নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের নাশকতায় কে বেশি লাভবান হচ্ছে?
দীর্ঘদিন ধরে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর (বিশেষত জার্মানির) রাশিয়ান গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতার বিরোধিতা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। সোভিয়েত রাষ্ট্র থাকার সময়েও যা ছিল। রাশিয়ার ওপর গ্যাসের জন্য নির্ভরশীল হলে ইউরোপের দেশগুলি যেকোনো সরবরাহ বন্ধের হুমকির মুখে ক্রেমলিনের সামনে মাথানত করবে– এই শঙ্কা থেকেই ১৯৮০'র দশকেও রাশিয়ার ইয়ামাল পাইপলাইন নির্মাণ বন্ধ করতে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল ওয়াশিংটন।
এছাড়া, ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে রাশিয়া থেকে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হবে বলে ইউরোপীয় নেতাদের সতর্ক করেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জবাবে অধিবেশনে যোগ দেওয়া জার্মান প্রতিনিধিরা ট্রাম্পকে ব্যঙ্গ করছেন এমন একটি ভিডিও-ও রয়েছে।
অবশ্য, ব্যঙ্গ-মশকরার দিন ফুরায়– ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে। যুদ্ধ চলাকালে ইউরোপে বেশ কয়েকবার উল্লেখযোগ্য হারে গ্যাস সরবরাহ হ্রাস করে রাশিয়া।
রাশিয়ার বিকল্প সরবরাহ যোগাতে, সম্প্রতি আন্তঃবাল্টিক পাইপলাইন সচল করার ঘোষণা দিয়েছে নরওয়ে ও পোল্যান্ড।
এসব কিছুর মধ্যেই বাল্টিক সাগরের ডেনমার্কের অধীনে থাকা ব্রনহল্ম দ্বীপের কাছাকাছি জলসীমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নর্ড স্ট্রিম-১ ও নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলাইন।
এ পর্যন্ত চারটি ভিন্ন স্থানে পাইপলাইন দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে এটি যে নিছক কোনো কারিগরি ত্রুটির কারণে হওয়া দুর্ঘটনা নয়– বরং ইচ্ছেকৃত নাশকতা তা স্পষ্ট।
দুটি পাইপলাইন দিয়েই বর্তমানে রপ্তানি বন্ধ, কিন্তু চাপ বজায় রাখতে এগুলিতে গ্যাসের প্রবাহ রয়েছে। এখনও ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ নিরূপণ করা না হলেও– ক্ষতিগ্রস্ত অংশ দিয়ে যেভাবে বিপুল পরিমাণ গ্যাস পানির ওপর বুদ্বুদ হয়ে উঠে আসছে; তাতে বোঝা যায় উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে উভয় পাইপলাইনের।
রাজনৈতিক দৃশ্যপটে পরিবর্তন এলেই শুধুমাত্র গতি আসবে মেরামতের উদ্যোগে। তখন যদি প্রথম নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনটি অগ্রাধিকারও পায়– তবুও তাতে অনেক সময় লাগবে। খুব সম্ভবত ইউরোপের প্রান্তরে শীত ধেয়ে আসার আগেই মেরামত করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু, কে ক্ষতি করলো এই পাইপলাইনগুলোর?
প্রথমেই যে ধারণাটি মাথায় আসে তা হলো– ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতেই এই 'স্যাবোটাজ' করা হয়েছে।
এই ধরনের গোপনীয় অপারেশন চালাতে হলে দরকার সাগরতলে পাইপলাইন শনাক্ত করে তার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে শক্তিশালী বিস্ফোরক স্থাপনের সক্ষমতা।
এখন প্রশ্ন হলো– কোন দেশ বা গোষ্ঠী এই কাজ করেছে এবং কেন করেছে?
বাল্টিক সাগরতলে ৮০ থেকে ১১০ মিটার (২৬২- ৩৬০ ফুট) গভীরতায় বিছানো হয়েছে পাইপলাইন দুটি। একজন ডুবুরি তার সরঞ্জাম নিয়ে ৬ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে। আরও গভীরে পৌঁছাতে চাই ডুবোযান। এই ধরনের হামলা কোনো সামরিকভাবে সুপ্রশিক্ষিত শক্তির দ্বারাই সম্ভব। এবং খুব সম্ভবত তারা 'সাবমারসিবল' জাতীয় ছোট ডুবোযান ব্যবহার করেছে পাইপলাইন দুটিতে বিস্ফোরক স্থাপনে।
নর্ড স্ট্রিমের পাইপগুলোও যেনতেন নয়। এগুলি বিশেষভাবে স্থায়ী ও মজবুত ডিএনভি গ্রেডের এসএডব্লিউএল ৪৮৫ ইস্পাতে তৈরি। পাইপের চারপাশের পুরুত্ব ২৬.৮ থেকে ৩৪.৪ মিলিমিটার পর্যন্ত।
বিশ্বের মাত্র ৬টি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের উচ্চ মানের পাইপ তৈরি করে থাকে। এরমধ্যে একটি রাশিয়ায়, চারটি ইউরোপ এবং আরেকটি জাপানে অবস্থিত।
আবার সাগরতলে স্থাপনের জন্য পাইপ মোড়ানো হয় পুরু কংক্রিটের আচ্ছাদনে। ফলে যেনতেনভাবে এর ক্ষতি করা সম্ভব নয়। এরমধ্যেই ইউক্রেন অভিযোগ করেছে যে, রাশিয়ানরাই করেছে এই নাশকতা!
ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্টের শীর্ষ উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়ক টুইটারে লিখেছেন, 'এত বড় পরিসরে গ্যাস লিকের ঘটনা রাশিয়ার পরিকল্পিত সন্ত্রাসী হামলা ছাড়া আর কিছু নয়। এটি ইইউ'য়ের বিরুদ্ধে আগ্রাসনের শামিল'।
কিন্তু, যুক্তিটি বড় খোঁড়া। এতে রাশিয়ার ক্ষতি বৈ লাভ নেই মোটেও। মস্কোর জানা আছে, নিজেদের পাইপলাইন ধ্বংস করলে– ইউরোপের ওপর তার উদ্দেশ্যসাধনের শক্তিকেই নষ্ট করা হবে।
নর্ডস্ট্রিম ১ ও ২– দুই পাইপলাইনের মালিকানা একটি যৌথ প্রকল্পের মাধ্যমে ভাগাভাগি করা হয়েছে। এতে রাশিয়ার গ্যাজপ্রমের মালিকানা ৫১ শতাংশ, আর বাকিটা এর চারটি পশ্চিমা অংশীদারের।
আর্থিকভাবে রাশিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে অভিযোগকারী ইউক্রেনই এই হামলার পেছনে থাকতে পারে। তাই যদি হয়, এবং যদি ইউক্রেন 'দোষী' হিসেবে প্রমাণিত হয়– তাহলে কিয়েভের সাথে ইউরোপ ও ন্যাটোর সম্পর্ক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশের রিমোটচালিত রোবোটিক ডুবোযান পরিচালনার সক্ষমতা রয়েছে। এরমধ্যে অনেক দেশেরই আছে জলের তলায় অভিযান চালানোর মতো প্রশিক্ষিত বাহিনী। কিন্তু, কোন ইউরোপীয় দেশ নিজের পায়ে কুড়াল মারবে?
নাশকতা চালানো ইউরোপের যেকোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই খুবই বিপজ্জনক। কারণ পাইপলাইন দুটি শুধু রাশিয়ার নয়, রাজনৈতিক সমাধান হলে– ভবিষ্যৎ সরবরাহ পেতে ইউরোপেরও দরকার। তাছাড়া, এই হামলাকে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে ধরে নেবে রাশিয়া।
সন্দেহের তীর দুর্বল হলেও অন্য কয়েকটি পক্ষের দিকেও তাক করা যায়। যেমন ফিনল্যান্ড। দেশটি ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকেই রাশিয়ার সাথে গুরুতর বিবাদে জড়িয়েছে। ইতোমধ্যে ফিনল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়া। তার আগে মস্কো দেশটিতে বিদ্যুৎ রপ্তানিও বন্ধ করে।
তারপরও নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে ফিনল্যান্ড কেনইবা এ ধরনের পাল্টা আঘাত হানতে যাবে– তা বোধগম্য নয়। জ্বালানি নিয়ে এত সংকটে থাকলে রাশিয়ার কয়লা ও তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা দিত না দেশটি।
বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশগুলির সাথে রাশিয়ার সম্পর্কে তীব্র উত্তেজনা রয়েছে। ফলে তাদের যেকেউই নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে নাশকতা করতে পারে। কিন্তু, যদি যদি অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়– তখন ইউরোপ গ্যাসের চালান বঞ্চিত হবে। তাই নিরাপত্তার জন্য ন্যাটো জোটের ওপর নির্ভরশীল বাল্টিক দেশগুলি এ অপকর্ম করেছে এমন সম্ভাবনা খুবই কম।
আসন্ন শীতে ইউরোপের ওপর ভ্লাদিমির পুতিনের চাপ প্রয়োগের শক্তিকে চিরতরে দূর করতে তাহলে কী আমেরিকাই একাজ করেছে?
শীতের তীব্রতায় ইউরোপ নিজ স্বার্থের কথা ভেবে রাশিয়ার সামনে নতজানু হবে বা এনিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যে ভাঙন ধরবে– এমন শঙ্কা থেকে ওয়াশিংটন এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু, এ পদক্ষেপের সাথে জড়িত বিপুল রাজনৈতিক, কৌশলগত ও নিরাপত্তা ঝুঁকি।
অবশ্য একথাও সত্য– রাশিয়ার সাথে উত্তেজনার কারণে ইউরোপে রমরমা যুক্তরাষ্ট্রের এলএনজি রপ্তানি। আসন্ন শীতের জন্য জ্বালানি মজুত করতেই মার্কিন এলএনজির চালান কিনে চলেছে ইউরোপ।
ইউরোপে বেশিরভাগ মার্কিন চালান আসে ফ্রান্স হয়ে। অপ্রধান রুট হিসেবে আরও ব্যবহার হয় স্পেন ও নেদারল্যান্ডস।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, বর্তমানে এলএনজি রপ্তানির প্রায় সর্বোচ্চ সক্ষমতা ব্যবহার করছে আমেরিকা। এর বেশি চালান পাঠালে আমেরিকাতেই প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টার সময় মার্কিন সরকারও অভ্যন্তরীণ জ্বালানি বাজারকে এভাবে সংকটের মধ্যে ফেলতে চাইবে না।
তাই নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনে কে নাশকতা চালিয়েছে সে প্রশ্নের যৌক্তিক উত্তর এই মুহূর্তে কেউই দিতে পারবে না। তবে এতে শত্রুর কাছ থেকে গ্যাস কেনার ইউরোপীয় সিদ্ধান্তের অদূরদর্শীতা প্রমাণিত হয়েছে। গত ৩৭ বছর ধরে তারা যে নির্বিঘ্নে জ্বালানি কিনতে পেরেছে– সেটাই বরং বিস্ময়ের।
এশিয়া টাইমস থেকে অনূদিত