেসের আয়োজন করা হতো। এখন মানুষ ডিভাইসে রেস খেলে। আগে সামনাসামনি ময়দানগুলোতে রেস হতো। রেসকোর্স ময়দান শব্দটা তো আমরা ভুলতে বসেছি। এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান একসময় রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল।
রেসকোর্স ময়দানে প্রতি রবিবার ঘোড়ার রেসের আয়োজন করা হতো। উপচে পড়া সেই ভিড়, জনস্রোত বললে ভুল হবে না! ঘোড়দৌড়ে ঘোড়াকে ঘিরেই জুয়া খেলা হতো। এই জুয়াখেলা তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল। মানুষ ভিড় জমাত, মানুষ আনন্দ পেত রেসকোর্সে এসে। স্বাধীনতার পর ধর্মীয় কারণে (জুয়া খেলার কারণে) শেখ সাহেব রেস বন্ধ করে দেন।
শাহবাগের উল্টোদিকে একটি জিমখানা ক্লাব ভবন ছিল। এটা ছিল ঘোড়ার রেসের ক্লাব। এখন সেখানে ফুলের দোকান। ঘোড়ার রেস পরিচালনা করত এই জিমখানা ক্লাব। পুরান ঢাকার মানুষের জীবনের একটা অংশ ছিল ঘোড়ার গাড়ি।
একজনকে দেখতাম একা ঘোড়ার গাড়িতে করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়াতেন। তার গাড়ির চারপাশে মানুষের এত ভিড় হতো যে ঘোড়াই খেপে যেত! পরে তিনি ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করে দেন।
আসলে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ানো তখন আমাদের সংস্কৃতির একটি অংশ ছিল।
শাড়ি দিয়ে পেঁচানো রিকশা!
রিকশা তো অনেক দেখেছি। কিন্তু পর্দা লাগানো রিকশা আমি আগে দেখিনি। প্রথম যেবার দেখলাম, অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম। আমার মা তখন বললেন, ওরা অনেক পর্দা করে তো, তাই এরকম শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। এর মানে হলো, ওই রিকশাতে মেয়ে আছে। পুরান ঢাকায় চকবাজার, নওয়াবগঞ্জের মতো জায়গাগুলোতে এ ধরনের শাড়ি পেঁচানো রিকশা দেখা যেত। গ্রামে-গঞ্জে কি এখনও এই প্রথা আছে! তবে আমাদের টিকাটুলিতে এ ধরনের রিকশার চল ছিল না।
যখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম, আমার স্ত্রীকে দেখতাম, রিকশাওয়ালাদের দিয়ে বাজার করাচ্ছে। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমার স্ত্রীর আবার খুব ভাব হতো। আমার স্ত্রীকে দেখতাম, রিকশাওয়ালাদের বাজারের তালিকা ধরিয়ে দিতেন। আর রিকশাওয়ালারা বাজার নিয়ে আসত। এই যে সম্পর্কটা, এটা কিন্তু একটা মানবিক সম্পর্ক। এখন এই রকম সম্পর্ক দেখা যায় কি না জানি না।
আবার বাড়িতে যারা বহুদিন ধরে কাজ করতেন, তারা পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠতেন। আমি যাদের কাছে বড় হয়েছি বা আমাদের বাড়িতে যারা কাজ করতেন, তারা পরিবারের বাকি সদস্যদের মতোই ছিলেন আমাদের কাছে। কিন্তু এখন তো কাজের জন্য মানুষই খুঁজে পাওয়া যায় না।
আসলে ইতিহাস যখন এক থাকে, তখন মানুষ সংঘবদ্ধ থাকে। আর ইতিহাস যখন আলাদা হয়ে যায়, তখন আর কোনোভাবেই মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারে না।
গাড়ি থামিয়ে লোকজন ওঠানো হতো জিপগাড়িতে…
আমার বাবা ময়মনসিংহের ন্যাশনাল ব্যংকের শাখা প্রধান থাকা অবস্থায় প্রথম গাড়ি কেনেন। আমার বাবা জিপ গাড়ি খুব পছন্দ করতেন। আমারও খুব ভালো লাগত। একেবারে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যেত। বাবার কল্যাণে আমি জীবনে অনেক বড় বড় গাড়িতে চড়েছি ঠিকই, কিন্তু আমার জিপগাড়িই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। গাড়িতে স্টার্ট দেয়ার জন্য সামনে একটা লোহার শিকের মতো থাকত, সেটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্টার্ট দিতে হতো। ভেতর থেকেও স্টার্ট দিতে হত, তবে অনেক সময় ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেলে দুটো মিলিয়ে স্টার্ট দিতে হত।
'৬২ সাল পর্যন্ত আমাদের জিপ গাড়ি ছিল। ওই সময় ঢাকা শহরে অনেক জিপ গাড়ি দেখা যেত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই জিপগাড়িগুলো পানির দামে বিক্রি হচ্ছিল। তিন-চার হাজার টাকায় গাড়ি কেনা যেত।
জিপ গাড়ির পেছনে জায়গা বেশি থাকায় গাড়ি থামিয়ে লোকজন ওঠানো হতো পেছনে। এক জিপ গাড়িতে দশজন বসতে পারত। পরবর্তীকালে এই জিপ গাড়ি চলে গেল। এরপর তো জাপানিরা গাড়ি নিয়ে আসলো, টয়োটা আরও কত কী…
ঢাকা শহরে তখন খুব কম গাড়ি ছিল। আমাদের পাড়ায় যারা অবস্থাসম্পন্ন ছিলেন, তাদের গাড়ি ছিল। এছাড়া গাড়ি ছিল না বললেই চলে।
নায়ক বুলবুল আহমেদের কাঁধেও চড়েছি!
তবে এসব বাদেও অন্য একটি প্রিয় যানবাহন ছিল আমার। তা হলো মানুষের কাঁধে চড়া। আমার যারা মুরুব্বী ছিলেন, আমি তাদের কাঁধে চড়ে বেড়াতাম। তারা আমাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। আমি নায়ক বুলবুল আহমেদের কাঁধেও চড়েছি। মামা বলে ডাকতাম তাকে। অর্থাৎ নায়ক হতে না পারলেও নায়কের কাঁধে তো আমি চড়েছি!
- লেখক: সাংবাদিক ও গবেষক