গ্রে-মার্কেট আমদানির মাধ্যমে রাশিয়া যেভাবে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দিচ্ছে
কয়েক মাস ধরে রাশিয়া তাদের পশ্চিমা উৎপাদকদের সম্মতি ছাড়াই পণ্য আমদানি করছে। ইউক্রেন আক্রমণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে পশ্চিমা দেশ ও সংস্থাগুলোর আরোপ করা বিধিনিষেধের ফলে সরবরাহে যে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে, তাকে পাশ কাটানোর জন্যই এ ব্যবস্থা নিয়েছে দেশটি।
রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী এবং শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী ডেনিস মান্টুরভ এ সপ্তাহে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মে থেকে জুলাই পর্যন্ত রাশিয়ায় সমান্তরাল আমদানি (প্যারালেল ইমপোর্ট) বা গ্রে-মার্কেটে কেনাকাটা মোট ৫ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার আমদানি কমে গেছে। সেইসঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রতিবাদে ও কোনো সম্ভাব্য সুনামগত লোকসান এড়াতে অনেক বিদেশি কোম্পানিও রাশিয়া ছেড়েছে। এ দুই ধাক্কা সামাল দেওয়ার জন্য মস্কো সমান্তরাল আমদানি স্কিম চালু করে। অটো যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে গেমিং কনসোল পর্যন্ত পণ্যসমূহ এ স্কিমের অন্তর্ভুক্ত।
ব্লুবে অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের উদীয়মান বাজার স্ট্র্যাটেজিস্ট টিমোথি অ্যাশ সংবাদমাধ্যম ডয়েচেভেলেকে বলেন, 'পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া চুপ করে বসে থাকবে না। কাজেই রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে ও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ আমদানি অব্যাহত রাখবে। এখন প্রশ্ন এবং চ্যালেঞ্জ হলো, এটি ঠেকাতে ও নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করতে পশ্চিমারা কী ব্যবস্থা নেবে?'
সমান্তরাল আমদানি কী?
সমান্তরাল আমদানি বলতে এমন সব পণ্যকে বোঝায় যেগুলো তাদের উৎপাদকদের সম্মতি ছাড়াই বাজারে আমদানি করা হয়। সোজাসুজি বললে, এগুলো নির্ভেজাল পণ্য—তবে উৎপাদকের এই পণ্যগুলোকে অন্য কোনো দেশ বা অঞ্চলে বিক্রি করার কথা ছল।
ধরা যাক, একজোড়া লেভির জিন্স উৎপাদন, প্যাকেজ ও মূল্য নির্ধারণ করা হলো ভারতের বাজারের জন্য—কিন্তু সেই পণ্য কোনো রিসেলার আমদানি করে জার্মানিতে বিক্রি করল। অর্থাৎ যে বিতরণ চ্যানেলের জন্য পোশাক প্রস্তুতকারক ওই পোশাককে প্রত্যয়িত করেছিল, তার বাইরে বিক্রি করল। সেক্ষেত্রে এই চ্যানেলের বাইরের বিক্রিই হবে সমান্তরাল আমদানি।
আরেকটা উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি তাদের তৈরি কোভিড টিকা যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে বাংলাদেশি মুদ্রায় ১,৫০০ টাকায় বাজারজাত করছে। এরপর দেখা গেল, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট সেটির যথাযথ লাইসেন্স নিয়ে এসে সস্তাশ্রমে ভারতে ওই টিকা তৈরি করে বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩০০ টাকায় ভারতের বাজারে ছাড়ছে। আর ভারতে তৈরি এই টিকা বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিনিধির মাধ্যমে ২,০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশের কোনো ওষুধ কোম্পানি যদি অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি বা সেরাম ইনস্টিটিউটের অগোচরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, ভারত বা অন্য কোনো বাজার থেকে এ টিকা আমদানি করে, তবে এই আমদানি সমান্তরাল আমদানি বলা যাবে।
এ ধরনের আমদানিকে গ্রে মার্কেট বলা হয়, এভাবে কেনা পণ্য বিক্রি করে অননুমোদিত ডিলাররা। ব্র্যান্ড মালিকদের যেহেতু এই পণ্যগুলোর বিপণনের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তাই এসব পণ্যে ওয়ারেন্টি পাওয়া যায় না।
রাশিয়া কী করছে?
মে মাসে রাশিয়া সমান্তরাল আমদানি প্রকল্পের আওতায় আমদানিযোগ্য পশ্চিমা পণ্যগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করে। এ তালিকায় যুদ্ধজাহাজ, রেলওয়ের জন্য প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশের পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস ও গৃহস্থালির যন্ত্রপাতি, পোশাক, জুতা এবং প্রসাধনী সামগ্রীর মতো ভোগ্যপণ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্য রয়েছে। রাশিয়া জানায়, এসব পণ্যের পশ্চিমা নির্মাতারা এগুলোকে 'সরাসরি সরবরাহ করতে রাজি হয়নি'।
সমান্তরাল আমদানির তালিকায় মার্সিডিজ-বেঞ্জ, ভক্সওয়াগেন, কন্টিনেন্টাল, ফেরারি, অ্যাপল, স্যামসাং, মাইক্রোসফট, সিমেন্স, ডুরাসেল, ক্যানন ও প্লেস্টেশনের মতো বেশ কিছু ব্র্যান্ড ছিল।
আনুষ্ঠানিক চ্যানেলকে পাশ কাটানোর জন্য বেসামরিক মামলার মুখোমুখি হওয়া থেকে আমদানিকারকদের সুরক্ষা দেয় রাশিয়ার এই স্কিম।
রাশিয়ায় অননুমোদিত আমদানির বেশিরভাগই আসছে কাজাখস্তান, আর্মেনিয়া ও বেলারুশের মতো সোভিয়েত-উত্তর দেশগুলোর মাধ্যমে।
এই গ্রে-মার্কেট কেনাকাটা কি বৈধ?
সমান্তরাল আমদানি সাধারণত অবৈধ নয়। এগুলো পণ্যগুলো আসল এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত। পার্থক্য একটাই—এগুলো কেনা হয় সমান্তরাল বিপণন চ্যানেলের মাধ্যমে। আর এগুলো প্রায়ই বেশি দামে কেনা হয়।
ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (উইপো) প্রকাশিত একটি নথি বলছে, যেসব চ্যানেলের মাধ্যমে পণ্যগুলো আমদানি করা হয়, সেগুলোই শুধু ধূসর ও রহস্যময় হতে পারে (অর্থাৎ পণ্যগুলো নয়)।
ওই নথিতে আরও বলা হয়, তৃতীয় পক্ষের আমদানি বা বিক্রি করা পণ্য যদি ওই নির্দিষ্ট দেশে বৈধ পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক বা কপিরাইটের আওতায় পড়ে, তবে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা এই ধরনের বিক্রয় বা আমদানি সাধারণত আইনের লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হয়।
রাশিয়ার সংবাদসংস্থা ইন্টারফ্যাক্সের তথ্য অনুসারে, রাশিয়ান স্কিমে কপিরাইট 'exhaustion'-এর আন্তর্জাতিক নীতি যুক্ত করা হয়েছে। এ নীতিমালার সুবাদে রাশিয়ান কোম্পানি বিশ্বের যেকোনো দেশে বিক্রি শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদকের সম্মতি ছাড়াই পণ্য আমদানি করতে পারে।
এর অর্থ হলো, রাশিয়ান সমান্তরাল আমদানির তালিকায় থাকা অ্যাপল যখন চলতি বছরের শেষের দিকে আইফোন ১৪ বিক্রি শুরু করবে, 'রিস্টোর'-এর মতো রুশ রিসেলাররা তখন সেগুলো বিক্রির জন্য আমদানি করতে পারবে (যদিও মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্টটি কয়েক মাস আগেই রাশিয়া থেকে বেরিয়ে গেছে।)
সমান্তরাল আমদানি কীভাবে রাশিয়ার অর্থনীতিকে সাহায্য করছে?
রাশিয়া এই আমদানি স্কিমটি করেছে অত্যাবশ্যক আমদানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে। পশ্চিমা কোম্পানিগুলো রাশিয়া ছাড়া পর এ ধরনের আমদানি কমে গিয়েছিল।
চলতি বছর সমান্তরাল আমদানি ১৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে বলে আশা করছে মস্কো। যা ২০২১ সালের মোট আমদানির মাত্র ৪ শতাংশের সমান হবে। ধারণা করা হচ্ছে, রাশিয়ায় মোট আমদানি চলতি বছর এক-তৃতীয়াংশের মতো কমে যাবে।
টিমোথি অ্যাশ বলেন, পুতিনের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর পুনর্গঠন করা। ইলেকট্রনিকস যন্ত্রাংশ না পাওয়ার কারণে যদি রাশিয়ায় গাড়ির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ট্যাঙ্ক বা বিমান মেরামত বা তৈরিও বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রেমলিন আশা করছে সমান্তরাল আমদানি প্রকল্পের মাধ্যমে আরেকটি উদ্দেশ্য হাসিল করা যাবে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে তালিকায় থাকা বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ও বিলাসপণ্য রাশিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা মোটামুটি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
টিমোথি অ্যাশ বলেন, 'এর মাধ্যমে হয়তো সাধারণ মানুষকে বার্তা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে (পশ্চিমা) নিষেধাজ্ঞা কোনো কাজে আসছে না এবং আমরাই জিতছি।'
রাশিয়ায় সমান্তরাল আমদানি থামাতে পশ্চিমারা কী করতে পারে?
যেহেতু রাশিয়া আন্তর্জাতিক কপিরাইটের 'exhaustion' নিয়ম অনুসরণ করছে, সে কারণে পশ্চিমা কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের সমান্তরাল আমদানি রোধ করার জন্য খুব বেশি ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
টিমোথি অ্যাশ বলেন, রাশিয়াকে যেন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহায়তা না করে, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থাকে সে পরামর্শ দিতে পারে পশ্চিমা সরকারগুলো। এমনকি প্রয়োজনে ওই দেশগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিও দিতে পারে। এর বেশি আপাতত পশ্চিমের নেতাদের আর কিছু করার নেই।
- সূত্র: ডয়েচেভেলে