পাঠ্য থেকে বাদ দিলেও ফয়েজ কেন চিরকালই প্রাসঙ্গিক থাকবেন?
সম্প্রতি ভারতের দশম, দ্বাদশ ও একাদশ শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ফয়েজ আহমাদ ফয়েজের কবিতা। অর্থাৎ তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে ইতিহাস থেকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চেষ্টা করা হচ্ছে তাকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলতে। কিন্তু এ চেষ্টা কখনোই আলোর মুখ দেখবে না।
কারণ তার কবিতা প্রতিবাদের কবিতা। ক্ষমতাযন্ত্র সংগত কারণেই তার কবিতাকে ভয় পায়।
অউর ভি দুঃখ হ্যাঁয় জামানে মে মহাব্বাত কে সিভা/
রাহাতে অউর ভি হ্যাঁয় ভাসল কি রাহাত কে সিভা।
(পৃথিবীতে প্রেম ছাড়া অন্য দুঃখও আছে/
প্রেমিকের মিলনের চেয়ে বড় স্বস্তিও আছে।)
এই লাইনগুলো প্রথম শুনি আমার মায়ের মুখে। তখন আমার বয়স কত, মনে নেই। তবে লাইনগুলো আমাকে এমন এক দুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় যেখানে কবিতাকে প্রিয়জনের প্রশংসার জন্য ব্যবহার করা হয় না, ব্যবহার করা হয় নিপীড়িতের অধিকারের কথা বলার জন্য।
আমি বেড়ে উঠছিলাম এমন এক স্বাধীন ভারতে যা টইটুম্বুর ছিল আদর্শবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদে। ১৯৬০-এর দশকে, যখন বেড়ে উঠি, তখন স্বভাবতই আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি ছিলেন সাহির লুদিয়ানভি।
অবাধ্যতা শেখা
কিন্তু ফয়েজ আহমাদ ফয়েজের (১৯১১-১৯৮৪) এই নাজম, বা কবিতাটি অচিরেই আমার সবচেয়ে প্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাটির প্রথম লাইন—'মুঝ সে পাহলি সি মহাব্বাত মেরি মাহবুব না মাং (প্রিয়তম, আমার কাছ থেকে আগের [সেই তীব্র] ভালোবাসা দাবি কোরো না)'।
প্রথম কৈশোরে অবাধ্যতা কিংবা প্রতিবাদ, এমনকি কোনো কাজ এড়িয়ে যাওয়ার জন্যও নানা সময়ে নানাভাবে এই কবিতাকে ব্যবহার করেছি।
১৯৪১ সালে প্রকাশিত কবিতাটি ফয়েজের প্রথম কবিতা সংকলন 'নকশ-ই ফরিয়াদি'-তে সংকলিত হয়। তখন ছিল অশান্তির সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়ছে অবিভক্ত ভারত। উপমহাদেশের অন্যান্য কবিদের সঙ্গে ১৯৩০-এর দশকে লন্ডনে সাজ্জাদ জহির ও মুলক রাজ আনন্দের হাতে প্রতিষ্ঠিত প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের অংশ হন ফয়েজও। চারপাশের নানা অনাচারের ঘটনায় ক্ষুব্ধ কবি ও লেখকেরা তাদের কণ্ঠস্বর ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।
তাই প্রেয়সীর উপর আর মনোযোগ থাকেনি—'প্রেমিকের দুঃখের' বদলে মনোযোগ সরে যায় 'জাগতিক দুঃখে'। সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী ও স্বৈরশাসকদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লিখতে থাকেন কবি-সাহিত্যিকরা।
এই নাজমের শুরুতে ফয়েজ বারো শতকের ফারসি কবি নিজামি গানজাভিকে উদ্ধৃতি করেছেন: 'দিল-ই-বা-ফারোখতাম জান-ই-খারেদাম (আমি আমার হৃদয় বিক্রি করে একটি আত্মা কিনেছি)'।
ফয়েজের কবিতা ছিল প্রতিবাদের, বিবেকের, আত্মার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার কবিতা—তা সেই প্রতিবাদ পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই হোক কি রাজনৈতিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই হোক। ভারতে আমরা সাহির লুধিয়ানভিকে (১৯২১-১৯৮০) চিৎকার করে বলতে দেখেছি, 'জিনহে নাজ হ্যাঁয় হিন্দ পে ভো কাহাঁ হ্যায় (হিন্দে গর্ব করে যে মানুষগুলো, তারা কোথায়)?'
নিরাপদ, নিশ্চিন্ত এক জীবনযাপন করার পর, ফয়েজের এই বাক্যগুলো আমার সামনে এক নতুন জগতের বাতায়ন খুলে দেয়। আমাদের বিশ্বাসের সন্ধান পাই ফয়েজের এই বাক্যগুলোর মাধ্যমে। তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ ফয়েজ পড়লে সবার মধ্যেই এই উপলব্ধি আসে। তাকে পড়লে আমরা ভাবতে বাধ্য হই; পূর্বাপর খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে চাই, আমরা নিজেদের আত্মা বিকিয়ে দেব নাকি নিজেদের আত্মার কাছে সৎ থাকব।
অনেক বছর ফয়েজ শোনা বা আবৃত্তি করার পর তার কবিতার প্রেমীদের কাছে একটি জিনিস দারুণভাবে স্পষ্ট হয়ে যায়—নির্যাতিতদের যন্ত্রণা ও সংগ্রামের কথা অবলীলায় তুলে ধরেছেন তিনি। ফয়েজের প্রেমের কবিতা যে আমাদের কম নাড়া দেয়, তা নয়—তবে সবচেয়ে বেশি অনুরণন সৃষ্টি করে তার প্রতিরোধের কবিতাগুলোই।
'আমরা দেখব'
প্রতিটি আবেগকে সবচেয়ে অল্প কথায় ও রূপকভাবে উপস্থাপন করতে পারে কবিতা। তাই কবিতা ব্যবহার হয় প্রতিবাদ মিছিল, মিটিং ও সমাবেশে। ২০১৯-২০ সালের শীতে ভারতে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে আমরা ফয়েজের কবিতা 'হাম দেখেঙ্গে'র (আমরা দেখব) ব্যবহার দেখেছি। এই কবিতা লেখা হয়েছিল ১৯৭৯ সালে, পাকিস্তানের জেনারেল জিয়া-উল-হকের সামরিক স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে। জিয়া জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ফয়েজ নিজেই বৈরুতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে যান। কিন্তু নির্বাসনে থাকলেও তার কথা ঠিকই দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
লাহোরেও পৌঁছে যায় ফয়েজের কবিতা। তার কবিতা নিষিদ্ধ করেন জিয়া। এমনকি ইসলাম-সম্মত মনে করতেন না বলে সরকারি কর্মচারীদের শাড়ি পরাও নিষিদ্ধ করেন জিয়া। এই দুই নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় কিংবদন্তি পাকিস্তানি শিল্পী ইকবাল বানু কালো শাড়ি পরে ১৯৮৬ সালে লাহোরের একটি স্টেডিয়ামে 'হাম দেখঙ্গে' গেয়েছিলেন।
দেশকে ইসলামিকরণের প্রতিবাদে, ক্ষমতাধরদের উপহাস করতে এবং ক্ষমতাহীনদের শক্তি ও কণ্ঠ দিতে কবিতাটিকে ধর্মীয় রূপকে মোড়ানো হয়। অসাধারণ এই কবিতা বেরিয়েছে এক কমিউনিস্ট ও নাস্তিক কবির কলম থেকে, যিনি ন্যায়, ঐশ্বরিক ও মানবিক বিষয়ে কথা বলার জন্য ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রতীকবাদকে বেছে নিয়েছিলেন। কাজটি তিনি করেন মৌলবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে এবং ইসলামের সারমর্ম বোঝাতে। লাহোরে ইকবাল বানুর প্রতিবাদে শামিল হয় হাজার হাজার দর্শক।
বিবেক জাগ্রত থাকলেই মানুষ ক্ষমতাযন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ করে। কিন্তু এর ফলে তাকে হতে হয় বঞ্চনার শিকার, পেতে হয় শারীরিক শাস্তি। ফয়েজের অভিজ্ঞতাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন তিনি। কলম-কাগজ থেকে বঞ্চিত করা হয় তাকে, কিন্তু কণ্ঠস্বরকে কে আটকে রাখতে পারে? তিনি কবিতা সৃষ্টি করতেন, আর তা সংরক্ষিত করতেন স্মৃতির কুঠুরিতে। তারপর সেগুলো বাইরে পাচার করে দিতেন জেলখানার প্রহরী ও সেন্ট্রিদের মাধ্যমে। মানুষের আবেগের কথা বলার জন্য সংগ্রামরত জনগণের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ফয়েজ।
'নিগড়িত পায়ে রাস্তায় হাঁটো'
একবার কারাবাসের সময় ফয়েজকে শেকল দিয়ে বেঁধে টাঙায় করে দাঁতের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। রাস্তায় তাকে দেখে লোকে চিনে ফেলে। ওই যাত্রাতেই তিনি দেশের প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করে সবচেয়ে আইকনিক কবিতাগুলোর একটি লেখেন:
চশমে নাম জান-এ শোরিদা কাফি নাহি/
তোহমত-ই ইশক-এ পশিদা কাফি নাহি/
আজ বাজার মে পা-বাজৌলান চালো।
(অশ্রু ঝরানো বা ব্যথিত হওয়াই যথেষ্ট নয়/
গোপন প্রেম লালন করাই যথেষ্ট নয়/
পা নিগড়িত করে রাস্তায় হাঁটো।)
তার কথাগুলো নীরব দর্শকদের তিরের মতো বিদ্ধ করেছে। মানুষের উদাসীনতাকে বিদ্ধ করেছে। তার কবিতা মানুষের মনে দেশপ্রেম জাগিয়েছে, তাদের মুখ খুলিয়েছে।
কবিরা স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার জন্য বিপজ্জনক হতে পারেন। কারণ তারা জনসাধারণের কল্পনাকে ধারণ করতে সক্ষম। শক্তির বদলে প্রেম দিয়ে মানুষের মন শাসন করতে পারেন কবিরা।
এ কারণেই ফয়েজ আজও সমান গুরুত্বপূর্ণ, সমান প্রাসঙ্গিক। প্রশ্ন করা শিখতে , অন্ধভাবে সবকিছু মেনে না নেওয়া শিখতে তরুণদের উচিত ফয়েজকে পড়া।
- রানা সাফভি দিল্লিভিত্তিক লেখক
- (ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ)