ঘুরে দাঁড়িয়েছে রুবল, এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?
গত ২৬ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে অনেকটা বড়াই করেই বলেছিলেন, "আমাদের নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার ফলস্বরূপ, অবিলম্বে ধ্বসে পড়েছে রুবল (রাশিয়ার মুদ্রা)।" এক অসময়ে এমন টুইট করেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গেলো ফেব্রুয়ারিতে রুশ মুদ্রায় বড় ধরনের ধ্বস নেমেছিল ঠিকই, তবে বাইডেনের উচ্ছ্বাসের মুখেই মুদ্রা বাজারে আবারও নিজের হারানো জায়গা ফিরে পেয়েছে রুবল। রুবলের মূল্যমান এখন প্রায় ১.২ সেন্ট, যা সংকটের আগে ১.৩ সেন্টের তুলনায় কিছুটা কম। তবে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই মুদ্রার মান নেমে গিয়েছিল ০.৮ সেন্ট বা এরচেয়েও নিচে; অন্তত সেই সময়ের তুলনায় এখন অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে রাশিয়ার মুদ্রা।
নিষেধাজ্ঞার মুখে তলানিতে পড়ে যাওয়া রুবলের মান নিমিষেই ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি কী ইঙ্গিত দিচ্ছে আমাদের? এর অর্থ কি তাহলে রাশিয়ার অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও ভালোর দিকে এগোচ্ছে এবং নিষেধাজ্ঞাগুলো কাজ করেনি? নিঃসন্দেহে এটি একটি খারাপ খবর। কারণ এই অনুমান যদি সত্যি হয়, তাহলে রাশিয়া ইউক্রেনে তার সামরিক অভিযান আরও জোরালোভাবে চালিয়ে যাবে।
সেন্টার ফর আ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সিনিয়র ফেলো র্যাচেল জিমবা দ্য পলিটিকোকে বলেন, "যারা মনে করেন রাশিয়াকে ঠেকাতে আমাদের আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, রুবল নিজের অবস্থানে ফেরার পর তাদের এই যুক্তি আরও শক্তিশালী হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছে।"
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে বাস্তবতা হল, স্বল্পমেয়াদে বিবেচনা করলে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থান অনেকের প্রত্যাশার চেয়ে ভালো, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিবেচনার ক্ষেত্রে এটি দুর্বল। রুবলকে শক্তিশালী করতে রাশিয়া যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে, তার অনেকগুলোই সোভিয়েত আমলের। উল্লেখ্য ১৯৯১ সালে নানান সমস্যা ও দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ভেঙে পড়েছিল ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা সোভিয়েত ইউনিয়ন।
গত কয়েক দশক ধরে সারা বিশ্বে অবাধে এবং সহজে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রুবল। এর রূপান্তরযোগ্যতার কারণে পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা রাশিয়ায় বিনিয়োগ করতে এবং রুশ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রাহী হয়েছিলেন। আস্থা তৈরি হয়েছিল তাদের মাঝে। কিন্তু আপাতত অবসান ঘটতে চলেছে সেই যুগের। রুবলের মূল্য বাড়াতে রুশ সরকার অস্থায়ীভাবে বৈদেশিক মুদ্রার মুক্ত বাজার বন্ধ করে দিয়েছে। এতে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে রুবল। এমন ধারণা অনেকেরই।
রাশিয়ার সাবেক উপ-অর্থমন্ত্রী এবং ১৯৯০'র দশকের রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান সের্গেই আলেকসাশেঙ্কো বলেন, "রুবল আর পরিবর্তনযোগ্য নয়। এটি ১৯৯৩ বা ১৯৯৪ সালের পর্যায়ে পৌঁছেছে।"
যুদ্ধের শুরুর দিকে অর্থনীতিবিদদের অনেকেই রুবলের এমন 'টার্ন ব্যাক' ধারণা করতে পারেননি। কারণ এ সময় বাইরের দেশগুলোতে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হিমায়িত বা স্থগিত করা হয়েছিল। সাধারণভাবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল, রুবল দুর্বল হলে পড়লে রাশিয়া তার বৈদেশিক রিজার্ভ রুবল কিনতে ব্যবহার করবে। আর তখন নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই রিজার্ভ অ্যাক্সেস করতে না পেরে দিশাহারা হয়ে পড়বে রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি রাশিয়াকে। কারণ দেশটির কাছে আপাতত ডলার এবং ইউরোসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার অভাব নেই। প্রচুর পরিমাণে তেল ও গ্যাস রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া এবং যুদ্ধের কারণে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি দেশটির রাজস্বও আগের তুলনায় বাড়িয়েছে। গত ১ এপ্রিল ব্লুমবার্গের অর্থনীতিবিদদের অনুমান অনুযায়ী, চলতি বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালে রাশিয়ার জ্বালানি শক্তি রপ্তানির আয় এক তৃতীয়াংশেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে।
পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে আগ্রাসনের জন্য শাস্তিস্বরূপ রাশিয়ার অনেক ভোগ্য এবং শিল্প পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আর এদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে এমন পণ্য আমদানি কমিয়ে আনতে কাজ করছে রুশ কর্তৃপক্ষ। ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের তথ্য অনুসারে, পণ্য ও পরিষেবা এবং বিনিয়োগ আয়ের বিস্তৃত পরিমাণের হিসাবে রাশিয়ার 'ব্যাংক অ্যাকাউন্ট' এ বছর রেকর্ড উদ্বৃত্ত গড়তে যাচ্ছে।
যদিও এই মুহূর্তে রাশিয়ার কাছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে, তবে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ এর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখছে। সাধারণ নাগরিকরা এখন আর বেশি পরিমাণে ইউরো এবং ডলার দেশের বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, রাশিয়ায় প্রবেশ করা ইউরো, ডলার এবং অন্যান্য হার্ড কারেন্সির ৮০ শতাংশ মস্কো এক্সচেঞ্জে বা অনুমোদিত ব্যাংকের মাধ্যমে রুবলে রূপান্তর করতে হবে। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেই হার্ড কারেন্সি অর্থ মন্ত্রণালয় এবং প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর কাছে পাঠাবে; এই প্রতিষ্ঠানগুলো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি সেসব সংস্থাগুলোকে এই কারেন্সি সরবরাহ করবে, যাদের বিদেশ থেকে পণ্য আমদানির অনুমতি রয়েছে।
ক্রেমলিন আরও চাইছে, রাশিয়ার প্রতিকূল রাষ্ট্রগুলো যেন প্রাকৃতিক গ্যাস কেনার (এখন পর্যন্ত তেল নয়) ক্ষেত্রে রুবলে লেনদেন সম্পন্ন করে। তারা চুক্তিতে উল্লিখিত ইউরো, ডলার বা অন্য যেকোনো মুদ্রায় অর্থপ্রদান করতে পারবে, তবে সেই মুদ্রার শতভাগ রুবলে রূপান্তরিত করতে হবে গ্যাজপ্রমব্যাংক (বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গ্যাস উৎপাদনকারী সংস্থা গ্যাজপ্রমকে পরিষেবা দেয় এই ব্যাংক) থেকে। সরকারি বিনিময় হার মেনে লেনদেন সম্পন্ন করতে হবে প্রতিকূল রাষ্ট্রগুলোকে। এ ব্যাপারে আটলান্টিক কাউন্সিলের জিও ইকোনমিক্স সেন্টারের উপ-পরিচালক চার্লস লিচফিল্ড দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, "এই নীতির পূর্বাভাস রুবলের প্রতি অনেক ব্যবসায়ীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনেছে।"
নতুন এই নীতির ফলে সবচেয়ে প্রভাবিত দেশগুলোর মধ্যে জার্মানি ও ইতালি অন্যতম। চাপিয়ে দেওয়া নীতির বিরুদ্ধে তাদের দাবি, চুক্তি লঙ্ঘন করছে রাশিয়া। লন্ডনে নেদারল্যান্ডসের রাবোব্যাংকের মুদ্রা বিশেষজ্ঞ জেন ফোলির ভাষায়, "এই মুহূর্তে মোরগ লড়াইয়ের আসল খেলা শুরু হয়েছে।"
সাবেক উপ-অর্থমন্ত্রী আলেকসাশেঙ্কোর মতে, রাজনৈতিকভাবে পুতিনের কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের লেনদেন ডলারের পরিবর্তে রুবলে নিশ্চিত করা। নিজের আধিপত্য আর ক্ষমতা প্রদর্শনে এটি নিশ্চিত করবেন তিনি।
আলেকসাশেঙ্কোর ভাষায়, "পুতিন বলছেন- আমি নিয়ম আরোপ করতে চাই। অন্যের নিয়ম আমি গ্রহণ করবো না। আমি নিয়ম তৈরি করি; অন্যেরটা অনুসরণ করি না। আমি চাই আপনারা রুবলে লেনদেন নিশ্চিত করুন।"
এরপরেও রুবেলের রূপান্তরযোগ্যতা বন্ধ করা, রাশিয়াকে চিরতরে আন্তর্জাতিক বাজার শক্তি থেকে দূরে রাখতে পারে না। আলেকসাশেঙ্কোর মতে, নিষেধাজ্ঞাগুলো ইতোমধ্যেই মুদ্রাস্ফীতির হারকে বাড়িয়ে তুলতে শুরু করেছে এবং উৎপাদনকারীরা ক্রমেই কাঁচামালের সংকটে পড়তে পারেন। ফোলিও মনে করেন, নতুন করে আবারও চাপের মুখে পড়তে পারে রুবল।
এরপর আবার আসছে 'ব্রেইন ড্রেন' ইস্যু। গেলো মার্চে প্রিন্সটনের এক ভিডিও সেমিনারে গুরিয়েভ বলেছিলেন, "আমার পরিচিতরা সবাই রাশিয়া থেকে পালানোর চেষ্টা করছে।" আর লিচফিল্ড বলেছেন, "রাশিয়ার অর্থনৈতিক এখন খুব খারাপ। মূলধন নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরোপ করা নীতি দেশটির ভবিষ্যতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।"
মোদ্দাকথা, রুবলের বর্তমান মূল্যমান যাই হোক না কেনো, ইউক্রেন আগ্রাসনের জন্য ভারী মূল্য পরিশোধ করছে রাশিয়া। তবে, যুদ্ধ শুরুর অবস্থার তুলনায় রাশিয়ার মুদ্রা এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। আসন্ন দিনগুলোতে মুদ্রা বাজারের পরিস্থিতি কোনদিকে যায়, তা সময়ই বলে দেবে।
- যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত