রাশিয়ান মিসাইলের আসলে দাম কত: কতোটা খরচ হয় কেএইচ-১০১ বা ইস্কান্দার মিসাইল তৈরিতে
ইউক্রেনে হাজারো ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে রাশিয়া। অনেকগুলি লক্ষ্যে আঘাত হেনেছে, আবার কিছু ক্ষেপনাস্ত্রকে আকাশেই ধবংস করেছে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। খবর ডিফেন্স পোস্টের
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধবংসের একটি আর্থিক খতিয়ানও প্রকাশ করছে গণমাধ্যম ফোর্বসের ইউক্রেনীয় এডিশন। এর মাধ্যমে, তারা বোঝাতে চাইছে রাশিয়ার কী পরিমাণ অর্থ অহেতুক নষ্ট হলো, যা ইউক্রেনেরই সাফল্য। এটি শত্রুর বিরুদ্ধে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই। আবার নিজ নাগরিকদের মনোবল চাঙ্গা রাখারও কৌশল যুদ্ধকালে।
ইউক্রেনের ফোর্বস নিচে আলোচিত মূল্যের ভিত্তিতে দিনে মোট কত টাকার রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধবংস হলো তার হিসাব প্রকাশ করে...
ক্ষেপণাস্ত্রের নাম ও দামের হিসাবটি হলো–
- কেএইচ-১০১ – ১৩ মিলিয়ন ডলার
- ক্যালিবার – ৬.৫ মিলিয়ন ডলার
- ইস্কান্দার (কোন ধরনের সেটি উল্লেখ করা হয় না) – ৩ মিলিয়ন ডলার
- অনিকস – ১.২৫ মিলিয়ন ডলার
- কেএইচ-২২ – ১ মিলিয়ন ডলার
- টোচকা – ০.৩ মিলিয়ন ডলার
এই হিসাবে কোনটারই সঠিক দাম উঠে আসেনি। আসলে এটি একটি প্রতীকী নিরুপণ বললেই সঠিক হয়। বাস্তবে সমরাস্ত্রের প্রকৃত দাম নির্ধারণ বেশ জটিল একটি প্রক্রিয়া। এতে নানান ধরনের প্রেক্ষাপট যুক্ত থাকে।
তবে এই হিসাবটাই দেশটির অনেক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা উল্লেখ করছেন। যা সংশোধনের জন্য ইউক্রেনীয় ডিফেন্স পোস্ট প্রকৃত দাম নির্ধারণের নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেছে।
এতে বলা হয়, ফোর্বসের পর্যালোচনার প্রধান সমস্যা– সেখানে মিসাইলের দাম নির্ধারণ কোন সূত্রে করা হলো তার উল্লেখ থাকে না। এরমধ্যে একমাত্র ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইলের দাম সম্পর্কেই গ্রহণযোগ্য উৎস আছে বলে জানা যায়। খুব সম্ভবত এই তথ্য নেওয়া হয়েছে ভারত ও রাশিয়ার ২০০৬ সালের একটি বিক্রয় চুক্তি থেকে। এর আওতায় ২৮টি ক্লাব- এস৩এম-১৪ই (ক্যালিবারের রপ্তানিযোগ্য সংস্করণ) ১৮৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে রাশিয়া। অর্থাৎ, প্রতিটির দাম ৬৫ লাখ ডলার ধরা হয়।
তবে এই হিসাবও গ্রহণ করা যায় না। কারণ চুক্তিতে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র নয় এগুলি রক্ষণাবেক্ষণে দরকারি যন্ত্রাংশ ও অন্যান্য পরিষেবাও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তা ছাড়া, রপ্তানি চুক্তির দাম নির্ভর করে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত রপ্তানিকারক কর্তৃপক্ষ 'রোসোবোরনএক্সপোর্ট'- এর মর্জির ওপর। সুযোগ থাকলে তারা বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি দাম আদায় করে।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য মিসাইল উৎপাদনের সময় দাম নিয়ে কারসাজির সুযোগ কম। আসলে রুশ সরকার যে দামে কোনো মিসাইল কেনে, খুব সম্ভবত সেটিই এর প্রকৃত উৎপাদন খরচের সবচেয়ে কাছাকাছি অঙ্ক। এই বিক্রির মাধ্যমে রপ্তানির চেয়ে বেশ কম আয়ই হয় উৎপাদক কোম্পানির। মুনাফাও থাকে নিয়ন্ত্রিত। তবে দাম নির্ধারণে দুর্নীতি হলে তখন তারা বাড়তি দাম পেতে পারে। রাশিয়ায় প্রতিরক্ষা খাতে দুর্নীতির ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ক্যালিবার মিসাইলের আসল দাম ৬৫ লাখ ডলার নয়। অথচ এটিকে মূল সূত্র ধরে আরও অত্যাধুনিক কেএইচ-১০১ মিসাইলের দাম নির্ণয় করে ফেলেছে ফোর্বস। তাদের দাবি, এর দাম ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। খুব সম্ভবত ক্যালিবারের দামকে দ্বিগুণ করে হিসাবের এই অঘটন ঘটিয়েছেন সাংবাদিকরা।
অন্যদিকে, তারা ইস্কান্দার মিসাইলের দাম ধরেছেন ৩০ লাখ ডলার। তারা কোনো ইস্কান্দারের সংস্করনের নাম আলাদাভাবেও উল্লেখ করেননি। ইউক্রেনে এখন বেশি ব্যবহার হচ্ছে এই ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যালেস্টিক ধরন ৯এম৭২৩ এবং এর ক্রুজ ধরন আর-৫০০। দুটির দামও আলাদা। কারণ ব্যালেস্টিকের চেয়ে ইস্কান্দার মিসাইলের ক্রুজ সংস্করণটি বেশ আধুনিক। এবং একটি আধুনিক মিসাইলের মতোই এতে বেশ দামি যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তি সংযোজিত আছে। উৎপাদন প্রক্রিয়াও তাই বেশ ব্যয়বহুল।
গণমাধ্যমটি অনিক্স মিসাইলের দাম ১.২৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ১২ লাখ ডলার বলে প্রচার করছে। এক্ষেত্রে কিন্তু ভারতের সূত্র আর নেওয়া হয়নি। অথচ ভারতের কাছে মিসাইলটির সর্বাধুনিক সংস্করণের প্রযুক্তি বিক্রি করেছে রাশিয়া। ব্রাহ্মস নামে এটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করছে ভারত, প্রতিটির পেছনে খরচ হচ্ছে কমসেকম সাড়ে ৪৮ লাখ ডলার। চুক্তিপত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।
প্রাথমিকভাবে প্রাক্কলন করা হয়, ব্রাহ্মসের ৩০০ কিলোমিটার পাল্লার পুরোনো সংস্করণের দাম পড়বে ৩২-৩৫ লাখ ডলার। এটি বেশ যুক্তিসঙ্গত; কারণ অ্যাকটিভ হোমিং হেড- সেন্সরযুক্ত একটি সুপারসনিক মিসাইল তৈরির প্রকৃত খরচ এর কাছাকাছিই হওয়ার কথা।
১৯৬০ এর দশকের শেষদিক থেকে ১৯৮০'র দশকের শেষপর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য কেএইচ-২২ মিসাইল। এটির দাম নির্ধারণ করা বেশ মুশকিল। কারণ, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি। তখন ডলারের বিপরীতে সোভিয়েত রুবলের তুলনা করে কখনোই এর দাম প্রকাশ করা হয়। এমনকী গোপন রাখা হয় উৎপাদনের সম্ভাব্য খরচ।
ফোর্বস টোচকা-ইউ মিসাইলের দাম ধরেছে মাত্র ৩ লাখ ডলার। যা কিনা ইউক্রেনকে দেওয়া আমেরিকার তিনটি জ্যাভলিন ট্যাংক-বিধবংসী মিসাইলের সমান। কিন্তু, দামে এতই সস্তা হলে ইউক্রেন নিজেই এই মিসাইল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত পূর্ব ইউরোপের মিত্রদের থেকে এটি অনেক বেশি পরিমাণে কিনত এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারও করতো।
সমরাস্ত্র উৎপাদক কোম্পানিকে দেওয়া অর্ডারের আর্থিক অঙ্ক গোপন রাখে রাশিয়া। ফলে রুশ অস্ত্রের দাম নির্ধারণ করাটাও জটিল। তবে একই ধরনের কিছু প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের প্রকাশিত দাম জানলে মোটামুটি একটা ধারণা করা যায়।
যেমন আমেরিকার বিখ্যাত টমাহক ক্রুজ মিসাইলের সর্বাধুনিক সংস্করণ ব্লক- ফাইভের দাম ২০ লাখ ডলার। ২০২২ অর্থবছরের এই দামেই প্রতিটি মিসাইল কিনেছে পেন্টাগন।
এই হিসাবে, শুধুমাত্র রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হলেই ৬৫ লাখ ডলার দাম হওয়া সম্ভব ক্যালিবারের। দুর্নীতির সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না; কিন্তু তাই বলে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম হবে– এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়।
মার্কিন উপকরণের মূল্য বেশি। কর্মীদের বেতনভাতাও বেশি প্রতিরক্ষা কোম্পানিতে। সব মিলিয়ে টমাহকের উৎপাদন ব্যয় ক্যালিবারের চেয়ে বেশি হবে বলেই অনুমান করা সহজ। তাহলে, একটি বিচার-বিবেচনা করে সহজেই বলা যায়, রুশ নৌবাহিনী এই মিসাইল খুব বেশি হলে ১০ লাখ ডলারে কিনেছে। রাশিয়ার স্থানীয় গণমাধ্যমের অনুমান দামটি খুব সম্ভবত সাড়ে ৩ লাখ ডলার।
ইস্কান্দার সিস্টেমের আর-৫০০ এবং কেএইচ-৫৫৫ আকাশ থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের বেলায় একই যুক্তি প্রযোজ্য। কারণ, দুটি মিসাইলকেই প্রায় একই ধরনের প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশে সজ্জিত করা হয়েছে। এর চেয়ে কিছুটা দামি হতে পারে কেএইচ-১০১, কারণ রাশিয়া এটিকে স্টিলথ মিসাইল হিসাবে বানানোর চেষ্টা করেছে।
এরকম বিশ্লেষণের মাধ্যমে রুশ মিসাইলগুলির প্রকৃত দামের একটি চিত্র মেলে। অর্থাৎ, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় খুব সম্ভবত এ পরিমাণ অর্থ দিয়েই এগুলি কিনে থাকে:
- কেইচ-১০১– প্রায় ১২ লাখ ডলার
- ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল– সর্বোচ্চ ১০ লাখ ডলার
- ইস্কান্দার, আর-৫০০ ক্রুজ মিসাইল– সর্বোচ্চ ১০ লাখ ডলার
- ইস্কান্দার, ৯এম৭২৩ ব্যালেস্টিক– সর্বোচ্চ ২০ লাখ ডলার
- অনিক্স– সর্বোচ্চ ৩০ লাখ ডলার