ওয়াটার লু’র যুদ্ধক্ষেত্র দর্শন
সারা বিশ্বের যতগুলো যুদ্ধের ময়দানের নাম মানুষের মুখে প্রত্যহ উচ্চারিত হয় (যেমন—পলাশী, পানিপথ) তার মধ্যে নিঃসন্দেহে ওয়াটার লু সবচেয়ে বিখ্যাত। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন আর ডিউক অফ ওয়েলিংটনের ঐতিহাসিক যুদ্ধ আর নেপোলিয়নের পরাজয়, সেই সঙ্গে তার সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত, সবকিছু মিলিয়েই ওয়াটার লুকে পরিচিত করেছে এক বিশ্ববিদিত নামে।
মুখরিত আলোকজ্জ্বল মহানগরী ব্রাসেলস্ থেকে ওয়াটার লুর ময়দান মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এক গ্রীষ্মে বেলজিয়াম ভ্রমণের একপর্যায়ে আমরা যখন ব্রাসেলসে অবস্থানরত তখনই মনের মধ্যে শৈশব থেকে শুনে আসা সেই রণক্ষেত্রটি চর্মচক্ষে অবলোকনের আশা মনের মাঝে ফেনিয়ে উঠতে থাকল। উল্লেখ্য যে অনেকেই জানা নেয় এই বিখ্যাত স্থানটি বেলজিয়ামে অবস্থিত। অনেকেই আবার লন্ডনের ওয়াটার লু নামের এক মেট্রো ষ্টেশন দেখে বিভ্রান্তও হন। পরদিন সকালেই গাড়ি চেপে রওনা দিলাম লাখো পর্যটকের আকর্ষণ ওয়াটার লুর দিকে।
শহরতলি পার হবার কিছু পরেই চোখে পড়ল দিগন্ত বিস্তৃত গাঢ় সবুজ যব ক্ষেত, একেবারে দৃষ্টিসীমার শেষে নীল আকাশ ছোঁয়ার আগপর্যন্ত একইভাবে বয়ে চলেছে এই থৈ থৈ সবুজের স্নিগ্ধ সমুদ্র। হঠাৎ বয়ে যাওয়া বাতাসে অভাজিত সবুজের বুক চিরে তৈরি হচ্ছে তরঙ্গের মত সর্বদাই পরিবর্তনরত মেঠো পথ। নজরে আসল এই সবুজ শান্তির একেবারে মাঝখানে এক উঁচু পাহাড়ের মত, তার উপর মূর্তিমত কিছু একটা।
চকিতেই মনে পড়ে গেল গাইডবুকে দেখা ওয়াটার লুর ছবি, এই সেই ঐতিহাসিক প্রান্তর! এর মাঝখানে সেই যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ওই কৃত্রিম পাহাড়!
পাহাড়ের পাদদেশে গাড়ি থামাতেই চক্ষু চড়কগাছ, এই একবিংশ শতাব্দীতে সেই ঐতিহাসিক যুগের পোশাক পরে একদল ফরাসি সৈন্য কুচকাওয়াজ করতে করতে যাচ্ছে! আবার নতুন করে যুদ্ধ লাগল নাকি? ঘুরতে এসে এ কী গেরো! আমাদের হতবিহবল অবস্থা কাটাতে সাহায্য করল চারপাশে ভিড় করে থাকা আমাদের মতোই দর্শনার্থীর দল। তাদের কাছেই জানা গেল পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্যই গ্রীষ্মের প্রতিদিন এ সময়ে একদল শিল্পী ফরাসি আর বিপক্ষ দলের সেই আমলের সাজপোশাক পরে টহলে বের হয়! দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো, আর কি!
ওয়াটার লুর ইতিহাস
ওয়াটার লুর মূল যুদ্ধ হয় ১৮১৫ সালের ১৮ জুন। আগের রাতের প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে পুরো যুদ্ধক্ষেত্রই ছিল জলকাদায় মাখামাখি। নেপোলিয়ন প্রায় দ্বিপ্রহর পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলেন, যাতে সেই বিশাল প্রান্তর কিছুটা শুকাতে পারে। এর পরপরই ফরাসিদের সাথে অন্য ইউরোপিয়ান জাতিদের (ইংরেজ, জার্মান, ডাচ ও অন্যরা) ভয়াবহ মুখোমুখি লড়াই শুরু হয়। সম্মিলিত জোটের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিটিশ সেনাপতি ডিউক অফ ওয়েলিংটন আর প্রুশিয়ান সেনাপতি ভন ব্লুচার। বেশ কয়েক ঘণ্টা অতিক্রমের পর অবশেষে রাত ৯টায় ফরাসিদের চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে, নেপোলিয়ন পিছু হটেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, অবশেষে নানা ঘটনার ঘনঘটার পর ১৫ জুলাই আত্মসমর্পণে বাধ্য হন তিনি। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবারই জানা—সেন্ট হেলেনা দ্বীপে নির্বাসিত জীবন কাটানোর ছয় বছরের মাথায় তার রহস্যজনক মৃত্যু হয়।
আজকের ওয়াটার লু ময়দান
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এই সুবিখ্যাত রণক্ষেত্রে দর্শনার্থীদের আগমন শুরু হয়েছিল যুদ্ধের ঠিক পরের দিন থেকেই। ১৮১৫ সালের ১৯ জুন ব্রাসেলসের জনাকয়েক অতি উৎসাহী দর্শক ঘোড়ায় টানা গাড়িতে করে যুদ্ধপরবর্তী হালচাল দেখতে আসেন—এভাবেই শুরু আর এখন তো লাখো ভ্রমণপিপাসুর ভিড় প্রতিমাসে। অবশ্য প্রায় ২০০ বছর আগে ময়দানটি ঠিক যেমন ছিল তেমনটি আর নেই। এর ঠিক মধ্যবিন্দুতে আছে এক সুউচ্চ মাটির ঢিবি, যার চূড়া আলো করে দাঁড়িয়ে আছে ২৮ টন ওজনের এক বিশাল ধাতব সিংহমূর্তি।
এই ৪৩ মিটার উচ্চতার কৃত্রিম পাহাড়কে (যা সিংহ পাহাড় নামে খ্যাত) ঘিরেই বিভিন্ন জাদুঘর, ক্যাফে, বিপণি পণ্যের দোকানের সমাহার। হল্যান্ডের রাজা প্রথম উইলিয়ামের নির্দেশক্রমে এই সুবিশাল স্থাপনার কাজ শুরু হয় ১৮২০ সালে। জনশ্রুতি আছে, তার পুত্র দ্বিতীয় উইলিয়াম (যিনি কমলা যুবরাজ নামেই অধিক পরিচিত) ঠিক এই সিংহবেদির কাছেই ওয়াটার লুর যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন। বিশাল প্রান্তরের নানা জায়গা থেকে প্রায় তিন লাখ ঘনমিটার মাটি সংগ্রহ করে সেই পাহাড়টির পত্তন ঘটে। এর গোড়া থেকে ওপরের দিকে ২২৬টি সিঁড়ি ভাঙার পর আপনি পৌঁছতে পারবেন সিংহমূর্তির কাছে।
কিংবদন্তি আছে, পরাজিত ফরাসি বাহিনীর ফেলে যাওয়া বন্দুক ও অস্ত্র গলিয়েই এই ধাতব মূর্তিটি তৈরি করা হয়, কিন্তু তা সম্ভবত নিছকই গুজব মাত্র। চূড়া থেকে চারপাশের দৃষ্টিসীমায় কেবলই অবারিত সবুজ শস্যখেতই আকাশের নীলিমার সঙ্গী। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় মানব সভ্যতার অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধটি এখানেই হয়েছিল।
হাতে সময় কম বিধায় চরকির মতো ঘুরতে ঘুরতে মূল আকর্ষণগুলো দেখতে থাকলাম আমরা। জাদুঘরে মোমের তৈরি প্রায় জীবন্ত ভাস্কর্যের সাহায্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের বিভিন্ন পর্যায়কে উপস্থাপন করা হয়েছে প্রাঞ্জল ভঙ্গিতে। গুটি কয়েক দোকানে বিক্রি হচ্ছে যুদ্ধের নানা স্মারকের নকল ও নেপোলিয়নের ধাতব মূর্তি। ভ্রমণসঙ্গী অপু একটি আবক্ষ মূর্তি কিনেও ফেলল ঘরের তাকে সাজানোর জন্য। আমরাও বিশ্বের নানা কোণে ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের পাঠালাম এই ঐতিহাসিক জায়গার আলোকচিত্র সম্বলিত পোস্টকার্ড।
অবশেষে আমরা রওনা হলাম ওয়াটার লু থেকে, যদিও প্রান্তরটি এমনই সবুজ শোভায় শোভিত আর মায়াকাড়া যে সব ভুলে সেখানেই বেশিক্ষণ থাকতে মন উচাটন হয়ে ওঠে।
যাত্রা শুরুর অল্পক্ষণ পরেই ফাঁকা এক জায়গায় থামা হলো, দূরে এখনো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মাঝে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত সিংহপাহাড় চোখে পড়ে। যাত্রাপথের সবচেয়ে মূল্যবান পাথেয় হিসেবে কিছু ছবি তুলতে তুলতে মনে হলো, মানব সভ্যতার ইতিহাসকে বলা হয় যুদ্ধের ইতিহাস, অথচ এই যুদ্ধগুলো না থাকলে আমাদের জীবন হতে পারত কত শান্তি আর সুখের !
( আজকের দিনেই সংঘটিত হয়েছিল ওয়াটার লু যুদ্ধ, যে যুদ্ধের ফলাফল ব্যপকভাবে প্রভাবিত করেছিল বর্তমান পৃথিবীর ইতিহাসকে।)