প্রসঙ্গ: টিপ ও হিজাব
আমার মেয়েকে ছোটবেলায় রাতের চাঁদ দেখিয়ে, সেই আঙুল কপালের মাঝে ছুঁইয়ে বলতাম 'চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা!' আর চাঁদের টিপ কপালে পরে মেয়ে আমার খুশিতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠতো! তখনও বাংলাদেশের জীবন বোধহয় এত জটিল হয়ে ওঠেনি! কন্যাকে এই ছড়া বলে টিপ দেয়ার আগে আজকের মায়েদের হয়ত দুবার ভেবে নিতে হবে!
টিপ নিয়ে একজন হিন্দু নারীর সাথে এক পুলিশের যে কাণ্ডটি খবরে এসেছে, সেটা অতি নিন্দনীয় কিন্তু আদতে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনাই ছিল। কিন্তু এর পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সমগ্র ব্যাপারটিকে অন্য মোড়ে নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। বরাবরের মতো দুটি বিপরীত মারমুখী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছি আমরা। এটি পুরোপুরি অনাবশ্যক ছিল। ধর্মীয় স্বাধীনতা ও নিরাপদে চলাচলের অধিকার সর্বজনীন নাগরিক অধিকার। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের এসব অধিকার থাকার কথা ছিল। কারও বেশভূষা সেই অধিকারে কমতি ঘটাতে পারে না! মনোযোগ দেয়া দরকার ছিল এখানে। অথচ আমরা ফোকাস করলাম টিপে! আমার সারাজীবনের অভিজ্ঞতায় টিপের কারণে কাউকে রাস্তায় নিগৃহীত হতে দেখিনি বা শুনিনি। গুটিকয়েক ঘটনা হয়ত ঘটে থাকতে পারে, কিন্তু তা কোনোমতেই সামগ্রিক চিত্রের অংশ ছিল না। এখন টিপকে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে বসানোর ফলে সমাজে এটা নিয়ে অ্যালার্জি ও অতিপ্রেম উভয়ই বাড়বে, সন্দেহ নেই।
আমার কাছে একটি ছবি আছে, ষাটের দশকের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েকটি মেয়ের ছবি। পারিবারিক অ্যালবামের ছবি হলেও তখনকার সময়কে অনেকটা ধারণ করে বলে ছবিটি মূল্যবান। পাঁচ বান্ধবী মিলে স্টুডিওতে গিয়ে শখ করে ছবি তুলেছেন। ছবির মেয়েরা সেই সময়ের নারী, যখন অল্প বয়সে বিয়েটাকে বিয়ের বাজারে মেয়ের 'কদর' বেশি হওয়ার প্রমাণ হিসেবে গর্বের বিষয় ধরা হতো! বিয়ের হিড়িক এড়িয়ে কম সংখ্যক মেয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত আসার সুযোগ পেতেন বা ইচ্ছা রাখতেন। এই তাঁরা সেই পথিকৃৎ বাঙালি নারীদের অংশ, যাঁরা সেসময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগকে সাহস, সক্ষমতা ও সদিচ্ছা দিয়ে কাজে লাগিয়েছেন এবং জোরকদমে হেঁটে নারীদের পথ চলার অন্তরায়গুলো সরাতে পেরেছেন বলেই আমরা সহজে সেই পথে চলতে পেরেছি, এখনকার মেয়েরা পারছে আরও অনায়াসে। সেই নারীরা ছবি তোলার জন্য সেজেছেন, শাড়ি পরেছেন; কপালে কিন্তু টিপ পরেননি কেউ! সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যয়নরত কয়েকজন ছাত্রীর একটি ছবিও অন্তর্জালে ঘোরাঘুরি করে তখনকার প্রগতিশীলতার 'প্রমাণ' হিসেবে। তাঁদেরও কারও কপালে দৃষ্টিগোচর টিপ নেই।
আমরা যদি নিজ নিজ পরিবারের মহিলা গুরুজন বা অন্য বয়স্ক পরিচিতদের কথা চিন্তা করি, তাহলে এটাই সম্ভবত স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে টিপ পরনেওয়ালা নারী সামগ্রিকভাবে কমই ছিলেন। আমি বাঙালি মুসলিম নারীদের কথা বলছি। ধর্মীয় বিশ্বাসজাত সংস্কৃতি হিসেবে সিঁদুর ও কুমকুম হিন্দু নারীদের সজ্জার অংশ হয়ে আছে বহুকাল থেকেই। ধর্ম নির্বিশেষে নারীদের সাজের উপকরণ হিসেবে টিপের প্রচলন অনেকটাই আধুনিক ঘটনা। আমাদের প্রজন্ম থেকে নতুন প্রজন্মে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলা উচিৎ। এই যে পাঁচ বান্ধবীর ছবির কথা তুললাম, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ঘরানার মেয়ে সবাই। তাঁরা কেউ অবশ্য হিজাবও পরেননি, প্রত্যেকেই স্বাভাবিক ধাঁচে শাড়ি পরা। যে ধরনের হিজাব আমরা অনেকেই পরছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা পরিধান করছে, এর প্রচলনও একটি সাম্প্রতিক ঘটনা বটে। আমাদের নানি-দাদিরা বেশিরভাগই মাথায় ঘোমটা দিতেন। তন্মধ্যে কিছু মহিলা বাইরে বেরোলে বোরখা চড়াতেন। পক্ষান্তরে, আজকাল বাংলাদেশের রাস্তায় হিজাব-পরিহিতারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বললে ভুল হবে না। নিকাব আছে, খিমার ধরনের পোশাকও অনেক বেড়েছে। আবার এর বিপরীতে পশ্চিমা পোশাকের ঝোঁকটাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ সবকিছুই সামাজিক বাস্তবতা, এবং তা সদা বহমান। কোনোটিকেই চাপিয়ে-ভুলিয়ে দিয়ে, উপহাস-অস্বীকার করে সামনে এগোনো যাবে না। এখানে সাম্প্রতিক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্রীর হিজাব/নিকাব বিষয়ক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা উল্লেখ্য। এটা দুঃখজনক যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় ধর্মীয় পোশাকের জন্য কেউ বিরূপ আচরণের শিকার হবে। একটি সত্যিকারের উদারনৈতিক পরিবেশে এমনটি ঘটতে পারতো না। হিজাবের কারণে কেউ অবহেলার শিকার হলে, এটাকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভাবেই মোকাবেলা করতে হবে এবং অবশ্যই আওয়াজ তুলতে হবে। তবে রাষ্ট্রের কাছে হিজাব/নিকাব রক্ষার দাবী তোলা কতখানি যুক্তিযুক্ত, তা ভেবে দেখার দরকার আছে। পোশাক রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের আওতায় দিয়ে দিলে, রাষ্ট্র যদি পোশাক কেড়ে নেয়ার ক্ষমতাও পেয়ে বসে, তখন কী হবে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের ভেতরে যে অসুস্থ রকমের হিজাব-বৈরিতা বিরাজ করে, তা কোনো অজানা ব্যাপার নয়। হিজাব/নিকাব নিয়ে ক্লাসে কটূক্তি করা, এই পোশাক পরতে নিষেধ করা, নিষেধ না শুনলে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া মৌলিক ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপর চরম আঘাত, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যে শিক্ষক নিজেকে প্রগতিশীল মনে করেন, তিনি এই ভূমিকা রাখেন কোনো নীতিতে তা কি তিনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন? অবশ্যই সমাজভেদে পোশাকের ভিন্নতা থাকে এবং একটি সমাজের জন্য সেই ভিন্নতা একটি বর্ণালী জুড়ে বিস্তৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ড্রেস-কোড থাকে না, থাকতে পারেও না। এহেন জায়গায় কোনো ধরনের পোশাক গ্রহণযোগ্য হবে, তা সমাজে বিরাজমান সামষ্টিক সম্মতির ভিত্তিতে সার্বিকভাবে নির্ণীত হয়ে থাকে। আর হিজাবে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? একটি মেয়ে নিজেকে অন্য আরেকজনের চাইতে কিছুটা বেশি আবৃত রেখেছে, এতে ক্লাসে কোনো শিক্ষকের কী জাতীয় অসুবিধা হওয়া সম্ভব?!
যদি কেউ নিকাব পরে থাকে, তাহলে একজন শিক্ষক প্রয়োজন মনে করলে শনাক্তকরণের নিমিত্তে তার চেহারা একবার দেখতে চাইতে পারেন। বিশেষত পরীক্ষার হলে এটি আরই বেশি প্রযোজ্য। যেকোনো নিকাবি ছাত্রী এই নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাকালীন নিয়মের মধ্যে মুখ ও কান খোলা রেখে পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপার আছে। যতদূর জানি, কানের সাথে জড়ানো কোনো ডিভাইস দিয়ে নকল ধরা পড়ার পর থেকে এই আইন চালু করা হয়েছে। দুই-একজন দুর্নীতিপরায়ণ পরীক্ষার্থীর জন্য এখন সমস্ত পর্দানশীন মেয়েকে পরীক্ষার হলে এই নিয়ম মেনে চলতে হয়। দেখেছি, অনেক মেয়ে কি অস্বস্তি নিয়েই না পরীক্ষার মুহূর্তে কান দুটি উন্মুক্ত করে! কিন্তু কিছু করার নেই, নিয়মটা জেনে পরীক্ষা দিতে এসে তো নিয়ম মানতেই হবে। কিংবা অন্য যে কোনো স্থানে, যেখানে প্রাসঙ্গিক। তবে শুধুমাত্র শনাক্ত করার মধ্যেই যেন প্রক্রিয়াটি সীমাবদ্ধ থাকে। যতদিন পর্যন্ত চেহারা কোনো ব্যক্তিকে আইডেন্টিফাই করার প্রচলিত পন্থা, ততক্ষণ শনাক্তকরণের স্বার্থে প্রত্যেকে তা মানতে বাধ্য।
আবার টিপে ফিরে আসি। ব্যক্তিগতভাবে, টিপ আমার বেশ পছন্দের একটি সাজ। আজকাল বাঙালি মেয়েরা সাজতে গিয়ে অনেকেই টিপ ব্যবহার করে, ধর্ম নির্বিশেষে। অনেকের কাছেই টিপ সাজসজ্জার অংশ হয়ে গেছে; তবে এর বেশি কিছু নয়। এর চাইতে অধিক জোরাজুরি করতে গেলেই সমস্যা ঘনীভূত হয়, এবং সেটাই এখন এই ইস্যুতে দৃশ্যমান হচ্ছে। টিপ "হিন্দুয়ানী" কালচার বলে একদল নাখোশ। অন্য দল একে "বাঙালিয়ানা"র প্রতীক বানিয়ে ফেলছেন। আবার কারও কারও কাছে কপালে বড় লাল টিপ একটি রাজনৈতিক প্রতিবিম্ব ও প্রতিবাদ! ধর্ম বা সংস্কৃতি বা প্রগতি, যে নামেই হোক না কেন, এই প্রতিটি অবস্থানই প্রতিক্রিয়াশীল। টিপ বেচারা নিজে ছোট্ট একটি নির্দোষ সজ্জা হতে পারতো; কিন্তু তা হবার নয়! প্রায় প্রতিটা ইস্যুর মতোই এখানেও চরম ঠেলাঠেলির ফলাফলে তাই শুধু বিষম কষ জমছে "এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে"!
- ড. রায়হানা শামস্ ইসলাম: প্রফেসর, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়