২০২২ সালে ফেলে দেয়া হবে ৫ বিলিয়ন ফোন, কেন উদ্বেগের?
হাতের মোবাইল ফোনটি একটু ধীরগতির হয়ে গেলেই কিংবা নতুন কোনো মডেল বাজারে এলেই আমরা পুরোনোটা রেখে নতুন ফোন কিনি। আগের ফোনটা সচল থাকলেও অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে ড্রয়ারে কিংবা আলমারিতে।
ওয়েস্ট ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইকুইপমেন্ট (ডব্লিউইইই) ফোরামের বরাত দিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর এরকম ৫৩০ কোটি বা ৫.৩০ বিলিয়ন সচল কিন্তু অব্যবহৃত মোবাইল ফোন বর্জ্য হিসেবে পড়ে থাকবে।
ডব্লিউইইইর গবেষণায় দেখা গেছে, এসব অব্যবহৃত ফোন একটার ওপর আরেকটা স্তূপ করে রাখলে সেই স্তূপের উচ্চতা ৫০ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাবে, যা আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনের উচ্চতার চেয়ে একশো গুণ বেশি।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ডব্লিউইইই এই 'ই-বর্জ্যের' ক্রমবর্ধমান পরিবেশগত সমস্যাকে তুলে ধরেছে।
গবেষণা বলছে, অনেক মানুষই পুরোনো ফোন পুনর্ব্যবহার করতে না দিয়ে সেটি নিজেদের কাছে রেখে দেয়। এর ফলে একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো, ই-বর্জ্য, যেমন তারের তামা কিংবা রিচার্জেবল ব্যাটারির কোবাল্ট থেকে মূল্যবান খনিজ সংগ্রহ করা হয় না। ফলে মূল্যবান এসব খনিজ সম্পদ আহরণ করতে হচ্ছে খনি থেকে খনন করে।
ডব্লিউইইইর মহাপরিচালক প্যাসকেল লেরয় বলেন, 'মানুষ বোঝে না যে আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ এসব বস্তুর অনেক মূল্য আছে। সামগ্রিকভাবে এসব বস্তু বিশ্বে বেশ বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে।'
সংবাদ সংস্থা এএফপিকে তিনি বলেন, 'যেসব বৈদ্যুতিক পণ্য নিয়ে সর্বোচ্চ উদ্বেগের কারণ রয়েছে সেগুলোর একটি হচ্ছে স্মার্টফোন। এসব ফোনে থাকা দুর্লভ ধাতুগুলো রিসাইকেল না করলে এগুলো চীন বা কঙ্গোর মতো দেশগুলোর খনি থেকে উত্তোলন করতে হবে।'
সারা বিশ্বে মানুষ আনুমানিক ১৬ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৬০০ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এর মধ্যে ইউরোপের ফোনগুলোর প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই আর পুনর্ব্যবহার করা হয় না।
ডব্লিউইইই বলছে, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ওয়াশিং মেশিন, টোস্টার থেকে শুরু করে ট্যাবলেট পিসি, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ডিভাইস পর্যন্ত ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল বর্জ্যের 'পাহাড়' ক্রমেই বড় হবে। তাদের হিসাব অনুসারে, ২০৩০ সাল নাগাদ ই-বর্জ্য উৎপাদন বছরে ৭৪ মিলিয়ন টন বাড়বে।
অথচ এসব ডিভাইস (বর্জ্য) থেকে নতুন অনেক ইলেকট্রনিক ডিভাইস বা অন্যান্য সরঞ্জাম তৈরির উপাদান—যেমন উইন্ড টারবাইন, বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাটারি কিংবা সোলার প্যানেল—পাওয়া যেতে পারে বলে জানান ডব্লিউইইইর ব্যবস্থাপক ম্যাগডালেনা চ্যারিটানোভিজ। এই সবই কার্বন নিঃসরণ কমানো ও পরিবেশবান্ধব সমাজে রূপান্তরের জন্য এসব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জরিপ সংস্থা ম্যাটেরিয়াল ফোকাসের সমীক্ষা বলছে, শুধু যুক্তরাজ্যেই ২০ মিলিয়নেরও বেশি সচল বৈদ্যুতিক যন্ত্র অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। এসব পণ্যের মোট মূল্য প্রায় ৫.৬৩ বিলিয়ন পাউন্ড।
ইউরোপের একটি পরিবারের প্রত্যেক সদস্য গড়ে ৮ কেজি অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক ডিভাইস ফেলে রাখে বলে আরেক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
ই-বর্জ্য নিয়ে বাংলাদেশেরও যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ রয়েছে। গত বছরের ২৭ জুন 'প্রথম আলো'তে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের তৈরি করা একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ওই বছর দেশে ৪ লাখ টন ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিকস বর্জ্য জমা হয়। এসবের মধ্যে রিসাইকেল বা রিসাইক্লিং শিল্পে ব্যবহার হয় মাত্র ৩ শতাংশ।
বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০ শতাংশ হারে ই-বর্জ্য বাড়ছে বলে জানানো হয় পরিবেশ অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ২০৩৫ সাল নাগাদ দেশে প্রতি বছর ই-বর্জ্য উৎপন্ন হবে ৪৬ লাখ টন।
ইউনাইটেড নেশনস ইন্সটিটিউট ফর ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ-এর সিনিয়র সায়েন্টিফিক স্পেশালিষ্ট কিজ বল্ড এএফপিকে জানান, ইউরোপে মোট ই-বর্জ্যের ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ সংগ্রহ বা রিসাইকেল করা হয়। নিম্ন-আয়ের দেশগুলোতে ই-বর্জ্য সংগ্রহ বা রিসাইকেলের হার ৫ শতাংশের নিচে—কোনো দেশে তা ১ শতাংশেরও কম।
এছাড়া ইইউয়ের সদস্যসহ অন্যান্য ধনী দেশগুলো থেকেও প্রতি বছর হাজার হাজার টন ই-বর্জ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পাঠানো হচ্ছে। এতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর রিসাইক্লিংয়ের বোঝাও বেড়ে চলেছে।
ই-বর্জ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হব কেন?
বর্তমানে সারা বিশ্বেই ই-বর্জ্য অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়ন (আইটিইউ) বলছে, ফেলে দেয়া ইলেকট্রনিক পণ্য 'সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ও সবচেয়ে জটিল' বর্জ্য উৎস, যা মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কারণ এতে মূল্যবান খনিজ যেমন থাকে, তেমনি থাকে অনেক ক্ষতিকর পদার্থও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের মধ্যে সিসা, পারদ, সিলিকন, ক্যাডমিয়াম, টিন, দস্তা, নাইট্রাস অক্সাইড, ক্রোমিয়াম প্রভৃতি রাসায়নিক থাকে। এসব রাসায়নিক মাটি ও পানিকে দূষিত করছে, নানাভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগের ঝুঁকি তৈরি করছে।
গত বছর ই-বর্জ্য ও শিশুস্বাস্থ্য নিয়ে তৈরি করা একটি প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, ই-বর্জ্যের অপ্রাতিষ্ঠানিক রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে লাখ লাখ শিশু, কিশোর-কিশোরী ও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অনানুষ্ঠানিক খাতে গড়ে ওঠা ই-বর্জ্য রিসাইক্লিং প্রক্রিয়ার সঙ্গে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার লাখ শিশু-কিশোর ও নারী যুক্ত। কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়াই তারা এ কাজ করছে।
এছাড়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোবাইল ফোন, রেফ্রিজারেটর ও এসিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর পদার্থ ক্যান্সার ও কিডনি নষ্ট হওয়া, থাইরয়েড হরমোন বিপর্যস্ত করাসহ নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।
চিকিৎসকরা বলছেন, ই-বর্জ্যের কারণে অনেকসময়ই অপরিণত শিশুর জন্ম নেয়। শিশুর ওজন কম হয়। এমনকি অনেক মা মৃত শিশুর জন্মও দেন। এছাড়া ই-বর্জ্যের সিসা নবজাতকের স্নায়ুতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করে বলেও জানান তিনি।
সমাধান কী?
২০২২ সালের শুরুর দিকে রয়্যাল সোসাইটি অভ কেমিস্ট্রি ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান খনিজ আহরণ করে তা দিয়ে নতুন পণ্য তৈরির জন্য প্রচারণা শুরু করে। ওই কর্মসূচিতে বলা হয়, ইউক্রেনের যুদ্ধের মতো বৈশ্বিক সংঘাত মূল্যবান ধাতুর সরবরাহ চেইনকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের মোট ই-বর্জ্যের মাত্র ১৭ শতাংশ যথাযথভাবে পুনর্ব্যবহৃত হয়। যদিও আইটিইউ আগামী বছরের মধ্যে সঠিকভাবে ই-বর্জ্য ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
ম্যাটেরিয়াল ফোকাসের হিসাবে বেরিয়ে এসেছে, যুক্তরাজ্যের গড়পড়তা প্রত্যেক পরিবার অব্যবহৃত প্রযুক্তিপণ্য বিক্রি করে প্রায় ২০০ পাউন্ড পেতে পারে।
এছাড়া সংস্থাটির অনলাইন প্রচারাভিযানে রিসাইক্লিং সেন্টার কোথায় পাওয়া যাবে, তা-ও বাতলে দেয়া হয়েছে।
প্যাসকেল লেরয় ই-বর্জ্য সমস্যার আরও কয়েকটি সমাধান দিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব পণ্য সংগ্রহের জন্য সুপার মার্কেটে কালেকশন বসানো যেতে পারে। নতুন পণ্য সরবরাহের সময় পুরোনো ও নষ্ট পণ্য নিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট আকারের ই-বর্জ্য পোস্ট অফিসের মাধামেও ফেরত নেওয়া যেতে পারে।