ছোটবেলার ঈদ বলতে যা ছিল
যত বুড়ো হচ্ছি ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ততো মনের ভেতর চাড়া দিয়ে উঠছে। এই তো আর কয়েকটা দিন পর ঈদ। আর এজন্যই হয়তো ঈদ যত এগিয়ে আসছে, ছোটবেলার স্মৃতিগুলো একটু একটু করে মনে পড়ছে।
একেবারে ছোটবেলায় রোজা রাখতাম না
অন্য বাচ্চাদের মতো আমিও খুব রোজা রাখতে চাইতাম। কিন্তু বাসায় আমার রোজা রাখার অনুমতি ছিল না। যেহেতু রোজা রাখতাম না, তাই না খাওয়ার কষ্ট কী, তা-ও বুঝতাম না। পরে বড় হয়ে রোজা রেখেছি ঠিকই। কিন্তু সে-ই রোজা যে কোনো ধর্মীয় অনুভূতি বা আধ্যাত্মিক অনুভূতি থেকে রাখা হতো, তা কিন্তু না। এটা ছিল আমার কাছে একধরনের মজার খেলার মতো। খাওয়ার যন্ত্রণা নেই, সারাদিন না খেয়ে থাকবো, এরপর সন্ধ্যায় সবার সঙ্গে বসে ইফতারি করবো, রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে সেহরি খাবো। এ-সব ছিল আমার জন্য ভীষণ আনন্দের বিষয়। এদিকে, রোজা রাখেছি বলে, খুব গর্বও হতো। সবাইকে বলে বেড়াতাম, 'আজ কিন্তু আমি রোজা!'
ইফতারি হতো বাড়িতেই
এখন যেমন বাইরে থেকে আনার একটা রেওয়াজ, তখন বাড়িতেই ইফতারি বানানো হতো। আমার মা খুব স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন, যে কারণে বাসায় পিঁয়াজু বেগুনির মতো ভাজাপোড়াও খুব অল্প পরিমাণে বানানো হতো। বাসায় যারা রোজা রাখতেন, তাদের জন্য রুটি-মাংস, পরোটার মতো আলাদা ভারী খাবারের ব্যবস্থা থাকতো। তবে ইফতারিতে ভাত খেতে দেখিনি কখনো।
ইফতারে ছোলা হতো দু'রকম। কাঁচা ছোলা ও ভাজা ছোলা। ভাজা ছোলা তো ছিলই। কাঁচা ছোলা খাওয়া হতো আদা দিয়ে। আদা কুচি কুচি করে কেটে কাঁচা ছোলার সঙ্গে খাওয়া হতো। এছাড়া শসা, মুরি তো ছিলই। অন্যান্য সময় শসা এত খাওয়া হতো না, কিন্তু রোজায় শসা নিয়মিত খাওয়া হতো। মুরি মাখিয়ে খাওয়ার একটা চল ছিল। এটা এখনও আছে।
আজকাল যে অনেকরকম বাহারি খাবারের চর্চা দেখি, এতোটা আমাদের সময় ছিল না। অন্তত আমাদের বাড়িতে ছিল না। একবার, একটা ভ্যানগাড়িতে হরেকরকম ইফতার নিয়ে যেতে দেখেছিলাম। কিন্তু মানুষকে কিনতে দেখা যেত না। ঘরমুখো খাবারের একটা অভ্যাস ছিল তখন মানুষের।
এখন তো ইফতারি মানেই হালিম। ওই সময় হালিম খাওয়া হতো না এত। এর কারণ হতে পারে, হালিম হলো পুরান ঢাকার খাবার। আমরা তো পুরান ঢাকার লোক না, আমরা হলাম অন্য জায়গা থেকে আসা ঢাকার নতুন বাসিন্দা। ঢাকার নতুন বাসিন্দাদের সংস্কৃতি ছিল,পুরান ঢাকার মানুষদের চেয়ে আলাদা। ইফতারির জন্য পুরান ঢাকার চকবাজার সবসময়েই বিখ্যাত ছিল। পুরান ঢাকার মানুষ হাজাররকম ইফতারি খেত। কিন্তু আমরা সে-সব খেতাম না। আমাদের বাড়িসহ, পাশের বাড়িগুলোতেও ঘরে বানানো খাবারের প্রতিই আগ্রহ ছিল বেশি।
ভিক্ষুকদের ইফতারি দেওয়া হতো
মিষ্টি খাবার চল এত ছিল না। মাঝে মাঝে কেউ হয়ত কিনে আনতো। একধরনের ডালের তৈরি মিষ্টি ছিল। ছানার ভিতরে ফুটো ফুটো । রোজার সময় এই মিষ্টিটা আনা হতো খুব।
ভিক্ষুকদের জন্য প্যাকেটে করে পিঁয়াজু, বেগুনি কিনে রাখা হতো। ভিক্ষুকরা এলে তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হতো প্যাকেট। আজকাল অনেকে তেহারি, বিরিয়ানি দেয়। তখন এ-সবই দিত। কিন্তু ভিক্ষুকরা খেতে আসতো এবং তাদের ইফতারি দেওয়ার একটা চর্চা ছিল। এখন তো সব অ্যাপার্টমেন্ট। ভিক্ষুকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই ইফতার খাওয়া এখন আর দেখা যায় না।
চাঁদ দেখতাম সবাই মিলে
ঈদের চাঁদ দেখার বিষয়টি খুব আনন্দের ছিল। যদিও তখন আমি জানতাম না, এই চাঁদ দেখার কারণ কী। কিন্তু সবাই মিলে একসঙ্গে চাঁদ দেখতে যাওয়ার মধ্যে ছিল আনন্দ। তখন চাঁদ দেখার সাথে সাথে আযান দিতো। সাইরেনও বাজতো কখনো কখনো।
আর ঈদের আযান দেয়া মানেই, বাড়ির মায়েরা এখন সবাই যার যার কাজে নেমে পড়বে। সবার ওপর কাজ ভাগ করে দেওয়া হতো। কেউ সেমাই বানাবে, কেউ জর্দা বানাবে, কেউ পায়েস বানাবে।
আমাদের বাসায় এমনিতে সেমাই খাওয়ার প্রচলন ছিল না। পরে অনেক খেয়েছি, কিন্তু ছোটবেলায় ঈদের দিনই সেমাই বানানো হতো শুধু। চাঁদরাতে ঈসা ব্রাদার্স থেকে সেমাই, গোলাপজল, মশলা, বিভিন্ন জিনিস কিনে আনা হতো।
দু'রকম সেমাই বানানো হতো। দুধের সেমাই আর লাচ্ছা সেমাই। আরেকটা ছিল দমের সেমাই। দমের সেমাই খেতে দেখিনা আজকাল তেমন। এটা কিছুটা শুকনো ঝরঝরে হতো। কিছুটা জর্দার মতো। তখন দমের সেমাই এবং দুধের সেমাই সবাই বেশি পছন্দ করতো। লাচ্ছা সেমাই জনপ্রিয় ছিল পুরান ঢাকায়।
ঈদের জামাগুলো বাসায় বানানো হতো
খাবারের মতোই, ঈদের জামা তখন দোকানে গিয়ে কিনতো না মানুষ। ৬০ এর দশকের এসে এই কেনাকাটা শুরু হয়। তার আগে মানুষ কাপড় কিনে এনে ঘরে সেলাই মেশিনেই বানাতো। দর্জিরা বাড়িতে আসতো। সবার মাপ নিয়ে যেত। বিশেষ করে, ছোট বাচ্চাদের এবং বয়স্কদের কাপড় বানানো হতো। ছেলেরা বড়-ছোট সবাই সাদা পায়জামা পরতাম।
নামাজ থেকে এসে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম
আমাদের বাড়ির পাশেই একটা হিন্দু মেস ছিল। রোজা, ঈদ, সবরকম ধর্মীয়-সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের মা তাদের খাবার পাঠাত। এটা শুধু আমার মা-ই করতেন না, অন্য বাড়ির মায়েরাও খাবার পাঠাতেন বিভিন্ন উৎসবে। হিন্দু মুসলমান কোনো ভেদাভেদ ছিল না।
কিন্তু আমি যে-বার প্রথম মসজিদে যাই সেদিন এক কান্ড ঘটলো। তখন আমার চার বছর বয়স। মসজিদে নামাজ শেষে ইমাম খুৎবা দেওয়ার সময় বললেন, 'মুসলমান ছাড়া আর কেউ জান্নাতে যেতে পারবেনা।'
এই কথা শুনে আমার সঙ্গে সঙ্গে ওই হিন্দু মেসের মামাদের কথা মনে পড়ে গেলো। বাড়ি ফিরে মা'কে জড়িয়ে ধরে বললাম, 'তাহলে কি ওরা কেউ জান্নাতে যাবে না? শুধু আমরাই যাবো? ওদের কী হবে মা?' এই বলে কান্না জুড়ে দিলাম।
আমার মা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। নিয়মিত নামাজ কোরআন শরীফ পড়তেন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, 'যারা ভালো মানুষ তারা সবাই জান্নাতে যাবে, আর যারা খারাপ তারা যেতে পারবে না। আল্লাহ শুধু দেখবেন, কে ভালো, কে খারাপ।'
সে-বার আমি খুব কান্না করেছিলাম বটে, কিন্তু পরবর্তীতে আমার মায়ের এই কথা আমি সারাজীবন মেনে এসেছি।
- আফসান চৌধুরী: সাংবাদিক ও গবেষক