তেল-গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পকারখানার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে
দ্রব্যমূল্য এখন প্রতিদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম। মূল্যবৃদ্ধির এই প্রবণতায় এগিয়ে কৃষিপণ্য। গণমাধ্যমের শিরোনাম, 'ভরা মৌসুমেও চালের দাম বৃদ্ধি'। প্রায় প্রতিদিনই এই খবর দেশের বাতাসে ছড়াচ্ছে। উদ্বিগ্নতা বাড়ছে নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে। খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই ঘটছে। ভারতের মতো কৃষি পণ্য রপ্তানিকারক দেশ, সেখানেও কৃষিপণ্যের অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্য বৃদ্ধি ঘটছে। পৃথিবীতে এমনই একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির উপর বিভিন্ন দেশের সরকার কতটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের বিষয়।
আমাদের দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এক অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নানা রকমের ঘোষণা আসছে। তার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত তৈরী হচ্ছে। এক কঠিন সময় অতিবাহিত করছে দেশ। গণমাধ্যমে গতকাল সংবাদ পরিবেশিত হল, "কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় মূল্য নির্ধারণ করে দিবে"। অর্থনীতির বিকাশের যে প্রধান সূত্র, মুক্তবাজার অর্থনীতি এবং খোলা বাজারনীতির বিপক্ষের সিদ্ধান্ত এটি। কখনো কখনো জনগণের অবস্থা বিবেচনায় রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণ করতে হয় বটে, কিন্তু এক্ষেত্রে, ডলারের মূল্য নির্ধারণে কী সুবিধা আসবে- সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।
বেশ কিছুদিন যাবৎ রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধি করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা সরকার। নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে প্রবাসী-আয়ের উপর। তাতে রেমিটেন্স প্রবাহ কতটা বৃদ্ধি পেয়েছে তা জানা সহজ নয়। এটি একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। আমাদের মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা চলছে। এই সময় বৈদেশিক মুদ্রার 'মূল্য নির্ধারণ' করে দেওয়া হলে তার প্রভাব প্রবাসী-আয় এর উপরে ব্যাপকহারে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। রেমিটেন্স প্রবাহের সবচেয়ে বড় সময় হচ্ছে আমাদের দেশের কোরবানির ঈদ। অতীতে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি পরিমাণ প্রবাসী আয় দেশে প্রবাহিত হয়েছে এই সময়। কোরবানির ঈদ আসন্ন। তার আগে আগে বৈদেশিক মুদ্রার মূল্য সরাসরি নিয়ন্ত্রণের ফলে ধারণা করা যেতে পারে, হুন্ডির মাধ্যমে ব্যাপকহারে অর্থ আসবে, সরকার বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটানোর জন্য আগামী অর্থবছরে যে সমস্ত ছাড় দেওয়া হবে তা অতীতেও ছিল। সরকারের সেই নীতি কতটা কার্যকর হয়েছে, তার কোনো তথ্য কখনোই প্রকাশিত হয়নি। অতীতে কালো টাকা সাদা করার জন্য নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তাতেও রাষ্ট্রের কতটুক সুবিধা হয়েছে তা কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এই সংকট আমাদের চূড়ান্তভাবে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা এখনই পরিষ্কারভাবে বলা যাচ্ছে না। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নতুন পে-স্কেলের দাবি উঠছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে সরকারি কর্মচারীদের পে-স্কেলের দাবি যৌক্তিক। তবে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বেসরকারি খাতের উপর চাপ সৃষ্টি করবে তাও গভীরভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। জনসংখ্যার শতাংশ হারে প্রায় ৯৫% কর্মসংস্থান বেসরকারি খাত করে থাকে। সুতরাং পে-স্কেল কিংবা নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করার আগে বিষয়টি গভীরভাবে ভাবা উচিত। বেসরকারি খাতের নিম্নআয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধির দাবি তুলে ধরছে। মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে বেতন বৃদ্ধির মাধ্যমে সংকট সমাধান হবে না। বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটি খুব বড় বিষয়।
আমাদের জিডিপি-কর অনুপাতে আমরা অনেক পিছিয়ে। আমাদের জিডিপির পরিমাণ যদি সঠিক থেকে থাকে তাহলে আমরা ব্যাপকহারে অপ্রদর্শিত আয় অর্থাৎ কর অপরিশোধিত আয়ের জন্ম দিচ্ছি। এমন সময় শুধুমাত্র নগদ অর্থের মাধ্যমে কালো টাকা বৈধ করার ক্ষেত্রে কোন ছাড় দেওয়া হলে অর্থাৎ বাজারে যা আলোচিত হচ্ছে, বিদেশ থেকে ডলার নিয়ে আসলে তার কোনো তথ্য জিজ্ঞেস করা হবে না কিংবা আরো অন্যান্য ছাড়। অনেকেই মনে করেন, এর ফলে দেশে কর প্রদান না করার যে ধারা তা আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের জন্মের পরে বহুকাল যাবৎ এই সুযোগ অব্যাহত ছিল। আমাদের বেসরকারি বস্ত্রখাতের বিরাট অংশই এই সুযোগের আওতায় জন্ম। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে একটি যৌক্তিক জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে।
অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্রুত কিংবা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত সুদূরপ্রসারী কোন ফল বয়ে আনবে না। ভারত রাশিয়া থেকে কম মূল্যে তেল আমদানি করছে। আমাদের দেশের পক্ষে তা সম্ভব কিনা গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। রাশিয়া তার অনেক মিত্রদেশকে এই সহায়তা দিচ্ছে। আমরা রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা কেন সেই সুবিধা বঞ্চিত হব। রাশিয়ার কাছ থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে তেল সংগ্রহ করা আমাদের জন্য এই মুহূর্তে খুবই জরুরি। এটা আমাদের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করতে সহায়তা করবে। যদিও এক্ষেত্রে বড় বাধা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অবরোধ। প্রতিবেশী ভারত এই রক্তচক্ষু এড়িয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তেল ক্রয় অব্যাহত রেখেছে।
বাজেট সম্পর্কিত একটি ধারণা প্রচলিত হয়েছে যে, বিগত বছরের তুলনায় চলতি বছরের বাজেট আরও বড় করতে হবে। কিন্তু প্রতিবছরই দেখা যায়, বড় বাজেটের একটি বিশাল অংশ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। আমরা পুরাপুরিভাবে বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারি না। তাহলে কেন প্রতিবার বড় বাজেট তৈরি করে অর্থবছরের শেষের দিকে একটি দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে দিই? অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট কাটাতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি না করা যাতে উৎপাদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মিল-কারখানাগুলো ঠিকমতো উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারে। দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্তারা ইতিমধ্যেই তেল-গ্যাসের ও বিদ্যুতের দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করেছে। সরকারের কাছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবেই গ্রহণ করতে হবে। এই মুহূর্তে কোন ধরনের মূল্যবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে শিল্প-কারখানার উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে যা কর্মসংস্থানের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।