পঞ্চাশের দশকে ঢাকার আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি
পঞ্চাশের সময়টায় ঢাকা শহর ছিল খুব সুন্দর। কারণ তখন ঢাকায় ছিল না কোনো ট্রাফিক, ছিল না যানজট। ঢাকার আকাশ ছিল কালো ধোঁয়ামুক্ত। বহুতল ভবনের আড়ালে সেই আকাশ চাপা পড়ে যায়নি তখনও।
রাস্তা ছিল পথচারীর অধীনে। দু'একটা গাড়ি, রিকশা কিংবা বাস হয়তো দেখা যেত। তবে রিকশার শহর হয়ে উঠতে পারেনি ঢাকা তখনও। কারণ মানুষ ছিল কম। মানুষ জীবিকার জন্য তখনও ঢাকামুখী হয়নি। ঢাকা ছিল শান্তিপূর্ণ, কোলাহলহীন, ছিমছাম এক শহর। এরকম এক নির্মল শহরে আমার জন্ম হয়েছিল ১৯৫২ সালে।
এখন আমরা ঘড়ির কাঁটায় চলি। তখন আকাশ দেখেই বলা যেত, কখন সকাল, কখন বিকেল, কখন দুপুর। এখন তো আকাশই দেখা যায়না। আমি যেখানে থাকি সেখানে অ্যাপার্টমেন্ট-ই আকাশ। অথচ আগে, কখন ভোরের আলো ফুটছে, কখন দুপুর হচ্ছে, কখন সন্ধ্যা হচ্ছে সব দেখতে পেতাম।
একবার ভোরেই ঘুম ভাঙ্গে, সেদিন দেখেছিলাম আস্তে আস্তে আকাশটা কীভাবে অন্ধকার থেকে আলো হয়ে ফুটলো। একটা সময় পুরো আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখছিলাম, আকাশটা পুরোটা নীল হয়ে গেল। এ দৃশ্য যে কী চমৎকার, তা না দেখলে বোঝা যাবে না। আমার মা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল, 'কী দেখো'। আমি কিছু বলিনি। একটা ছোটো বাচ্চা আকাশ দেখছে, এটা তো এক অদ্ভুত বিষয়!
ছোটোবেলার দুপুরগুলো এখনকার দুপুরের মতো ছিল না। রোদ ছিল, কিন্তু তাপ ছিল না। বাসা-বাড়িতে এসি ছিল না, ফ্যানের বাতাসই ছিল যথেষ্ট।
মেঘ দেখতাম
আমাদের বাড়ি ছিল একতলা। তখন তো উঁচু বাড়ি মানে দু'তলা, তিনতলা। আমাদের বাড়ির চারপাশে দুইতলা, তিনতলা বাড়ি ছিল না বলে আকাশটা পুরোটুকু দেখা যেত।
একদিন আমাকে মামা কোলে নিয়ে বললেন, 'দেখ, মেঘ দেখ'। আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মেঘের ভেসে বেড়ানো। কিন্তু এই যে মেঘ দেখতে বলার বিষয়টা, এটা কি এখনকার বাবা মা, মামারা করবে? এখন তো মেঘ দেখার সুযোগই নেই। ঢাকা শহরে মেঘ, আকাশ বলতে কিছু নেই, সব চলে গেছে। তখনকার দিনে 'মেঘ', 'আকাশ' ছিল। আমি আর আমার ভাই একদিন আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, একটা মেঘ কিভাবে একটা কুকুরের মতো আকৃতি নিল! এভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল। আমাদের হাতে কম্পিউটার, মোবাইল, গেম-টেম কিছু ছিল না। এখনকার বাচ্চারা তো অসহায়ের মতো এ-সব নিয়েই অবসর কাটায়। এভাবেই হয়তো পরিবর্তন আসে।
তবে সবচেয়ে সুন্দর ছিল গোধূলি বেলা
সন্ধ্যার আকাশের এই রং পরিবর্তন দেখতে ছোটো বাচ্চা থেকে বয়স্ক মানুষ সবাই আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। সন্ধ্যার আকাশে কত রং ! আমার বাবার মতো একজন গুরুগম্ভীর মানুষও , যখন ঐ আকাশ দেখে গুনগুন করে গান গাইতো, তখন বোঝাই যাচ্ছে এটা কোনো সাধারণ দৃশ্য ছিল না। আমার যদি কখনো সন্ধ্যাবেলার কথা মনে পড়ে, তবে এই টিকাটুলির সন্ধ্যাবেলার কথাই মনে পড়বে।
'ছাদে যাই' কথাটা শোনা যেত
তখন ছাদ সংস্কৃতিটাও ছিল। ছাদে কাপড় শুকোতে দেয়া হতো। একটা ঘরও থাকতো সেখানে। বৃষ্টি যখন হতো, কাপড়গুলো টেনে ছাদের ঘরে এনে রাখা হতো। বিকেল বা সন্ধ্যেবেলা, 'ছাদে যাই' কথাটা শোনা যেত। পরিবারসহ সবাই মিলে ছাদে উঠে আকাশ দেখতো। এখন আর কেউ ছাদে যায় না। গেলেও হাঁটতে যায় হয়তো। কিন্তু পরিবারসহ এই ছাদে যাওয়ার রীতিটা এখন নেই বললেই চলে। অনেক বাসায় তো ছাদেই ওঠার-ই নিয়ম নেই।
সন্ধ্যা মানেই আযান
সন্ধ্যা মানেই নামাজে যাওয়ার নিয়ম ছিল। নামাজ নিয়ে তখন এত হৈচৈ, মাথাব্যাথা, ফেসবুকে লেখালিখি, পোস্ট ছিল না। নামাজ ছিল মানুষের জীবনের একটা অংশ। যে পড়তো, পড়তো। যে পড়তো না, সে পড়তো না। এই নামাজ পড়া আর না পড়া নিয়ে মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য ছিল না। অনেকেই মসজিদে যেত, আবার অনেকেই যেত না। এটা কোনো বিষয় ছিল না।
আকাশ দেখেই বলতাম বৃষ্টি হবে কি-না
ঝুম বৃষ্টি এখন আর হয়না। এখন তো একটু হয়েই বৃষ্টি থেমে যায়। কিন্তু আগে ঢাকায় ঝুম বৃষ্টি নামতো। সে কি মুষলধারে বৃষ্টি! মানুষ আশেপাশের বাড়ি, দোকানে গিয়ে আশ্রয় নিতো। তখন তো মানুষের মধ্যে এত ভয় ছিল না, এত চুরি-চামারি ছিল না। একদিনের ঘটনা মনে আছে, এরকম মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো, একজন এসে বাড়ির সামনে আশ্রয় নিলেন। আমার মা এত রক্ষণশীল ছিলেন, তাও তাকে বললেন, 'আপনি ভিতরে এসে দাঁড়ান, বৃষ্টি থামলে চলে যাবেন।' এরপর লোকটা ভিতরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। অপেক্ষা করছিল কখন বৃষ্টি থামবে।
এই যে একজন অচেনা বাইরের লোক বাড়ির ভিতর রয়েছে, তাতে কিন্তু কিছু যায় আসছিলো না কারও । বাড়ির কাজকর্ম সব স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। বাইরের একটা লোক যে বাড়ির ভিতরে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু এখন কি এরকম নিশ্চিন্তে থাকা যায়? পরিচিত মানুষ এলেও ভিতরের ভয় রয়েই যায়।
দরজাগুলো সব বন্ধ থাকে এখন
বৃষ্টি হলে খাওয়ার একটা আয়োজন হতো। খিচুড়ি, ইলিশ মাছ, বেগুন ভাজি, পটল ভাজি। এই রান্নাগুলো অন্য সময়েও হতো। কিন্তু বৃষ্টি হলে রান্নাগুলো হবেই। আমাদের মায়েরা এই রান্নাগুলো নিজ থেকেই করতেন। যেন এটাও একটা উৎসব! একবার আমাকে মামার বন্ধুরা এসে বললো, 'বৃষ্টি হচ্ছে তোমার মা কি আজ ইলিশ ভাজবে?
ভাজলে আমাদেরও দিতে বলবে।'
আমি বুঝিওনা তখন ইলিশ ভাজা মানে কী। আমি গিয়ে সোজা মাকে জানালাম, মামারা এসে বলেছে ইলিশ মাছ ভেজে দিতে। মোড়ায় বসে চুলায় রান্না করছিল মা। তখন রান্নাঘরগুলো বারান্দার মতো হতো। আমার মা রান্না করে ঠিকই এক প্লেট ইলিশ ভাজা বড় ভাইয়ের হাতে দিয়ে বললো, 'যাও দিয়ে আসো মামাদেরকে।'
বাহিরের মানুষদের বাড়ির রান্নার উপর এই অধিকারবোধটুকু, এখন আর নেই। এই যে মাছ ভাজি করে ছোটোভাইয়ের বন্ধুকে পাঠাচ্ছে, এই সংস্কৃতিও এখন হয়তো হারিয়ে গেছে। অ্যাপার্ট্মেনটের ভিতরে কোন ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে না হচ্ছে, তা আজ কেউ জানে না। দরজাগুলো সব বন্ধ থাকে এখন। তখনকার দিনে দরজা বন্ধ হতো না। কেবল রাতের বেলায় বন্ধ হতো।
বাবার সঙ্গে হাঁটতে বের হতাম সন্ধ্যার পর
বিকেলে নাস্তা খাওয়ার চল ছিল। এখন আছে কিনা জানিনা। তখন তো দোকানের জিনিস কম পাওয়া যেত। ময়দার ওপর চিনির শিরা দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির মিষ্টি আইটেম বানানো হতো।
সন্ধ্যেবেলা আযানের পর মানুষ রাস্তায় হাঁটত। বাবারা ছেলেমেয়েদের নিয়ে হাঁটতে বের হতো। তখন রাস্তায় পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা যেত। আমাকে নিয়ে বাবা প্রায়ই সন্ধ্যার পর ট্রপিক্যাল ক্লিনিকে ড. আইয়ুব আলীর কাছে যেতেন। কোনো দরকারে নয় কিন্তু, গল্পগুজব করতেই যেতেন।
মিষ্টি এখন প্যাকেটে বিক্রি হয়। তখন পাতায় হতো। আমার মনে আছে, রসগোল্লার ঐ সবুজ কলাপাতার মধ্যে রসগোল্লা বিক্রি করতো ছোটো ছোট চারটা। মানুষ চারটা রসগোল্লা হাঁটতে হাঁটতে খেত। এখন মিষ্টি খাওয়া তো একটা আয়োজনের ব্যাপার। তখন এটাকে কেউ খাওয়ার মধ্যেই ফেলতো না। লোকজন হাঁটতে-হাঁটতে, দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে খেত।
নৌকায় চড়ে অফিসে যেত বাবা!
বৃষ্টির পানি জমে গেলে অনেক মজা লাগতো। মাঝে মাঝে মাছও আসতো ঐ পানিতে। বন্যার পানিতে আমি নিজে বাড়ির ড্রেনে মাছ দেখেছি। আমার মনে আছে, একবার মামাকে দেখেছিলাম, ঐ পানি থেকে মাছ ধরছে।
বন্যার সময় আমার বাবাকে দেখতাম সকালে অফিসে যাচ্ছেন নৌকায় চড়ে। নৌকাগুলো ছিল আমাদের এখনকার লেগুনার মতো, যাত্রীরাও বাইতেন, মাঝিও বাইতেন। সুতরাং সে-বার কী ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল তা অনুমেয়।
এই ছিল ছোটোবেলায় দেখা ঢাকার রূপ-বৈচিত্র্য।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক