জ্বালানি তেলের প্রকৃত উৎপাদন কমবে ১০%, বাকি ৯০ শতাংশ ঘিরেই অনিশ্চয়তা
আন্তর্জাতিক জ্বালানি তেল বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ন্ত্রক জোট ওপেক প্লাস। গত বুধবার জোটভুক্ত দেশগুলির জ্বালানি ও তেলমন্ত্রীরা এক বৈঠকে মিলিত হন, যেখানে তারা সকলে মিলে দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেন। উৎপাদনের (উত্তোলন, পরিশোধন ও সরবরাহ) এ দৈনিক লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর হবে আসছে নভেম্বর থেকেই। ফলে আরেকদফা সরবরাহ সংকোচন দেখা যাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণশক্তি জীবাশ্ম জ্বালানিটির সরবরাহের ক্ষেত্রে।
ধারণা করা হচ্ছে, ওপেকের প্রকৃত উৎপাদন হ্রাসের পরিমাণ ঘোষিত মাত্রার এক-দশমাংশ হবে।
ওপেক প্লাস ২৩ দেশের জোট হলেও– সাম্প্রতিক কর্তনের সিংহভাগ ভার নিয়েছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত। কারণ, জোটের অন্যান্য দেশ ইতোমধ্যেই তাদের জন্য নির্ধারিত কোটার চেয়েও কম উত্তোলন করছে। নভেম্বরের হ্রাসকৃত নতুন লক্ষ্যমাত্রাও তারা পূরণ করতে পারবে না।
ওপেক প্লাসের গত সেপ্টেম্বরের উৎপাদনের তথ্য ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, এসময়ে সামষ্টিকভাবে জোটটি তাদের হ্রাসকৃত দৈনিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ৩৬ লাখ ব্যারেল পিছিয়ে ছিল।
তাই নভেম্বরে যখন নতুন লক্ষ্যমাত্রা কার্যকর হবে তখন সৌদি, আমিরাত ও কুয়েতের পাশাপাশি আর মাত্র আটটি ওপেক প্লাস দেশকে তাদের জীবাশ্ম তেল উত্তোলন হ্রাস করতে হবে। যার আওতকায়- দক্ষিণ সুদান, আলজেরিয়া, গ্যাবন, ইরাক এবং ওমান-ও কমাবে সামান্য পরিমাণে।
শেষোক্ত দেশগুলিকে তাদের দৈনিক উত্তোলন কমাতে হবে মাত্র ৮ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল। এটি উল্লেখযোগ্য মাত্রার কর্তন হলেও, ঘোষিত পরিমাণের চেয়ে অনেকটাই কম।
তবে জ্বালানি বাজারে এতোটা সরবরাহ কর্তনও ধরে নেওয়ার কারণ নেই। কারণ শেষপর্যন্ত দক্ষিণ সুদান, গ্যাবন ও খুব সম্ভবত ইরাক সিদ্ধান্তটি মেনে চলবে না।
ওপেকের বর্তমান দৈনিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাটি কার্যকর হয় ২০২০ সালের মে মাসের এক চুক্তি দ্বারা। এর আওতায়, দক্ষিণ সুদানের জন্য যে মাসিক কোটা নির্ধারিত ছিল– দেশটি প্রতিমাসে কেবল তা ছাড়িয়েই যায়নি বরং কখনোই এক ব্যারেলও উত্তোলন কমায়নি।
একইরকম ইচ্ছের অভাব আছে গ্যাবনের। ২০২০ সালের চুক্তির ২৯ মাস পেরিয়ে গেলেও এরমধ্যে মাত্র একমাসই জ্বালানি উৎপাদনের সীমা মেনেছে দেশটি। এটাও জানাচ্ছে ওপেকেরই তথ্য।
বুধবার ওপেক প্লাস জোটের সরবরাহ কর্তনের ঘোষণা আসার পরপরই তড়িঘড়ি করে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আশ্বস্ত করতে নামেন দেশটির তেলমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, এ সিদ্ধান্তে তার দেশের রপ্তানি প্রভাবিত হবে না।
ইরাকে স্থানীয়ভাবে তেলের ব্যবহার বৃদ্ধির সুযোগ কম থাকায়, ওপেক নির্ধারিত কোটার চেয়েও বেশি পরিমাণ তেল উত্তোলন করে বাগদাদ রপ্তানি বাজারেই পাঠাবে।
এই তিনটি দেশকে তাই গোনায় ধরা যায় না। আদতে সরবরাহ কর্তনের হিসাবে মূল ভূমিকা রাখবে পাঁচটি দেশ।
এই পাঁচ দেশের মধ্যে আলজেরিয়া ও ওমানকে দৈনিক মাত্র ৩২ হাজার ব্যারেল কম উত্তোলন করতে হবে।
অন্যদিকে সৌদি আরব, কুয়েত ও আমিরাতকে কমাতে হবে দৈনিক ৭ লাখ ৯০ হাজার ব্যারেল। তবে জোটের অন্য সদস্য দেশগুলি বাড়তি উৎপাদন করলে– এই হ্রাস কাজে আসবে না।
এরমধ্যেই জ্বালানি তেল উত্তোলন কমে এসেছে নাইজেরিয়া, এঙ্গোলা ও মালয়েশিয়ায়; এনিয়ে শঙ্কিত তারা। আগামীতেও দেশগুলি প্রতি মাসেই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উত্তোলন করবে। এই পরিস্থিতির সহসাই উন্নতি আশা করাও হচ্ছে না।
তেল উত্তোলন বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে রাশিয়াও। ইউক্রেন যুদ্ধের অর্থায়নের জন্য জ্বালানি রপ্তানি বাড়িয়েছেন পুতিন। দুর্মুল্যের এই বাজারে রাশিয়া মূল্যছাড়ে বিক্রি করছে বিপুল তেল। ফলে উৎপাদন বাড়ানোর চাপও প্রতিনিয়ত বাড়ছে খাতটির কাঁধে।
পুতিনের এই বাড়তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, উত্তোলন বাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে রুশ কোম্পানিগুলো। অবশ্য এই প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই। তবে যুদ্ধ শুরুর পর পশ্চিমা অনেক কোম্পানি রাশিয়া থেকে চলে যাওয়ায়, এবং রুশ জ্বালানি খাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, সরঞ্জাম ইত্যাদি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর তা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে।
মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে বড় দেশ কাজাখস্তান- জ্বালানি সম্পদে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। দেশটির বড় কয়েকটি তেলক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত রক্ষণাবেক্ষণ কাজ এবং আরেকটি ক্ষেত্রে গ্যাস লিকেজ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে দৈনিক উত্তোলন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল কম উত্তোলন হচ্ছে।
আস্তানার জন্য শুভ সংবাদ হলো– মেরামতির কাজ শেষ হচ্ছে এই সপ্তাহান্তে। এতে করে আরও ২ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেল উত্তোলন তাৎক্ষণিকভাবে বাড়বে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দরকারি বাকিটুকু চলতি মাসের শেষ নাগাদ করা সম্ভব হবে বলে আশা করছেন দেশটির জ্বালানিমন্ত্রী। অথচ তখনই কার্যকর হবে ওপেক প্লাসের সরবরাহ কর্তনের সিদ্ধান্ত।
ফলে কাজাখ জ্বালানিমন্ত্রী যদি সঠিক কথাই বলে থাকেন– তাহলে প্রকৃতপক্ষে সরবরাহ খুব কমই কমাতে হবে তার দেশকে। এর সর্বোচ্চ মাত্রা হতে পারে ২ লাখ ৩০ হাজার ব্যারেলের মতো স্বল্প পরিসরের। ফলে এনিয়ে দুর্ভাবনাও নেই আস্তানার।
তবে একমাস পর পরিস্থিতি হবে অন্যরকম। ৫ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হচ্ছে রাশিয়ার অশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা। এরপরের দিনই করণীয় নির্ধারণে আবার বৈঠক করবে ওপেক প্লাস।
ইইউ এর এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবে সমুদ্রপথে রাশিয়ান তেল রপ্তানি বাণিজ্য। এরমধ্যেই যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেছে। যেমন জানুয়ারিতে দৈনিক সমুদ্রপথে ইইউভুক্ত দেশগুলিতে ১৬ লাখ ব্যারেল রপ্তানি করা হতো; যা এখন ৬ লাখ ৬০ হাজার ব্যারেলে নেমে এসেছে।
ইউরোপ যে পরিমাণে তেল কেনা কমিয়েছে– সেটা ভারত, তুরস্ক ও চীনের মতো বিকল্প ক্রেতার কাছে বিক্রি করছে মস্কো। তবে এখানেও একটি বড় সমস্যা আছে। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো আর ট্যাংকার জাহাজে রুশ তেল বাণিজ্য করবে না। আর রাশিয়ার নিজস্ব ট্যাংকার বহরে এত জাহাজও নেই যা ইউরোপে প্রত্যাখ্যাত চালানের পুরোটা অন্যত্র রপ্তানি করতে পারবে। ফলে বাধ্য হয়েই উৎপাদন কর্তনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে রাশিয়াকে।
রাশিয়ার রাজস্ব কমাতে দেশটির জ্বালানি তেল রপ্তানিতে মূল্যসীমা বেঁধে দিতে চায় ইইউ। মূল্যসীমা অনুসারে বা এর চেয়ে কম দামে বিক্রি করলে রাশিয়া ইইউ নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পারতো। তবে পদক্ষেপটিকে বেআইনি বলে অভিহিত করেছে মস্কো। এবং মেনে না নেওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে।
মূল্যসীমা মেনে না নিয়ে ক্রেমলিন যদি উৎপাদন হ্রাসের পথই বেছে নেয়– তাহলে ওপেকের দৈনিক ২০ লাখ ব্যারেল সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ সহসাই কঠিন বাস্তবতায় রূপ নেবে।
ফলে ২০২২ সালের বাকিটা সময়ও যে তেলের দর সূচক রোলারকোস্টার রাইডের মতোই উত্থানপতন দেখবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ