যারা আমাদের খাদ্যের যোগান দেন তাদের বিপদে রাষ্ট্র কেন পাশে দাঁড়ায় না?
ইউক্রেন- রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের সংকট পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে গত সংসদ অধিবেশনে খাদ্যমন্ত্রী এক প্রশ্নে জবাবে সংসদকে জানান, ২০২১- ২২ অর্থবছরে আমাদের ৪ কোটি ৭ লাখ টন খাদ্যশস্য (চাল ও আটা) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি একটি গাণিতিক হিসাব করে দেখিয়েছেন, আমাদের দৈনিক গড় মাথাপিছু খাদ্যশস্য গ্রহণের পরিমাণ ৩৮৭ গ্রাম। যার মধ্যে ৩৬৭.২ গ্রাম চাল এবং ১০.৮ গ্রাম আটা। দেশের লোকসংখ্যা ১৬ কোটি ৭০ লাখ ধরে খাদ্যমন্ত্রী সংসদে ওই হিসাব দিয়েছেন।
এবারের বোরো মৌসুমে ২ কোটি টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। দেশের সাতটি জেলা কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সুনামগঞ্জের হাওরে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ১৩৮ হেক্টর জমিতে। হাওর থেকেই ১২ লাখ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবারে ৯ হাজার ৭০০ হেক্টর জমি পাহাড়ি ঢলের কবলে পড়েছে। ঝুঁকিতে রয়েছে সবগুলো। আগাম ধান কেটে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছ কৃষি দপ্তর থেকে। কাঁচা- আধাপাকা ধান কাটতে কৃষক বাধ্য হচ্ছেন। কাটার পরও আনতে না পারার কারণে ঘরে তুলতে পারছেন না।
এই সাত জেলায় প্রতি বছর হাওর ও 'নন- হাওর' মিলিয়ে সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়। আমাদের প্রায় ১৭ কোটি মানুষের প্রতিবছর ৪ কোটি টনের অধিক চালের প্রয়োজন হয়। কৃষি থেকে দৃষ্টি সামান্য সরানোর উপায় নেই। সর্বনাশ হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোথাও এখন উদ্বৃত্ত চাল উৎপাদন করা হয় না। চাইলে কিছু গম হয়ত সংগ্রহ করা সম্ভব কিন্তু প্রকৃত সংকট চাল নিয়ে। আমাদের খাদ্য চাহিদার অর্ধেক জোগান দেয় বোরো। আমাদের দেশের সামগ্রিক কৃষি প্রভূত উন্নতি করেছে। হাঁস- মুরগি, পশুপালন, মৎস চাষ, খাদ্যশস্য সব মিলিয়ে বিশ্ব দরবারে প্রশংসিত আমাদের কৃষি। ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার, প্রায় সকল জমি তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর করা হয়েছে।
পতিত জমি এখন তেমন দেখা যায় না। কিন্তু হাওরের অবস্থা ভিন্ন। এখনকার জমি বছরের ৬ মাসে পানির নিচেই থাকে। চাষের জন্য সময় পাওয়া যায় মাত্র ৪ মাস। এখানকার মানুষ এক ফসলি ধানের উপর নির্ভর করে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না। কৃষিতে এখানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি। সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর কৃষি। হাওরের পানি আসা ও বের হয়ে যাওয়ার সময়ের ব্যত্যয় ঘটলেই ধান উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। চাষীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
২০১৭ সালের মহাবিপর্যয়ের পর হাওরের প্রকল্প গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ প্রক্রিয়া ঢেলে সাজানো হয়। স্থানীয় কৃষক নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, প্রতি তিন- চার বছরের বিরতিতে অস্বাভাবিক বা অকালবন্যা বা ঢলের ঘটনা ঘটে। প্রতিটি হাওরের ধরন ও বৈশিষ্ট্য আলাদা। ফলে হাওর নিয়ে কোন পরিকল্পনা করতে হলে স্থানীয় কৃষক ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তা না হলে কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। এখন আবার হাওর বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ২০১৭ থেকে ২০২২ পাঁচ বছর, অনেকটা সময়। ২০১৭ এর সুপারিশ কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি?
হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ঠিকাদারী ব্যবস্থা বাতিল করে স্থানীয় কৃষক ও অংশীজনদের নিয়ে 'প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি- পিআইসি' গঠন করে তার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। কেন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া তা সকলের জানা। প্রতিটি প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতির কথা সকলে জানা। এই দুর্নীতির সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদার সমভাবে জড়িত। ফলে পিআইসি গঠনের সিদ্ধান্ত সমাজের বিরাট এক বিত্তশালী অংশের লুটপাটের ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শুরু হয় নানামুখীন ষড়যন্ত্র। সিদ্ধান্ত ছিল হাওরের পাশের নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি করে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো।
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসল রক্ষার জন্য ২০২০ সালে মোট ৬১৫ কিলোমিটার বাঁধ তৈরির জন্য ৭৭৯ টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সময় নির্ধারণ করা হয় ৭৫ দিন। ডিসেম্বরে শুরু হয়ে ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা। ২০২০ এবং '২১ সালের অভিজ্ঞতা হল, প্রকল্প নকশা প্রণয়নে বিলম্ব, অনুমোদনে বিলম্ব এমন কি পিআইসি গঠনেও বিলম্ব। ফলাফল নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়া। প্রচন্ড ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কৃষক জমি আবাদের কাজে হাত দেয়। ভাগ্যভাল কোন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়নি।
প্রশাসনিক অসহযোগিতা থেমে নেই। প্রতিবারই দেখা যায়, বাঁধ তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কোন না কোন অজুহাতে পিআইসি সময়ের কাজ সময়ে শেষ করতে পারছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন ও পাউবি পিআইসিকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চাইছে। তারা আবার ঠিকাদারী ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চায়। প্রশাসনের বাইরে ঠিকাদাররাও অনেক প্রভাবশালী এবং তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথে যুক্ত। এরকম পরিস্থিতিতে অনেকটা অসহায় অবস্থার মধ্যে ওখানকার কৃষকরা।
হাওরে পানি প্রবেশ ও সময়মত বের হওয়াটা জরুরি। সেকারণে হাওরের সাথে সংযুক্ত নদীগুলোর যথাযথ নাব্যতা রক্ষা করা গেলে হাওরের অতিরিক্ত পানি ধারণ ও পানি বের হতে সহজ হয় এটাই প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। নদীগুলো ড্রেজিং করে নাব্যতা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হয়নি। কিশোরগঞ্জ হাওরে প্রায় ৩০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। পানি বের হওয়ার জন্য ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে সব মিলিয়ে ১ কিলোমিটারের মত কালভার্ট রাখা হয়েছে। অর্থাৎ আগে যে পানি ৩০ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে বের হতো তা এখন ১ কিলোমিটার পথ দিয়ে বের হবে।
সে কারণে কিশোরগঞ্জ হাওরে স্থায়ী জলাবদ্ধতার আশংকা করা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ হাওরের তলদেশে এখন বালু জমছে। হাওরের সাধারণ বৈশিষ্টের মারাত্মক পরিবর্তন ঘটছে। অপরিকল্পিত উন্নয়নের সর্বনাশা শিকার কিশোরগঞ্জের হাওর। নীতি নির্ধারনী মহলের টনক নড়েছে। ঘোষণা এসেছে, হাওরে আর কোন রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। খুব প্রয়োজন হলে উড়াল রাস্তা তৈরি হতে পারে।
আমরা কেন এই ফসল যোদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে পারছি না। যে যোদ্ধারা আমাদের বৈশ্বিক মন্দা বুঝতে দেননি। যারা করোনার ক্ষতি বুঝতে দেননি। যারা যে কোন প্রাকৃতিক দুযোর্গ বুকে ধারণ করে নিজেরাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের খাদ্যের যোগান দেন সেই অমিত সাহসী মানুষগুলোর বিপদে রাষ্ট্র কেন পাশে দাঁড়ায় না। কেন মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষীদের দমন করা যায় না। ঐ মানুষগুলোর রাজনৈতিক পরিচয়ই কী রাষ্ট্রকে অন্ধ করে দিল?
- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক