টিকাটুলির প্রাণীজীবন
আমার মা জন্মেছেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলীতে। তবে নানার ব্যবসার বদৌলতে, মায়ের বেড়ে ওঠা শিলংয়ে। আমার বাবা-মায়ের বিয়ে হয় ৪৪ সালে হুগলীতে। বিয়ের পর কয়েক বছর তারা কলকাতায় থাকতেন। পরে ৪৮ সালে ঢাকা চলে আসেন। সেবার-ই ছিল আমার মায়ের প্রথম ঢাকায় আসা। টিকাটুলির দশ নম্বর অভয় দাস লেনে থাকতেন তখন।
মায়ের হাত ধরে রেখেছিল বাঁদর!
সেসময় গোটা ঢাকা শহরেই বাঁদরদের চলাফেরা ছিল লক্ষ্যণীয়। তাই ঢাকার আদি নিবাসীদের জন্য বাঁদরের এই চলাফেরা ছিল ডাল-ভাতের মতো অতীব সাধারণ বিষয়। কিন্তু আমার মা যেহেতু প্রথম ঢাকায় এসেছেন, তাই তার কাছে বিষয়টা খুব অদ্ভুত এবং ভীতিকর ছিল।
শুরুর দিকে আমার মা এত ভয় পেতেন যে, ঘর থেকে বের হতেন না। মায়ের কাছে শুনেছি, মা'রা যখন খেতে বসতো, বাঁদরগুলো নাকি লম্বা লাইন ধরে দেয়ালের ওপর বসে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতো। একদিন আমার মা আমার বড় ভাইকে ভাত খাইয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ করে এক বাঁদর ঘরের ভিতর ঢুকে পড়লো। বাঁদরটা এক হাত দিয়ে মায়ের হাত ধরে রেখে, অন্য হাত দিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। বাঁদরটা যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ মায়ের হাতটা ধরেই রেখেছিল। ঐ ঘটনার পর মা বলেছিলেন, 'এতকিছু দেখিছি আমি, ৪৭ এর দাঙ্গাও দেখেছি, কিন্তু এতটা ভয় লাগেনি কখনো!
টিকাটুলি থেকে বাঁদর উৎখাতে আমার বাবার অবদান বেশ উল্লেখযোগ্য ছিল। প্রথমদিকে আমার বাবা বাঁদরের এই উৎপাতকে খুব একটা পাত্তা না দিলেও, এই ঘটনার পর সে-ও সাবধান হওয়ার প্রয়োজন মনে করল। তিনি ঠিক করলেন, বাঁদরগুলোকে গুলি করবেন। কয়েকটাকে গুলিও করলেন।
বাবার এই গুলি খুব কাজে এসেছিল। এই ঘটনার পর বাঁদররাও সাবধান হয়ে যায়। তারা আমাদের বাড়ির চারপাশে আর ঘেঁষতো না।
বাঁদরের জন্য চুন রুটি
আমার নানিও এই উৎপাত কমাতে একধরনের রুটি বানাতেন। রুটিটাকে বেলে তার ওপরে চুন মাখিয়ে জানালার কাছে রেখে দিতো। দেখা যেত, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই বাঁদর এসে ঐ রুটি নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিতো। এরপর বুঝতো মজা! মুখ যেত পুড়ে। কয়েকবার এই ঘটনার পর, বাঁদররা নিজেরাও সাবধান হয়ে গেল। তারা আগে খুলে দেখতো ওর মধ্যে কী আছে!
বাঁদর আযানও শুনতো!
আগে ঢাকা শহরে অনেক জায়াগাতেই বাঁদরের যাতায়াত দেখা যেত। এরা কোনো ক্ষতি করতো না, শুধু খাবারের জন্যই আসতো।
আসলে জঙ্গলের কাছাকাছি বসতিগুলোতে বাঁদরদের যাতায়াত থাকে। একটা সময় ছিল, যখন ঢাকায় মানুষের অনুপাতে বাঁদরের সংখ্যা ছিল বেশি। সেই অনুপাত উলটো হতে হতে আজ বাঁদর প্রায় নেই বললেই চলে।
আমার মা বলেছিলেন, যখন খাবারের সময় হতো তখন একসঙ্গে ১৫-২০টা বাঁদর দেয়ালে লাইন ধরে বসে থাকতো।
মাগরিবের আযান পড়লে, দলবেঁধে ১৫-২০টা বাঁদর উঁচু ভবনগুলোর রেলিংয়ের ওপর বসে থাকতো। বাঁদরগুলো লাইন ধরে বসে আছে, পেছনের আকাশ ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছে। খুব সুন্দর ছিল দৃশ্যটা!
পাড়ার লোকেরা বলতো, বাঁদর নাকি আযান শোনার জন্য রেলিংয়ের ওপর এভাবে লাইন ধরে বসে থাকতো।
তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, এত উৎপাতের পরেও, টিকাটুলির মানুষ বাঁদর বলে কখনো গালিগালাজ করতো না। ওটা যে একটা গালি হতে পারে, তা-ই কেউ ভাবতে পারত না।
ধোপার গাধা
ছোটবেলায় আমাদের কাপড় ধোপারা ধুয়ে দিতেন। লন্ড্রির কাজ আর ধোপার কাজ মূলত একই। তখন তো আর লন্ড্রি ব্যবস্থা ছিল না, ধোপারাই ছিল আমাদের লন্ড্রি। ঢাকায় প্রথম লন্ড্রির নাম ছিল 'পিনম্যান ডি প্যারিস'। আমার বাবা সেখানে কাপড় দিতেন।
যা-হোক, মা-কে দেখতাম যে কাপড়গুলো একটু বাড়তি যত্নের দরকার, সেগুলো ধোপাকে দিয়ে দিতো। ধোপা ওগুলো নিয়ে চলে যেত, দু তিনদিন পরে আবার সেগুলো ফেরত দিতে আসতো।
ধোপাদের সঙ্গে সবসময় একটা বস্তা থাকতো। ঐ বস্তার মধ্যে থাকতো আধোয়া সব কাপড়। গুণে গুণে প্রতিটা কাপড়ের হিসেব রাখতো তারা। কোথাও কিছু লিখে রাখতো না, অথচ একটা কাপড়ও কখনো হারাতো না তাদের কাছ থেকে। শুধু জামার গলায় একটা দাগ দিত, হয়তো চেনার সুবিধার্থে। আমাদের ধোপার নাম ছিল ধনেশ, এখন হয়তো বেঁচেও নেই।
এই ধোপারা বস্তাগুলোকে গাধার পিঠে করে নিয়ে যেত। গাধার দাঁতগুলো দেখে মজা পেতাম। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ গাধা, কিন্তু তখনকার দিনে প্রাণী গাধাও দেখা যেত।
ম্যানহোল থেকে জন্তু বের হয়ে গেছে!
পুরান ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় অনেক সুড়ঙ্গ দেখা যার। আমরা যখন ছোটো ছিলাম, বড়রা বলতো, এই সুরঙ্গে নাকি অদ্ভুত অদ্ভুত প্রাণীরা থাকে। এরা মাটির নিচে ঘুরে বেড়ায় এবং রাত হলে ম্যানহোল দিয়ে উপরে উঠে আসে । তাই ম্যানহোল দেখলেই আমার খুব ভয় হতো।
একবারের ঘটনা মনে পড়ে, একদিন একটা ম্যানহোল ফেটে পানি বের হয়ে গেছে। নোংরা পানিতে সব ভেসে যাচ্ছে। লোকজন নাক চাপছে, এই করছে, সেই করছে।
এদিকে আমি তো ম্যানহোল থেকে জন্তু বের হয়ে গেছে ভেবে ভয় পেয়ে একাকার। কিন্তু মাটির নিচের সেই জন্তুদেরও তো দেখতে ইচ্ছে হয়! তাই অনেক সাহস নিয়ে দেখতে গেলাম। গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিনা। আমি একজনকে জিজ্ঞেসও করলাম, কোনো জন্তু বের হয়েছে? সে উত্তর দিলো, 'পানি বের হয়েছে, জানোয়ার বের হবে কোত্থেকে!'
আসলে বাচ্চাদের বোকা বানানো খুব সহজ এবং মজার একটা বিষয় বটে!
সিজার ছিল খুব বিবেকবান
৫৬-৫৭ সালের কথা । আমরা তখন একটা ছাগল পুষতাম। ছাগলটার একটা বাচ্চাও ছিল। একদিন মা ছাগলটা হারিয়ে যায়। এরপর বাচ্চা ছাগলটা সারাদিন মায়ের জন্য শুধু ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতো। তার দুদিন পর, এ-ই বাচ্চা ছাগলটাও মারা যায়। মা'কে না পেয়ে বাচ্চা ছাগলটা মারা যায়। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম সে-বার।
এরপর আমার বাবা একদিন একটা কুকুরের বাচ্চা নিয়ে এলো। কুকুরটার নাম রাখলেন, 'সিজার'। জুলিয়াস সিজারের 'সিজার'। আমাদের সিজার কিন্তু খুব বুদ্ধিমান ছিল। আমার ছোটোভাই সিজারের মাথায় অনেক আঘাত করতো। ছোটো ছিল, বুঝত না কিছু। এটাকেই খেলা মনে করতো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে যেটা হওয়ার কথা, কুকুরকে কেউ আঘাত করলে সে-ও ঘেউ ঘেউ করে উঠবে, পালাবে বা পালটা আক্রমণ করবে। কিন্তু আমাদের সিজার ছিল খুব বিবেকবান। সে এসব কিছুই করতো না, বরং আমার ভাইয়ের পিছু পিছু হাঁটত। মা বলতেন, 'দেখেছো কত বুদ্ধিমান কুকুর, ছোটো মানুষ বুঝতে পেরে কিছুই করলো না তোমার ভাইকে।'
সিজার আমাদের সাথে প্রায় বারো বছর ছিল। সারাদিন বাড়ির ভিতরে ঘুরে বেড়াতো। একবার বাড়ির সদর দরজা খোলা পেয়ে, সিজার রাস্তায় চলে যায়। রাস্তায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আহত হয়ে ফিরেও আসে। কিন্তু ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েও আমরা ওকে আর বাঁচাতে পারিনি।
লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক