রাশিয়ার কৌশল পরিবর্তন? ইউক্রেনকে প্রস্তরযুগে ফেরত পাঠাতে চায় রাশিয়া?
গত মঙ্গলবার ইউক্রেনে অন্তত ৮০টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে রাশিয়া। বুধবারে এ হামলার তীব্রতা কিছুটা কমলেও গত ২৪ ঘণ্টায় ৪০টির বেশি ইউক্রেনীয় শহর ও মফস্বল এলাকায় আঘাত হেনেছে রুশ মিসাইল। হামলার প্রচণ্ডতা এতই যে ইউক্রেনে পেট্রিয়টসহ অন্যান্য ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ন্যাটো। কের্চ সেতুতে হামলার পর থেকেই ধার বেড়েছে রুশ আক্রমণের। এ প্রেক্ষাপটে যুদ্ধে রাশিয়ার নয়া-কৌশল বিশ্লেষণ করেছেন কলামিস্ট স্টিফেন ব্রিয়েন, এশিয়া টাইমস-এ প্রকাশিত বিশ্লেষণটির ঈষৎ পরিমার্জিত ও ভাবানুদিত অংশ টিবিএসের পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।
এরমধ্যেই ইউক্রেনে রাশিয়ার 'পারমাণবিক যুদ্ধ' শুরু হয়ে গেছে, যদিও তা হচ্ছে না 'সাধারণ' পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগে। রাশিয়ার পারমাণবিক কৌশলের মূল উদ্দেশ্যই হলো– ইউক্রেনের অধিকাংশ অঞ্চলের অত্যাবশ্যক অবকাঠামো ধ্বংস করা, এবং দেশটিকে ধবংস্তুপে পরিণত করা। এই কাজ খোদ আমেরিকানরাও করেছে অন্য দেশে। এই কৌশলকে তারা বলে, বোমা মেরে প্রস্তর যুগে ফেরত পাঠানো। যেমন তারা ইরাকের ক্ষেত্রে এই হুমকি দেয় এবং তা বাস্তবায়নও করেছে।
আর রাশিয়ার কাছে অত্যাবশ্যক অবকাঠামো ধ্বংস করার মানেই হলো– সেখানে ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন বা রকেট আর্টিলারির হামলা করা।
যুদ্ধের শুরু থেকেই ইউক্রেনের সব বেসামরিক অবকাঠামোকে নিশানা করেনি ক্রেমলিন। কিন্তু, ইউক্রেনীয় প্রতিরোধ জোরদার হতে থাকলে রুশ বাহিনী শহর ও গ্রামগুলোতে ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু, তখন এ ধরনের কৌশল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়েছে যুদ্ধাঞ্চলে। বাকি ইউক্রেন অনেকটাই সুরক্ষিত ছিল।
সর্বশেষ ক্রিমিয়ার কের্চ সেতুতে বোমা হামলার পর ইউক্রেনীয় শহরগুলিতে ফের ব্যাপক হামলা শুরু করেছে রাশিয়া। একে ক্রেমলিনের প্রতিশোধমূলক হামলা হিসেবেই দেখছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
রাশিয়া এর আগেই ক্রিমিয়াকে নিজ ভূখণ্ডের সাথে অন্তর্ভুক্ত করেছে। আর রুশ ভুখণ্ডে হামলা করা হলে তা শেষ সীমা অতিক্রম করা হবে বলে আগেই জানিয়ে দেন পুতিন। ইউক্রেন কের্চ সেতুতে হামলার দায় পরোক্ষভাবে স্বীকারও করেছে এবং তার মাধ্যমে রাশিয়ার 'রেড লাইন' অতিক্রম করেছে। পুতিন সে জন্যই কিয়েভকে কঠিন পরিণতির নমুনা দেখাচ্ছেন। এমনটাই বিশ্বাস অনেক বিশ্লেষকের।
তবে এই ব্যাখ্যা আংশিক সত্য। কারণ, এর আগেও উভয়পক্ষই একে-অপরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোয় হামলা করেছে।
তবে তার সঙ্গে ১০ অক্টোবরে চালানো ব্যাপক রাশিয়ান মিসাইল হামলার পার্থক্য হলো– কোনো একটি লক্ষ্যবস্তুতে নয় বরং এবার একসাথে অনেকগুলি লক্ষ্যে হামলা করেছে রাশিয়া। বিশেষ করে, ইউক্রেনের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সামরিক কম্যান্ড সেন্টারগুলিকে নিশানা করা হয়, এবং তাতে সার্বিকভাবে সফলও হয়েছে।
ফলে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে জরুরি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে ইউক্রেন। বন্ধ করেছে বিদ্যুৎ রপ্তানিও।
কের্চ সেতুতে হামলার পরপরই ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানের নতুন সর্বাধিনায়ক হিসেবে জেনারেল সের্গেই সুরভিকিনকে নিয়োগ দিয়েছেন পুতিন। বেসামরিক অবকাঠামোতে সর্বাত্মক হামলার এ পরিকল্পনা সুরভিকিনই করেছেন বলে ধরে নেওয়া যায়।
সিরিয়ার যুদ্ধেও অধিনায়ক ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বেই মাসব্যাপী বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত আলেপ্পো শহরে নির্বিচার বোমাবর্ষণ করা হয়েছে।
শহরটি দখলে নেওয়ার চেষ্টায় বোমা ফেলে বহুতল ভবনগুলি বিধ্বস্ত করে দেয় সিরিয় ও রুশ বিমান। ব্যবহার করা হয় ক্লাস্টার (গুচ্ছ) ও ইনসিনডিয়ারি (আগ্নেয়/ দাহ্য) বোমা। শত্রুর বাংকার ধ্বংস করা হয় বাংকার ব্লাস্টার বোমা দিয়ে।
সিরিয়ার যুদ্ধে একাধিকবার চিকিৎসা কেন্দ্র ও হাসপাতালকে টার্গেট করা হয়েছে। এমনকী আলেপ্পোর সুপরিচিত আল-সাখোর মেডিকেল সেন্টার নামক একটি হাসপাতাল চারবার বিমান হামলার শিকার হয়।
মানবাধিকার গোষ্ঠী– হিউমান রাইটস ওয়াচ এর মতে, সবমিলিয়ে রাশিয়া ও বাশার আল আসাদের বাহিনী মোট ১৬টি চিকিৎসা কেন্দ্রে হামলা চালিয়েছে। হামলা করা হয় বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের লাইনেও।
আলেপ্পো ইউক্রেন ছিল না। আলেপ্পোর লড়াইয়ে শামিল হয় ইসলামপন্থী বিদ্রোহীরা, যাদের অধিকাংশেরই ছিল না পূর্ব প্রশিক্ষণ বা সামরিক অভিজ্ঞতা। আল কায়েদের মতো কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরাও ছিল। কিন্তু, তাদের ছিল ভারী গোলন্দাজ কামান ও কার্যকর বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের অভাব।
তারপরও এই বিদ্রোহীদের নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে বেসামরিক নাগরিক ও চিকিৎসা কেন্দ্রের ওপর নির্দয় হামলাই হয়ে ওঠে রুশ ও আসাদ বাহিনীর অভিযানের মূল বৈশিষ্ট্য।
ইউক্রেনের লড়াই অনেক দিক থেকেই সিরিয়ার চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির। ইউক্রেনের এমন সেনাবাহিনী আছে যারা রুশ বাহিনীর কাছ থেকে ভূমি উদ্ধার করতে পারছে। কিয়েভের বিমান বাহিনী এখনও টিকে আছে। গোলন্দাজ কামান, মর্টার, রকেট আর্টিলারি ও সাঁজোয়া যানও আছে যথেষ্ট।
পশ্চিমাদের দেওয়া দূরপাল্লার কামান ও রকেট আর্টিলারি দিয়ে শত্রুর পেছনের সারিতেও হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। রুশ অধিকৃত এলাকায় ইউক্রেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হামলা করে রাশিয়ার পক্ষ নেওয়া ব্যক্তিদের হত্যা করছে। হামলা হয়েছে রুশ বাহিনীর ব্যবহৃত বিমানঘাঁটি ও বন্দরে।
আলেপ্পোতে কট্টর ইসলামপন্থীরা সন্ত্রাসবাদী কৌশল প্রয়োগ করেও রুশ বাহিনীকে ঠেকাতে পারেনি। এক পর্যায়ে তারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, এরপর বোমা ও গোলাবর্ষণে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ইউক্রেনীয় নেতাদের আলোচনা টেবিলে ফেরানোর কৌশল হিসেবেই- দেশটির সকল অংশে সাম্প্রতিক বিপুল ক্ষতি করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ওয়াশিংটনের বিরোধিতার ফলে এপর্যন্ত ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে ফলপ্রসূ কোনো শান্তি আলোচনা শুরু হয়নি। আমেরিকা ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে কিয়েভকে।
পশ্চিমা সমর্থনের কল্যাণেই যুদ্ধের ময়দানে এখনও টিকে আছে ইউক্রেন। ফলে ওয়াশিংটনকে অমান্য করে শান্তি আলোচনায় ফেরার সুযোগও কম দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির সামনে। তাই মস্কো এবার কিয়েভ এবং ওয়াশিংটনকে এ বার্তাই দিতে চায় যে– যুদ্ধের চালিয়ে গেলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে। এবং তার সুফল (রাশিয়ার পরাজয়) অর্জনের জন্য চরম মূল্য দিতে হবে।
এরমধ্যেই ইউক্রেনকে শত শত কোটি ডলারের সামরিক সরঞ্জাম দিয়েছে আমেরিকা। এতদিন এনিয়ে কোনো জবাবদিহিও করতে হয়নি বাইডেন প্রশাসনকে। কিন্তু, ওয়াশিংটনে এখন আইনপ্রণেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমতের চাপ বাড়ছে ইউরোপেও।
আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসনকে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অনুসারীরাসহ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের। ট্রাম্প শিবিরের সাথে তাল মিলিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে যুদ্ধবাজ বলে সমালোচনা করেছেন ২০২০ সালে ডেমোক্রেট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী তুলসি গ্যাবার্ড।
রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ইউরোপেও যাচ্ছে যুদ্ধের বিপক্ষে। বিশেষত, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। ইমানুয়েল মাখোঁ ও ওলাফ শলৎজের মতো প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়করা নিজ দেশেই জন-অসন্তোষের মুখে পড়েছেন।
ইউরোপে শীত তীব্র হতে থাকার সাথে সাথে এ পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে। রাশিয়ান গ্যাস সরবরাহের ঘাটতি থাকায় তাদের উভয়ের জন্য এমনকী ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করাও অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে।
মার্কিন মুল্লুকে জ্বালানির দাম সহনীয় রাখতে কৌশলগত পেট্রোলিয়াম রিজার্ভের বিপুল অংশ বাজারে ছেড়েছে বাইডেন প্রশাসন। ফলে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে এ মজুতে। অন্যদিকে, ইউরোপের চাহিদা মেটাতে সেখানে বিপুল এলএনজি চালান পাঠাতে হচ্ছে, যাতে করে গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
ইউরোপের মতোই যুক্তরাষ্ট্রেও শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখতে, বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে এবং গুরুত্বপূর্ণ শিল্প ও কৃষি উৎপাদনে বহুল ব্যবহার রয়েছে গ্যাসের। এই মুহূর্তে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাকে আরও ব্যাহত করবে। সবমিলিয়ে বাইডেন প্রশাসনকে ব্যর্থ বলেই মনে করছে জনতার একটি বড় অংশ।
তার ওপর ভয়াবহ খরায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমেরিকায় গম, ভূট্টা ও সয়াবিনের মতো প্রধান প্রধান শস্য উৎপাদন। একইসঙ্গে, সারের দাম বাড়ার অর্থ এবারের শীতে মার্কিন জনতাও ভুগবে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ সুদহার বাড়ানোর মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় বাজারে তারল্য প্রবাহও কমছে।
পররাষ্ট্রনীতিতেও আরেকদফা ব্যর্থতার শিকার হয়েছেন বাইডেন। তার প্রশাসনের ব্যাপক লবিং সত্ত্বেও তেল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কর্তন করেছে ওপেক প্লাস। এই ঘোষণায় ক্ষুদ্ধ বাইডেন প্রশাসন জোটটির নেতৃস্থানীয় সদস্য সৌদি আরবের সাথে সম্পর্ক 'পুনঃমূল্যায়নের' কথা বলেছে।
মার্কিন কংগ্রেসের তিন ডেমোক্রেট সদস্য– সিন ক্যাসটেন, টম মালিনোস্কি এবং সুজান ওয়াইল্ড এরমধ্যেই সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে মার্কিন সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নিতে একটি বিল প্রস্তাব করেছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশ দুটির সাথে আমেরিকার সম্পর্কের অবনতি– পশ্চিমা বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির এই ক্ষণেই সুরভিকিনকে যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক নিয়োগ করলেন পুতিন। সুরভিকিন তার স্বভাবসিদ্ধ কৌশলে যতোটা কঠোর হবেন, ইউক্রেনসহ আমেরিকা ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলিকেও ততোটাই মূল্য দিতে হবে। কারণ, ভূ-রাজনীতির খেলায় কোনো কৌশলই অস্পৃশ্য নয়।
- সূত্র: এশিয়া টাইমস