বিদায় টিকাটুলি এবং কিছু বিচ্ছিন্ন স্মৃতি
একদিন সন্ধ্যাবেলার কথা। বাড়ির বড়রা (মা,বাবা, নানা ও মামারা) সবাই খাবার টেবিলের চারদিকে বসে আছে। কী হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। তবে সবাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, খুব গম্ভীর আলোচনা চলছে। তাই আরও বেশি ঘুরঘুর করছিলাম টেবিলের পাশে। এরইমধ্যে মা কে দেখলাম, আলমারি থেকে তার গহনাগুলা এনে টেবিলে রাখলেন। নানা ভাই সেই গয়নাগুলো গুছিয়ে একটা প্যাকেটে ভরলেন। আরও কী-সব কথা হচ্ছিল, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তাই চলে এলাম বসার ঘরে। তখন আমার বড় ভাই এসে জানালেন, এই বাড়ির মালিক আমাদের চলে যেতে বলেছে। আমাদের নিজেদের একটা বাড়ি হবে, দিলু রোড নামক এক জায়গায়।
টিকাটুলির বাসা ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল তা বলবো না। তবে আমার এই ৭০ বছরের দীর্ঘ জীবনে টিকাটুলির স্মৃতিই মধুর। যা-হোক আমাদের ঠিকানা বদলালো। টিকাটুলির বাসিন্দা থেকে হয়ে গেলাম দিলু রোডের বাসিন্দা।
যাদের নিজের বাড়ি ছিল তারা বাদে, আমাদের মতো যারা ভাড়া থাকতো তারাও একসময় অন্যত্র চলে যেতে লাগলো। আমাদের প্রতিবেশী বেগম সুফিয়া কামাল ও তার পরিবার চলে যান ধানমন্ডি, আমরা যাই দিলু রোডে।
তবে, পরিবারের সবাই সমেত (নানা, মামারা) চলে আসি বলে 'শূন্য' লাগেনি তেমন।আমার বড় হওয়া আসলে এই নানা-মামাদের সঙ্গেই। অনেকটা যৌথ পরিবারের মতো। একসাথে আমরা বুড়ো হয়েছি, বুড়ো হতে দেখেছি, মৃত্যু কষ্ট ভাগাভাগি করেছি, আনন্দ-উৎসবে মেতেছি।
টিকাটুলিতে একটা পাড়া সংস্কৃতি ছিল
'জন্মপাড়া' বলে হয়তো আমার আগ্রহের জায়গা জুড়ে টিকাটুলিই আছে। তবে আমি মনে করি, ঢাকার বিভিন্ন এলাকার 'পাড়া সংস্কৃতি বা ইতিহাস' থাকা উচিত। কারণ এসব পাড়া সংস্কৃতি মানুষের রুচি ও মনন তৈরিতে অনেক বড় অবদান রাখে। এই পাড়াভেদে সংস্কৃতিগুলো জানতে পারলে সমাজের অনেক ইতিহাসও ফুটে উঠে।
টিকাটুলির একটি বড় অংশ ছিল কলকাতা থেকে চলে আসা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। তারা ভেবেছিলো লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী আলাদা স্বাধীন দেশ হবে। কিন্তু হলো কেন্দ্রীয় একক পাকিস্তান, যার কোনো ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা নেই। দিল্লির বদলে করাচি কেউ মেনে নিতে পারলোনা। আর সে-থেকেই শুরু হলো আন্দোলন।
আমার নজু মামা তখন বয়সে তরুণ, ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ক্যামেরা হাতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় ঘুরে বেরিয়েছেন বিভিন্ন জায়াগায়। অনেকদিন পর্যন্ত সেই ছবিগুলো সংরক্ষিত ছিল। তবে, তিনি কোনো দল করতেন না। তখন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজের জীবনে, রাজনীতি ছিল সক্রিয় চর্চার বিষয়। তবে তারা কোনো দল করতেন না।
আমাদের একটি মুক্তিযোদ্ধা পাড়াই ছিল। এদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। তাদের এই ভাবনার শুরু সেই টিকাটুলিতেই , যা প্রস্ফুটিত হয় ১৯৭১ সালে এসে।
বইয়ের ক্ষুধা মিটতো না…
ততদিনে আমি স্কুলজীবন শুরু হয়ে গেছে। অন্যদের মতো এত টানতো না আমাকে স্কুল। আমি যখন বেবি ক্লাসে ভর্তি হই, তখন কিন্তু আমি বই পড়া শুরু করে দিয়েছি! এর জন্য দায়ী বোধহয় আমার বাবা-মা। তারা আমাকে প্রচুর কমিক কিনে দিতেন। আমি সেগুলো শুধু গোগ্রাসে গিলতাম। আমার বইয়ের ক্ষুধা এত বেশি ছিল যে, বাবা-মা কিনে দিয়ে হাঁফ ছাড়তে পারতেন না। নতুন বই কিনে আনার সঙ্গে সঙ্গে তা পড়ে শেষ করে ফেলতাম। তারপর, অপেক্ষা করতাম কখন আবার নতুন বই নিয়ে আসবে আমার জন্য। বাবা-মাও আমার বইয়ের ক্ষুধা মেটাতে মেটাতে ক্লান্ত হয়ে যেতেন।
কোনো বন্ধু ছিল না
বন্ধু বলতে কী বোঝায় বুঝতাম না। তবে, ছোটো বলে, সবাই-ই ছিল আমার বন্ধুর মতো। তাই খুব সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যেতে পারতাম। বড়রা আমাকে খুব আদর করতো, কোলে নিয়ে নিয়ে ঘুরতো। আমি তো নায়ক বুলবুল আহমেদের কাঁধেও চড়েছি!
একবার আমি তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম
আমার মায়ের দাদী আমাদের সঙ্গেই থাকতেন বাড়িতে। আমরা তাকে বড়মা বলে ডাকতাম। আমরা তিন ভাই আর বড় মা এক খাটে ঘুমোতাম। বাবা-মা আমার ছোটভাইকে নিয়ে ঘুমাতেন অন্য ঘরে।
আমাদের তিনভাইয়ের অনেক অত্যাচার সহ্য করেছেন তিনি। একবার আমি তার মুখের ওপর কোরান শরীফের রেহাল ফেলে দিয়ে তার নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম। সে কী রক্ত!
কী দেখেছিলাম আমি!
আরেকটি ঘটনা বলে টিকাটুলির পর্ব থেকে বিদায় নিচ্ছি। ছোটোবেলায় খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার কোনো অভ্যাস আমার ছিল না। কিন্তু একদিন হঠাৎ খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আমার। ঘুম থেকে উঠে কানে যেন শুনতে পেলাম, কেউ জোরে জোরে কোরান শরীফের মতো কিছু পড়ছে। বাড়ির সবাই ঘুম। ঐ বিছানাটা ছিল বেশ উঁচু। বিছানা থেকে নামতে আমার খুব কষ্ট হয়ে যেত। আমি বিছানা থেকে আস্তে আস্তে করে নামলাম।
টের পেলাম, আওয়াজটা আসছে সিঁড়ির ঘর থেকে। মানে ছাদের পাশের ঘর। আমি তো দিব্যি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলাম I দেখি শেরওয়ানি পরা এক লোক, মুখে দাঁড়ি, রেহালের উপর কোরান রেখে কোরান শরীফ পড়ছে। আমাকে দেখে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সে একটা মুচকি হাসি দিলো। তারপর আবার পড়ায় মনোযোগ দিলো। আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে এলাম। সে-বার কাউকে কিছু বলিনি এ নিয়ে। আসলে বলার মতো কিছু মনেও হয়নি। এরপর একদিন মা কে বললাম, 'মা ঐ লোকটাকে আর দেখিনা কেন?'
সবটা শুনে আমার মা আর বড়মার তো কপালে হাত। তাদের ছেলেকে কি জীন-ভূত ধরলো? না কি হলো! বাড়িতে নেমে এলো কান্নাকাটির ঢল। কীভাবে আমাকে সুস্থ করা যায়, তা নিয়ে পুরো বাড়িতে পড়ে গেল হৈহৈ রইরই অবস্থা। হুজুরের কাছে নিয়ে যাওয়া, তাবিজ পরানো কোনোকিছুই বাদ রাখেনি মা আর বড়মা।
আমি আজও জানিনা সে-বার আমি আসলে কী দেখেছিলাম। ওটা কী আমার কল্পনা নাকি সত্যি ঘটনা তা এখনো বের করতে পারিনি। সেই ছোটো বয়স থেকে এটা আমার মনে আজও এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে আছে।
- লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক