ইউক্রেন সংঘাতে ন্যাটো-রাশিয়ার সমীকরণ কী?
ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এ সংকটকে কেন্দ্র করে ন্যাটোর অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। শুরু থেকেই ন্যাটো রাশিয়ার বিরুদ্ধে আগ্রাসনের অভিযোগ এনেছে, আর অন্যদিকে রাশিয়ার দাবি, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রকে ন্যাটো নিজের সদস্য বানিয়ে রাশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাব সম্বলিত এলাকা দখল করার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার মতে, ইউক্রেন ন্যাটোকে তার বাড়ির দোরগোড়ায় নিয়ে আসবে; ফলে ইউক্রেনে রুশ অভিযান ন্যাটোর সেই পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ারই একটি পদক্ষেপ মাত্র।
তবে ন্যাটো–রাশিয়ার এই জটিল সম্পর্ক নতুন কোনো বিষয় নয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে এই দ্বন্দ্বের শুরু, যা এখন পর্যন্ত চলছে অবিরাম।
নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন (ন্যাটো) বা উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থা পশ্চিমা দেশগুলোর একটি সামরিক জোট। ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিম ইউরোপের ১২ টি দেশ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যৌথ নিরাপত্তা প্রদানের অঙ্গিকারবদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছিল সংস্থাটি।
সেসময়ে চলমান গ্রীসের গৃহযুদ্ধ, তুরস্কে উত্তেজনার মত বিভিন্ন ঘটনা ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোকে তাদের ভৌগলিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। আর এই সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় বিষয়গুলোর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল, পরাধীনতার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অন্য যেকোনো দেশকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা প্রদান করবে। এ সময় চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত প্রভাবিত এক অভ্যুত্থানের ফলে জার্মান সীমান্তে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় আসে। একই সময়ে ইতালিতেও জনগণের মাঝে কমিউনিজম জনপ্রিয় হয়ে উঠে। মূলত ইউরোপে সোভিয়েত প্রভাব ঠেকাতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটো প্রতিষ্ঠান উদ্যোগ নেয়।
অন্যদিকে, মার্কিনীদের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ওয়ারশ চুক্তি বা ওয়ারশ প্যাক্ট নামে একটি রাজনৈতিক-সামরিক জোট গঠন করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৫৫ সালে সোভিয়েত তার পূর্ব ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোর সমন্বয়ে এ জোট গঠন করে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মূলত ন্যাটোর বিরুদ্ধে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতেই এ জোট গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ১৯৯১ সালে সংস্থাটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে, স্নায়ুযুদ্ধে জয়ের পর বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক আধিপত্য বাড়তে থাকে; একইসঙ্গে বাড়তে থাকে ন্যাটোর ক্ষমতা ও আঞ্চলিক আধিপত্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর পূর্ব ইউরোপীয় অনেক মিত্রই যোগ দেয় ন্যাটোতে। আর এভাবেই ন্যাটো তার প্রধান সদস্য দেশগুলো বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ উদ্ধারের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়। যার প্রমাণ ইরাক, আফগানিস্থান ও সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া বিভিন্ন অভিযান।
ন্যাটোও স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকে সক্রিয়ভাবে রাশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। আর এই পুরো বিষয়টিকে নিজের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে দেখে রাশিয়া।
ন্যাটো এবং রুশ সীমান্তবর্তী দেশ ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের শুরু ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে। ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার করেছে ন্যাটো। তবে ন্যাটোর সদস্য নয় ইউক্রেন। এরপরেও কেনো ইউক্রেনের প্রতি ন্যাটোর এই সহযোগিতামূলক আচরণ?
ন্যাটো ইউক্রেনকে নিজের অংশীদার দেশ মনে করে। এর অর্থ হল, দেশটি ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতায় লিপ্ত, কিন্তু জোটের প্রতিষ্ঠা চুক্তিতে উল্লিখিত নিরাপত্তা বলয় দ্বারা সুরক্ষিত নয়। ২০০৮ সালে ন্যাটো ইউক্রেনকে সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেয়। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নেওয়ার পর ইউক্রেন যোগদানের ব্যাপারে আগ্রহীও হয়েছিল, কিন্তু রাশিয়ার বিরোধিতার জন্য তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এ কারণেই ন্যাটো ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় কাজ করতে বাধ্য নয়। আবার একইসঙ্গে, সরাসরি সামরিক সাহায্য প্রদান করা ন্যাটো সনদের নিয়ম বহির্ভূত পদক্ষেপ হবে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ন্যাটো ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের মতে, ন্যাটো সনদের ধারাগুলো রক্ষণাত্মক, সংঘাতকে উস্কে দেওয়ার জন্য নয়। বরং সংঘাত প্রতিরোধ করাই ন্যাটোর মূল উদ্দেশ্য। এই যুদ্ধ যাতে ইউক্রেনের বাইরে বাড়তে না পারে এবং তা আরও বিধ্বংসী ও বিপজ্জনক হতে না পারে, তা নিশ্চিত করা এই জোটের দায়িত্ব। নো-ফ্লাই জোন কার্যকর করা হলে ন্যাটো বাহিনী রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়বে, যা সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে দেবে। এতে জড়িত সমস্ত দেশের জন্য নেমে আসবে আরও মানবিক দুর্ভোগ ও ধ্বংস।
কিন্তু তারা মূলত এখানেও মার্কিন স্বার্থকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কারণ এই পরিস্থিতির সমাধান কখনই সরাসরি সামরিক অংশগ্রহণ বা সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে আসবে না। এগুলো কেবল সংকটকে প্রকট এবং দীর্ঘমেয়াদী করবে। উপযুক্ত কূটনৈতিক আলোচনা এবং সমঝোতার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি সবচেয়ে কার্যকার উপায়ে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু ন্যাটো ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে চাচ্ছেনা, সেটি তাদের গত প্রায় তিনমাসের বক্তব্য ও বিভিন্ন পদক্ষেপ দেখেই বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রে রিপাবলিকানরা একদিকে যুদ্ধ যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দিতে বলছে, আর অন্যদিকে ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটরা সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে একে দীর্ঘমেয়াদী করার পরিকল্পনা করছে। তাদের দুই দলের বিতর্ক থেকে এটি পরিষ্কার যে, শান্তিপূর্ণ সমাধানে যেতে তারা কেউই আগ্রহী না। শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে একটি ভয়ঙ্কর প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে তারা।
আবার ন্যাটো অনেকদিন ধরেই রাশিয়ার অন্যতম প্রতিবেশী দেশ ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনকে নিজের সদস্য বানাতে উত্সাহিত করছে। বলা যায়, বিশ্বে আধিপত্য বিস্তার করার জন্য বহু বছর ধরে অবিরাম চেষ্টার মাধ্যমে তারা এই সংকটপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
ফিনল্যান্ড এবং সুইডেন অনেক বছর ধরেই অন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নিরপেক্ষ। কিন্তু এখন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে দেশ দুটি ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। এ ব্যাপারে দেশের ভেতরেও ব্যাপাক জনসমর্থন রয়েছে। এদিকে রাশিয়া ইতোমধ্যে হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ফল ভালো হবে না। রাশিয়া বিভিন্ন অযুহাতে ফিনল্যান্ডে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এর জবাবে ফিনল্যান্ড বলেছে, সুইডেন থেকে আরও বিদ্যুৎ আমদানি করে এবং দেশে উৎপাদন বাড়িয়ে তারা এই ক্ষতিপূরণ করবে। মূলত ন্যাটোতে যোগদানের পরে যা হতে পারে, তার প্রস্তুতিই শুরু করেছে ফিনল্যান্ড। আর এতে করে উত্তেজনা কমার বদলে আরও বাড়ছে।
ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের ন্যাটো সদস্যপদ পেতে সব মিলিয়ে সময় লাগতে পারে প্রায় এক বছর। তবে যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে, সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডকে রাশিয়া আগে থেকে আক্রমণ করলে তারা সামরিক সহায়তা দেবে। একই ধরনের প্রতিশ্রুতি তারা ইউক্রেনকেও দিয়েছিল যেটি খুব একটা কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে না। ধারণা করা হয়, ইউক্রেন, ফিনল্যান্ড ও সুইডেনে রাশিয়া বিরোধী জনমত গঠন এবং ন্যাটোতে যোগদানের জনসমর্থন তৈরিতেও মার্কিন ইন্ধন রয়েছে।
গেল মাসে রুবলে লেনদেন করতে অস্বীকৃতি জানানোয় বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে রাশিয়া। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমাতে 'অবান্ধব' দেশগুলোকে রাশিয়া ডলারের বদলে রুবলে লেনদেনের নির্দেশ দিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে।
অন্যদিকে, যেসব দেশ এতদিন সচেতনভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে ছিল তারাও এখন সোচ্চার হচ্ছে। চীনের পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে বলছেন, রাশিয়াকে আরও কোণঠাসা করা হলে তা কেবল চলমান ইউক্রেন সংকটকেই জটিল করে তুলবে না বরং ইউরোপে টেকসই নিরাপত্তার ভিত্তিকেও নষ্ট করবে। এমনকি ন্যাটোর ক্রমাগত সম্প্রসারণ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলকেও বিপন্ন করে তুলবে। ১৯৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অঙ্গীকার করেছিল, ন্যাটোকে পূর্বাঞ্চলে সম্প্রসারণ করা হবে না। কিন্তু তারা সে কথা রাখেনি। মার্কিনীরা এখন কোথায় গিয়ে থামবে সেটিও উদ্বেগের বিষয়। পুরো বিশ্বে ইতোমধ্যেই জ্বালানি ও খাদ্যশস্যের মত নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিক্ষিপ্ত এই বিষয়গুলো একটি সামগ্রিক অস্থিরতার পূর্বাভাস দিচ্ছে।
দুটি বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষজ্ঞদের ধারণা হয়েছিল, মানবজাতি নিজেদের পুরনো ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নেবে। ভবিষ্যতে এর পুনরাবৃত্তি না করে শান্তিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবে, কারণ সেসময় কোনো পক্ষই জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে পারেনি। আবার স্নায়ুযুদ্ধ দীর্ঘদিন পুরো বিশ্বকে ভয়ানকভাবে ভুগিয়েছে, বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে। মানবজাতি আবারও সেই অনিশ্চয়তার দিকে ফিরে যাবে না বলেও ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর অতীত স্মৃতি এবং শিক্ষা দুটোই বিস্মৃত হয়েছে। শোষক গোষ্ঠীর হাতে অতিরিক্ত ক্ষমতা চলে আসলে যে তারা নিজেদের বিশৃঙ্খলা আসক্ত মনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না, চলমান সংকট হয়তো তারই প্রমাণ।
- লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।