শীতের আগে আর মাত্র তিন মাস সময় পাচ্ছে ইউক্রেন
যুদ্ধের ময়দানে বরাবরই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র 'জেনারেল শীত'। আর এক মাসের মধ্যেই তার হাড়কাঁপানো স্পর্শ ধেয়ে আসবে পূর্ব রণাঙ্গনে। আর ঠিক তখনই কিয়েভের ইউরোপীয় মিত্রদের জ্বালানি সরবরাহের 'স্ক্রু টাইট' দেবে ক্রেমলিন। ফলতঃ সবচেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ার দিকে এগিয়ে চলেছে ইউক্রেন।
সুবিধে কিছুই পাবে না, তা অবশ্য নয়।
কৃষ্ণসাগর তীরের বিস্তীর্ণ সমভূমিতে শীতের তীব্রতা মানেই মাটি জমাট বাঁধার মতো হিম। শীত রক্ষণাত্মক পক্ষের জন্য সুবিধেজনক। এসময় তারা আশ্রয় ও উষ্ণতার সদ্ব্যবহার করতে পারে– আগ্রাসী শত্রুর চেয়ে ভালোভাবে।
শীতের প্রথমদিকে কাদা ও পরে তুষারের বাধার কারণে যানবাহন ও পদব্রজে চলাচলে নামে স্থবিরতা। আক্রমণকারী পক্ষের জন্য যা বড় অসুবিধা সৃষ্টি করে। এতে ইউক্রেনীয় বাহিনী তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকা ধরে রাখতে পারবে। তবে, এরমধ্যেই রাশিয়া দেশটির যে বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে– সেগুলির উল্লেখযোগ্য অংশ আর মুক্ত করতে পারবে না।
রণাঙ্গনের বাইরে, বাকী ইউরোপে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রভাব ফেলবে এবারের শীত। আর তাতেই হার হতে পারে ইউক্রেনের।
যুদ্ধে বড় কোনো অগ্রগতির খবর না থাকায় এরমধ্যেই হতাশ ইউরোপীয় গণমাধ্যম। শীত তাদের এ মনোভাব আরও বাড়াবে। সংবাদে তখন প্রাধান্য পাবে, তাদের নিজ নিজ দেশের জনগণের দুর্দশা–পুতিনের যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট যা আরও তীব্র করে তুলেছে।
ইউরোপীয়দের অতীত ভুলের মাশুল দিতে হবে। পুতিন ইউরোপকে সস্তায় রাশিয়ার জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার টোপ দিয়েছেন, যা তারা আকন্ঠ গিলেছে। ইউরোপের পরিবেশবাদী আন্দোলনেও করেছেন গোপন অর্থায়ন। তার এজেন্টরা প্রচারণা চালিয়ে ইউরোপের ভুখণ্ডে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানকে নিরুৎসাহিত করেছে। জার্মানিকে বাধ্য করেছে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করতে। ১৯৮০'র দশক পরমাণুশক্তি বিরোধী আন্দোলনে অর্থায়ন করেছিল মস্কো– ইউরোপের বর্তমান গ্রিন পার্টিগুলো ওই আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনার 'গুরু' পুতিন অপপ্রচার বিলোতেও সমান দক্ষ। রাশিয়ার আর্থিক লাভের পাশাপাশি, বর্তমান সময়ের মতো সংকটকালে উদ্দেশ্যসাধনের উপায় হিসেবেই তিনি এ জাল বিছিয়ে রাখেন। ফাঁদে আটকা ইউরোপ এখন তার রাজনৈতিক পণবন্দী।
চলতি বছরের জুনে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ ৬০ শতাংশ কমায় রাশিয়া। জ্বালানির অভাবে প্রচণ্ড উদ্বেগে ইইউ দেশগুলো। মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি ও খাদ্যের চড়ামূল্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের অর্থনীতি। আসন্ন শীতের আগে এই ক্ষতি কীভাবে কমানো যায় সেই ভাবনাতেই ব্যতিব্যস্ত তারা।
স্থানীয় গ্রাহকদের গ্যাস ব্যবহার কমাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। বাস্তবসম্মত একটি উপায় হতে পারে, আরও চড়াভাবে মূল্য বাড়ানো। তাতে ভোটাররা ভীষণ চটবে। বাধ্য হয়ে তখন দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে হবে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের। তারা ইউক্রেনকে দেওয়া 'দ্ব্যর্থহীন' সমর্থনের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার কথাও ভাবতে থাকবেন। এরমধ্যেই যে তাদের দৃঢ়তায় চিড় ধরেছে– তার ইঙ্গিতও মিলছে। পুতিনের আগ্রাসন মোকাবিলায় দেওয়া নিষেধাজ্ঞার অসারতা তাদের হতাশাকে আরও গভীর করছে।
ইউরোপের দেশগুলি নতিস্বীকার না করা পর্যন্ত কীভাবে চাপের কুঠারাঘাত চালিয়ে যেতে হবে–পুতিন তা ভালো করেই জানেন। একারণে তিনি শীতের তীব্রতা বাড়লে– সম্পূর্ণরুপে জ্বালানির 'ট্যাপ' বন্ধ করে দিতে পারেন। ইউরোপীয় নেতাদের মাথায় এই বন্দুক তাক করে, তিনি সন্ধিপ্রস্তাব দিতে পারেন আগামী নভেম্বরের জি-২০ সম্মেলনে।
বলতে পারেন, ক্রিমিয়া ও ডনবাস-সহ এরমধ্যেই রাশিয়ার দখলে চলে আসা ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে রাশিয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। পুতিন এসব এলাকায় গণভোটের প্রস্তাব দিতে পারেন; যার মাধ্যমে নির্ধারিত হবে তারা রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে চায় কিনা।
এই কূটকৌশলে আপোষের যে ইঙ্গিত আছে, তার লক্ষ্যবস্তু ইউক্রেন নয়– হবে ইউরোপই। কারণ, পুতিনের প্রস্তাব মানলেই তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা কিছুটা লাঘব হবে।
পুতিনের বার্তা আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) জন্যও কম আকর্ষণীয় হবে না। প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে মার্কিন অর্থনীতিও। প্রেসিডেন্ট বাইডেন এজন্য ইউক্রেন যুদ্ধকেই দুষছেন। গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাইডেন তার মনোভাব স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। কিয়েভের প্রতি আমেরিকার সামরিক সহায়তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে রাশিয়াকে আশ্বস্ত করার পাশাপাশি তিনি আরও লিখেছেন, 'নিজ ভূখণ্ডের কোনো অংশের অধিকার ছেড়ে দেওয়ার জন্য আমি ইউক্রেনের সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করব না'। উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন পর প্রধান কোনো পশ্চিমা দেশের নেতা ইউক্রেনকে তার ভূখণ্ড ছাড় দিতে হতে পারে এমন সম্ভাবনা নিয়ে মুখ খুলেছেন। আর তাৎপর্যটা সেখানেই।
পশ্চিমা দুনিয়ায় সংকট গাঢ় হলে–তাদের নেতারাও পুতিনের শান্তির প্রস্তাবে প্রলুদ্ধ হবেন। জেলেনস্কিকে দেওয়া সমর্থন উঠতে পারে শিকেয়। এপর্যন্ত, শক্তিক্ষয়ের যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য অনুকূল এমনটাই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু, অচিরেই এই দাবিকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলবে 'জেনারেল শীত'। অতীতেও দেখা গেছে, রাশিয়া অধিকাংশ যুদ্ধ শুরু করেছে বাজেভাবে। কিন্তু, অতিবাহিত সময়ের সাথে সাথে নিজের বিপুল সম্পদ ও মানবশক্তিকে যুদ্ধে নিয়োজিত করতে সমর্থ হয়েছে।
অন্যদিকে, ইউক্রেন এখনও টিকে আছে বিদেশি সহায়তার অস্ত্র, সরঞ্জাম আর গোয়েন্দা তথ্যের জোরে। আর তাই যদি বন্ধ হয়– তাহলে পিঠে ছুরিবিদ্ধ হবে ইউক্রেন। জয়ের হাসি হাসবেন পুতিন।
- সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ