রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইমরান খান কতদূর যেতে পারবেন?
ইমরান খানকে থামায় এমন সাধ্য কার! তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এমন কম সময়ই আছে, যখন তিনি ক্ষণিকের জন্য সংযত হয়েছিলেন। তাহলে, সামরিক আইনের (মার্শাল ল) মাধ্যমে? জারি কর সে বিধিনিষেধ; হুঙ্কার ছেড়েছেন তিনি। পদস্থ (সামরিক) কর্মকর্তাদের সংবাদ সম্মেলন (আর সেখানে দেওয়া হুমকি)? জবাবে ইমরান তাদের প্রতি জনসম্মুখে ইঙ্গিত দিয়ে তুলোধুনো করতে পিছ পা হননি। রাজপথে রক্তের বন্যা? সেখানেও ইমরানের হুঁশিয়ারি, নির্বাচন না হলে শান্ত হবে না তার বিপ্লব; আর রক্তপাতও হয়ে উঠবে অবশ্যসম্ভাবী। বিশ্লেষণ দ্য ডনের
এসব প্রেক্ষাপটে চলছে রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে তেহরিক- ই- ইনসাফ (পিটিআই)- এর লংমার্চ। বলা ভুল হবে না, বেসামরিক কোনো (রাজনৈতিক) নেতা ইতঃপূর্বে ইমরানের মতো করে রাষ্ট্রশক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানাননি। তার অদম্য আঘাতের মোকাবিলায় সম্পূর্ণ অসহায় বোধ করছে তার বিরোধী শিবির। কোনো সতর্কতা, হুমকি বা আইনি চ্যালেঞ্জও তাকে থামানোর পক্ষে যথেষ্ট শক্তিশালী হয়নি।
পাকিস্তানী জনতা আজ এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে, কারণ পাকিস্তান নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কারণ আজ খুবই কম। সাধারণ মানুষের মাথায় আজ কোমড়ভাঙ্গা মূল্যস্ফীতির ভার– কেড়ে নিচ্ছে সামান্য যেটুকু স্বাচ্ছন্দ্যও ছিল তাদের। জনতা এই দুর্ভোগের জন্য কাউকে না কাউকে দোষী করতে চায়– আর তাদের রোষকে সফলভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রের দিকে চালিত করছেন জনাব খান।
অথচ, ক্রমবর্ধমান এই জনপ্রিয়তার জোয়ারে হারাচ্ছে তার বিচারবুদ্ধি। পিটিআই নেতার এবার অন্তত এক কদম পিছিয়ে আসা উচিত। ভাবা উচিত, এই লড়াইকে কতদূর পর্যন্ত টেনে নিতে আগ্রহী হবেন তিনি। বর্তমান সরকার ও ইস্টাব্লিশমেন্ট (সামরিক বাহিনীর পোশাকি নাম পাকিস্তানে) চায় তিনি ভুল করুন, সেজন্যই তারা অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। এরমধ্যেই তারা প্রভাবশালী দুই পিটিআই নেতা আজম সোয়াতি এবং শাহবাজ গিলের করা ভুলের সুযোগ নিয়েছে। যদিও তাতে সফল হয়নি। কূটনৈতিক বার্তা নিয়ে ইমরান ক্ষমতাবানদের জিম্মি করে ক্ষমতায় ফেরার যে অভিসন্ধি করেছিলেন– তাও তার এক রেকর্ডকৃত বক্তব্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বানচাল হয়ে গেছে। এ ধরনের অপরিণামদর্শী ঔদ্ধত্যের জন্য পিটিআই চেয়ারম্যানকে চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইমরান যখন সফলভাবে সামরিক বাহিনীর সাথে বেসামরিক রাজনীতির নিয়মনীতিকে নতুন করে লিখছেন, তখন তাকে এটাও অনুধাবন করতে হবে যে, ইসলামাবাদের মসনদ হাসিল করতে গিয়ে– তিনি (ফিরে যাওয়ার) সব সেতুতে ধবংস করতে পারেন না। সব তরী ডুবাতে পারেন না। এককালে নওয়াজ শরীফও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, ফলাফল তার জন্য শুভ হয়নি মোটেও।
নওয়াজ-ও জনসম্মুখে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা প্রধানদের বিরুদ্ধে তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছেন। কিন্তু, অচিরেই পাকিস্তান মুসলীম লীগ (নওয়াজ) বা পিএমএল-এন অনুধাবন করে, সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধাচারণ করে টিকে থাকার শক্তি নেই তাদের। তাই যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন করেছিল, দিনশেষে জয়ের হাসি তারাই হেসেছে। শেষপর্যন্ত হাঁটু মুড়ে জেনারেল বাজওয়ার মেয়াদ বাড়াতে বাধ্য হয়েছে পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন সরকার।
পিটিআই ও তাদের পৃষ্ঠপোষক (সামরিক বাহিনী) এর মধ্যে যেদিন থেকে সম্পর্কের অবনতি, সেদিন থেকেই পিএমএল-এন ইস্টাব্লিশমেন্টের 'বি-টিম' হয়ে রাজনীতির ময়দানে খেলছে। এই মুহূর্তে ইমরান খানের কোনোপ্রকার সমঝোতার মনোভাব নেই, কিন্তু ছায়াশক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিনিও ক্ষমতায় ফেরার চূড়ান্ত লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারবেন না। ফলে আপোষের পথে তাকেও আসতে হতে পারে। হয়তো সেটা এই মুহূর্তেই হবে না– কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির সেনাসদরে অন্য কেউ মূল দ্বাররক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ন হলে– হয়তো আপোষের সুযোগও তৈরি হবে।
আর যদি তা না হয়, তখন তার ভাষায় "বিপ্লব" ছাড়া অন্য কোনো উপয়ান্তর থাকবে না সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সামনে। তাই একমাত্র আসছে সময়ই বলে দেবে তিনি এই উদ্দেশ্যের জন্য (বিপ্লবে) কতোটা আন্তরিক; অথবা যারা তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছে– তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাবেন কিনা।