বিদ্যুৎ উৎপাদনে রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানি দ্বিগুণ করেছে সৌদি আরব
মরুভূমির রাজ্য সৌদি আরব বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক। গ্রীষ্মকালের তাপদহ থেকে ঘর ঠাণ্ডা রাখতে সেখানে বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপক হারে বাড়ে। আর তা পূরণে অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির জন্য রাশিয়ান জ্বালানি তেল কেনা দ্বিগুণ করেছে দেশটি। এর মাধ্যমে নিজস্ব উৎপাদিত অপরিশোধিত তেল (ক্রুড) এর ওপর থেকেও চাপ কমাচ্ছে।
জ্বালানি বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলির তথ্যের ভিত্তিতে এসব কথা জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক কেন রাশিয়ার তেল কিনছে? কারণ- পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার তেলের আগের ক্রেতা সংখ্যা আর নেই। প্রভাবশালী কিছু দেশ যারা কূটনৈতিক চাপ অমান্য করতে পারে, তারাই কিনছে। এ অবস্থায় রাজস্ব সচল রাখতে তেল বিক্রিতে বড় মাপের ছাড়ও দিচ্ছে মস্কো। সৌদি আরব নিচ্ছে তারই সুযোগ। কম দামে রাশিয়ার তেল কিনে বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করছে, আর এতে করে নিজস্ব উৎপাদিত তেলের যে সাশ্রয় হচ্ছে- তা আন্তর্জাতিক বাজারদরে বিক্রি করে দুদিক দিয়ে লাভবান হতে পারছে।
সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত। তবে বাইডেন প্রশাসনের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের। এ বাস্তবতায়, রাশিয়ান তেলের বিক্রি বন্ধে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লো হোয়াইট হাউস।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে অনেক দেশ রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করলেও–চীন, ভারত, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু রাষ্ট্র আমদানি বাড়িয়েছে।
এদিকে জ্বালানি বাজারের বর্তমান দশায় উদ্বিগ্ন আমেরিকা। সরবরাহ বাড়ানোর অনুরোধ নিয়ে শুক্রবার (১৬ জুলাই) থেকে সৌদি আরব সফরে রয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
সৌদি আরবকে সরবরাহ বাড়াতে রাজি করাতে চান বাইডেন। এতে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমবে, তাতে করে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির গতিও কিছুটা স্তিমিত হবে।
স্বল্পমেয়াদে সৌদি আরবসহ অন্যান্য জ্বালানি তেল রপ্তানিকারকদের উৎপাদন বৃদ্ধির বাড়তি সক্ষমতা সামান্যই। জ্বালানি তেল উৎপাদকদের বৈশ্বিক জোট ওপেক প্লাসের মাধ্যমে রাশিয়ার সাথে সহযোগিতার সম্পর্কও বজায় রেখেছে সৌদি। মূলত, ওপেক ও এর বাইরের তেল উৎপাদক দেশগুলির অঘোষিত নেতৃত্ব রয়েছে সৌদি আরব ও রাশিয়ার হাতেই।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স রেফিনিটিভ ইকন শিপ ট্র্যাকিং এর তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছে, চলতি বছরের এপ্রিল- জুন সময়ে রাশিয়া ও এস্তোনিয়ার বন্দরগুলি দিয়ে ৬ লাখ ৪৭ হাজার টন (৪৮ হাজার ব্যারেল) রাশিয়ান জ্বালানি তেল আমদানি করেছে সৌদি আরব। গত বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার টন।
এর আগে ২০২১ সালের পুরো সময়ে ১০ লাখ টনের কিছু বেশি রাশিয়ান তেল কিনেছিল সৌদি আরব। তবে আমদানি বৃদ্ধির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি রাশিয়া ও সৌদি উভয় দেশের জ্বালানি মন্ত্রণালয়।
জ্বালানি বাজার বিশ্লেষক ফার্ম ভোরটেক্স রাশিয়ান উৎস থেকে আসা জ্বালানি তেল এস্তোনিয়া ও মিশর হয়ে সৌদিতে আমদানি বৃদ্ধির কথা জানিয়েছে।
সংস্থাটি আরও প্রমাণ পেয়েছে যে, জুনে মিশর থেকে সৌদির আমদানি করা তেলের পরিমাণ দৈনিক ১ লাখ ১০ হাজার ব্যারেলের রেকর্ড করেছে। একইমাসে, মিশরের রাশিয়ান তেল কেনা রেকর্ড হারে উল্লম্ফন করেছে দৈনিক ৭০ হাজার ব্যারেলে।
'বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফিডস্টক হিসেবে চাহিদা বাড়ায় জুনে সৌদি আরবের জ্বালানি তেল আমদানি হয় দৈনিক ৩ লাখ ২০ হাজার ব্যারেল, যা ২০২০ সালের নভেম্বরের পর সর্বোচ্চ'।
কয়েক বছর ধরেই রাশিয়ার জ্বালানি তেল আমদানি করছে সৌদি আরব। এতে দেশটির নিজস্ব ক্রুড (অশোধিত তেল) শোধনের চাপ কমেছে, একইসঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিজস্ব উৎসের জ্বালানি ব্যবহারের ওপর চাপও কমেছে। এতে তাদের উত্তোলিত ক্রুডের ভাণ্ডারে তেমন টান না পড়ায়-সহজেই ক্রুডের চালান ভালো দামে বিশ্ববাজারে বিক্রিও করতে পারছে।
সৌদি আরবে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুদ থাকলেও, ক্ষেত্রগুলি থেকে প্রধান প্রধান শহরগুলোর দূরত্ব বেশি। তাই অপেক্ষাকৃত বেশি দূষণ করে এমন জ্বালানি তেল পুড়িয়েই সিংহভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। গ্রীষ্মকালে শীতাতপ যন্ত্র ব্যবহারের চাহিদা সর্বোচ্চ মাত্রায় যখন পৌঁছায় তখন বিদ্যুৎ চাহিদাও বাড়ে।
জয়েন্ট অর্গানাইজেশন্স ডেটা ইনিশিয়েটিভ (জোডি)- এর তথ্যানুসারে, বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্রীষ্মে পোড়ানো হয় দৈনিক প্রায় ৬ লাখ ব্যারেল তেল; শীতকালে যা হয় দৈনিক ৩ লাখ ব্যারেলের কাছাকাছি। ২০১০ সালে দৈনিক ১০ লাখ ব্যারেল তেল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হতো। তবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহারও বাড়ায় তা এখন কমেছে।
আমদানির হাব আমিরাতের ফুজাইরাহ
মধ্যপ্রাচ্যের তেল বাণিজ্যের কেন্দ্র বলে পরিচিত আরব আমিরাতের উপকূলীয় নগরী-ফুজাইরাহ। ধারণা করা হচ্ছে, এই বন্দর দিয়েই সবচেয়ে বেশি রাশিয়ান তেল আমদানি করেছে সৌদি আরব।
শিপ ট্র্যাকিং ডেটা অনুসারে, চলতি বছরে এপর্যন্ত ১.১৭ মিলিয়ন টন রাশিয়ান জ্বালানি তেল ফুজাইরাহতে এসেছে। গত বছর যার পরিমাণ ছিল দশমিক ৯ মিলিয়ন টন। চলতি জুলাই মাসেই আরও দশমিক ৯ মিলিয়ন টন তেল ফুজাইরায় আসতে পারে। ফলে সবমিলিয়ে এপর্যন্ত মোট ২১ লাখ টন রাশিয়ান তেল আসবে, যা পুরো ২০২১ সালে আসা ১.৬৪ মিলিয়ন টনের চেয়েও বেশি।
ফুজাইরাহতে আসা বেশিরভাগ তেল জাহাজের জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হলেও এর একটা অংশ যায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে। ফুজাইরাহ দিয়ে ঠিক কী পরিমাণ রাশিয়ান তেল সৌদিতে যাচ্ছে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি।
- সূত্র: রয়টার্স